শেখ হাসিনার ফ্যাসিবাদী শাসন অবসানের পর ভবিষ্যৎ বাংলাদেশে কী ঘটবে, তা আমাদের অজানা। তবে আমরা স্বপ্ন দেখি, আশা করি নতুন করে দেশ গড়ার।
যেকোনো বিপ্লবী পরিবর্তন কিছু অনিশ্চয়তাও তৈরি করে, যা স্থিতাবস্থার পক্ষের মানুষের বড়ই অপছন্দ। এরা দুঃশাসনের উপকারভোগী এবং বাংলাদেশের সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোর আজকের এই দশার পেছনে তাদেরও ভূমিকা আছে।
আজ আমাদের সবারই বোঝা দরকার, কেন হয়েছে ছাত্র–জনতার ইতিহাস সৃষ্টিকারী আন্দোলন।
এটি তরুণ প্রজন্মের উত্থান, প্রযুক্তি ব্যবহারের মানবিক বহিঃপ্রকাশ, রাষ্ট্রীয় হত্যাকাণ্ডের বিরুদ্ধে নতুন ধারার গণতান্ত্রিক প্রতিরোধ এবং গণবিরোধী ও দেশবিরোধী শাসনব্যবস্থার বিরুদ্ধে বাংলাদেশের মানুষের পুঞ্জীভূত ক্ষোভের বিস্ফোরণ।
অগ্নিগর্ভ হয়ে থাকা দেশকে বুঝতে না পারা এবং সরকারমুখী ধারার সাংবাদিকতা স্বৈরাচারী শাসনব্যবস্থা দীর্ঘকরণে ভূমিকা রেখেছে।
ব্যতিক্রমীরা পড়েছে ফ্যাসিজমের রোষানলে। এর দায় দালাল গণমাধ্যম নেতৃত্বেরও ওপরও পড়ে।
এ ক্ষেত্রেও ন্যায় ও সত্য প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। ‘পূজনীয়’ শাসকের বিদায়ে এই তথাকথিত সাংবাদিক ও তাদের নেতৃত্বের পতন ঘটেছে।
এটি পৃথিবীর সামনে এক নতুন দৃষ্টান্ত।
এই মিডিয়া–মুরব্বিদের ‘দোয়ায়’ শেখ হাসিনার রাজত্বে অন্য সব রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান ধ্বংসের পাশাপাশি চতুর্থ স্তম্ভখ্যাত গণমাধ্যমের স্বাধীনতা প্রায় শূন্যের কোঠায় নামিয়ে আনা হয়েছে।
বাস্তবিকপক্ষেই গত দশকের বাংলাদেশে সবচেয়ে বড় ক্যাজুয়ালটির শিকার ছিল গণমাধ্যম।
তাই রক্তক্ষয়ী জুলাই-আগস্ট ২০২৪–এর বিপ্লবপরবর্তী পর্যায়ে মুক্ত সাংবাদিকতা চর্চার সুযোগ এলেও মোটাদাগে মিডিয়া হাউসগুলো হারিয়ে ফেলেছে যোগ্যতা, শক্তি, সাহস ও গ্রহণযোগ্যতা।
অবস্থা এমনই যে কিছুদিন আগে তাদের অনেক রিপোর্টকে লোকে বলতেন গুজব, আর এখন হয়তো গুজবকেও বলবেন রিপোর্ট।
পূর্ববর্তী সরকারের আমলে যেহেতু অনুসন্ধানী প্রতিবেদন লিখতে উদ্যোগী হতে পারেনি, এখন তারা পুরোনো কাজ করবে কোন মুখে?
এ থেকে বোঝা যায়, দালালি একটি জীবনযাপনসংক্রান্ত রোগ বা লাইফস্টাইল ডিজিজও বটে!
এ অবস্থা অন্তর্বর্তী সরকারের পরিবর্তনের উদ্যোগ এবং রাষ্ট্র ও জনগণের ভবিষ্যতের জন্যও উদ্বেগের বিষয়। যদি না ব্যাপক সংস্কার আনা হয়, দেবত্ব আরোপকারী আওয়ামী লীগ সরকারের ভূত তাড়া করতেই থাকবে বাংলাদেশের গণমাধ্যমকে।
শেখ হাসিনা রাষ্ট্র পরিচালনার মতোই মিডিয়াকে করায়ত্ত করে রেখেছিলেন ‘স্টিক অ্যান্ড ক্যারোট আপ্রোচ’ বা একই সঙ্গে লাঠি ও গাজর দেখিয়ে।
একটি গোষ্ঠীকে হালুয়া–রুটি দিয়ে বাকি সবাইকে ভয় দেখিয়ে চুপ করিয়ে রাখার শাসন তিনি কায়েম করেছিলেন।
এই শাসন কিয়ামত পর্যন্ত জারি থাকবে বলেই বোধ হয় অনুমান ছিল তাঁদের।
হাসিনার অনুগত মিডিয়ার অ্যাসাইনমেন্ট হয়ে দাঁড়িয়েছিল, গুণকীর্তনের রাজনৈতিক বয়ান প্রচার এবং ভিন্নমতকে নীরব করে দেওয়া।
আয়রন লেডির শাসনের ‘সাফল্য’ ছিল রাষ্ট্রের চতুর্থ স্তম্ভ ভেঙে ফেলা, যাতে অনির্বাচিত সংসদ, দুর্নীতিগ্রস্ত নির্বাহী কর্তৃপক্ষ এবং ন্যায়বিচারহীন বিচার বিভাগের কার্যক্রমকে গণমাধ্যম চ্যালেঞ্জ করে না বসে।
ইতিমধ্যে গণমাধ্যম প্রতিষ্ঠান এবং এর বড় অংশ এতটাই মেরুদণ্ডহীন হয়ে পড়েছে যে বিবেক ও চিন্তার স্বাধীনতার সদ্ব্যবহারের সক্ষমতা ও সৎসাহস তাদের নেই।
সুতরাং রাষ্ট্র মেরামতের সঙ্গে সঙ্গে গণমাধ্যম পুনর্গঠন ও মানবসম্পদের গুণগত মানের পরিবর্তন না এনে উপায় নেই।
এ দেশে ঔপনিবেশিক ও স্বৈরাচারী শাসনের অভিজ্ঞতার কারণে আইনগত ও নিয়ন্ত্রণমূলক বাধা রয়েছে কার্যকর গণমাধ্যমের জন্য।
প্রায় ৪০টি আইনের অস্তিত্বই মিডিয়া, সাংবাদিকতা ও সাংবাদিকদের নানাভাবে হয়রানির মুখোমুখি করতে পারে।
অন্যদিকে গণমাধ্যমের উন্নয়ন ও গবেষণাসংক্রান্ত সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো কার্যত অকার্যকর।
করদাতাদের পয়সায় পরিচালিত বাংলাদেশ সংবাদ সংস্থা ও বাংলাদেশ টেলিভিশন অনেকটাই দলীয় মুখপত্রের মতো কাজ করেছে এত দিন।
এ সমস্ত সরকারি প্রতিষ্ঠান এমনি এমনিই ঠিক হয়ে যাবে ভাবা বোকার ‘সব পেয়েছি’র দেশে বসবাস করার শামিল।
খাঁচায় পোষা পাখির মতো বেসরকারি গণমাধ্যমও নতুন পাওয়া স্বাধীনতা ভোগ করতে গিয়ে আছাড় খাবে।
উদাহরণস্বরূপ যে খবরের কাগজ, অনলাইন বা টেলিভিশন চ্যানেল একসময় রিপোর্ট করত, ‘শিবির সন্দেহে সাতজনকে আটক’, তারা এখন শিবিরের জায়গায় লিখবে ‘ছাত্রলীগ’।
কারণ, যৌক্তিক, ন্যায়বিচারিক ও মানবিক প্রশ্ন করার অভ্যাস ও সংস্কৃতি নষ্ট হয়েছে সাবেক প্রধানমন্ত্রীকে তৈলমর্দনের সার্কাসটিক প্রেস কনফারেন্সে।
গণতন্ত্র ছাড়া যেমন গণমাধ্যম স্বাধীনভাবে কাজ করতে পারবে না, সক্রিয় সাংবাদিকসমাজ ছাড়াও প্রতিদিনের গণতন্ত্রচর্চা প্রাতিষ্ঠানিক রূপ পাবে না। আগামী বাংলাদেশ নির্মাণে রাষ্ট্রের অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের পুনর্গঠনপ্রক্রিয়া গণমাধ্যম সংস্কারের মাধ্যমেই পূর্ণ হতে পারে।
পেশাদারত্ব হারানো গণমাধ্যমের যুগে অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন সরকার মূলধারার মিডিয়াতে কঠোর সমালোচনার মুখে পড়বে না সত্য, কিন্তু গঠনমূলক বিশ্লেষণ, সদুপদেশ ও সুস্থ ভিন্নমত থেকে বঞ্চিত হতে পারে।
এমতাবস্থায় সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের নৈরাজ্যই প্রিয় থেকে যাবে সাধারণ মানুষের কাছে।
এমনিতেই পাঠক বা দর্শকহারানো মিডিয়া রাজস্ব আয়ের সংকটেও ভুগছে। তারা নিজে নিজে ঘুরে দাঁড়ানোর মতো অবস্থায় নেই। তাদের ঘুরে দাঁড়াতে সরকার ও অংশীজনের সম্মিলিত উদ্যোগ দরকার হবে।
আজকের ক্রান্তিকালীন মুহূর্তের দাবি হচ্ছে, গণমাধ্যম প্রতিষ্ঠান ও আইনকানুন সংস্কার করে ঢেলে সাজানো।
গণতন্ত্র ছাড়া যেমন গণমাধ্যম স্বাধীনভাবে কাজ করতে পারবে না, সক্রিয় সাংবাদিকসমাজ ছাড়াও প্রতিদিনের গণতন্ত্রচর্চা প্রাতিষ্ঠানিক রূপ পাবে না।
আগামী বাংলাদেশ নির্মাণে রাষ্ট্রের অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের পুনর্গঠনপ্রক্রিয়া গণমাধ্যম সংস্কারের মাধ্যমেই পূর্ণ হতে পারে।
গণতন্ত্রমনা গণমাধ্যমের পুনরুজ্জীবন রাষ্ট্রের প্রতি জন–আস্থা বাড়াবে, গণমানুষের অধিকারেরও সুরক্ষা দেবে।
খাজা মাঈন উদ্দিন, সাংবাদিক