সন গণনা করলে ২০১৯ সাল খুব বেশি দিন আগের ঘটনা নয়। কিন্তু চীনের প্রেসিডেন্ট সি চিন পিংয়ের জন্য অবশ্যই এটা ভিন্ন যুগের সূচনা। কারণ পাঁচ বছর পর এটা ছিল সি চিন পিংয়ের প্রথম ইউরোপ সফর।
এই পাঁচ বছরে বিশ্ব কোভিড মহামারির সেই ভয়াবহ অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হয়েছে। চীনে করোনা ভাইরাসের উৎপত্তি নিয়ে এখনো কিছু রহস্য রয়েই গেছে। এ সময়ে বিশ্ব ইউক্রেনে রাশিয়ার আগ্রাসনও দেখেছে। রাশিয়ার এই আগ্রাসনকে কৌশলগতভাবে সমর্থন দিয়ে চলেছে বেইজিং।
এই সবকিছুর মানে হচ্ছে, ২০১৯ সালে ইউরোপের বেশির ভাগ দেশ যেভাবে চীনকে বিবেচনা করত, এখন তাতে ভিন্নতা এসেছে। এই পরিবর্তনের ব্যাপারে সজাগ সি চিন পিং গত সপ্তাহে খুব সতর্কতার সঙ্গে ইউরোপে তাঁর সফরসূচি ঠিক করেন।
সোম ও মঙ্গলবার দুই দিন ফ্রান্স সফরের পর তিনি হাঙ্গেরি ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের সদস্য নয় এমন দেশ সার্বিয়া যান। সি চিন পিংয়ের ফ্রান্স সফর সম্পর্কে বলা হয়, চীনের সঙ্গে ফ্রান্সের বন্ধন দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের মডেল। আর হাঙ্গেরি ও সার্বিয়া—দুই দেশই ইউরোপে চীনের সমর্থক।
সি চিন পিং সার্বিয়াকে চীনের ‘নিরেট’ বন্ধু বলে প্রশংসা করেন। দুই দেশের মধ্যে দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্য ও বিনিয়োগ সম্পর্কও বাড়ছে। এর মধ্যে সার্বিয়ার বায়ু, সৌর ও পানিবিদ্যুৎ প্রকল্পে চীনের ২২০ কোটি ডলার বিনিয়োগও করছে।
২৭ সদস্যের ইউরোপীয় ইউনিয়নের মধ্যে সি চিন পিংয়ের সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ মিত্র হাঙ্গেরির প্রধানমন্ত্রী ভিক্তর ওরবান। তিনি শুধু চীনের সঙ্গে নয়, রাশিয়ার সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক বজায় রাখতে মনোযোগী। ওরবানের এই অবস্থান অন্যান্য সরকার ও রাষ্ট্রপ্রধান থেকে তাঁকে অনেক বেশি ভিন্নতা দিয়েছে।
হাঙ্গেরি সফরের সময় সি চিন পিং, ভিক্তর ওরবানকে স্বাগত জানিয়ে বলেন, হাঙ্গেরি ইউরোপে চীনের বৈদ্যুতিন গাড়িসহ স্বয়ংক্রিয় পণ্য উৎপাদন ও সরবরাহের মূল হাব।
চীন নিয়ে ইউরোপ মহাদেশে সমসাময়িক যে মতামত, তার থেকে সার্বিয়া ও হাঙ্গেরির মতামত ভিন্ন। ই
উরোপের মূল অবস্থান জানা যায় গত সোমবার ফ্রান্সে চীনের প্রেসিডেন্টের সঙ্গে সাক্ষাৎ করা ইউরোপীয় কমিশনের প্রেসিডেন্ট উরসুলা ভন ডার লেনের বক্তব্যে। চীন নিয়ে তিনি ডি-রিস্কিং বা ঝুঁকিপূর্ণ পণ্যে বাণিজ্য না করার নীতি ঘোষণা করেন।
সামগ্রিক প্রেক্ষাপট বিবেচনায়, সি চিন পিং তাঁর গত সপ্তাহের ইউরোপ সফরকে মহামারির পর ইউরোপের সঙ্গে সম্পর্কের গুরুত্বপূর্ণ বিন্যাস বলে আশা করতেই পারেন। যা–ই হোক, ফ্রান্স, সার্বিয়া ও হাঙ্গেরি সফর ছিল অত্যন্ত আন্তরিক পরিবেশে। কিন্তু বাস্তবতা হলো, ইউরোপের সঙ্গে চীনের বৃহত্তর মৈত্রীর বিষয়টি শীতলই থেকে যাবে; বরং সেটা এ বছর আরও খারাপ হতে পারে।
সি চিন পিংয়ের এই সফরের সময় কাকতালীয়ভাবে প্যারিস ও বেইজিংয়ের সম্পর্কের ৬০ বছর পূর্তি হয়েছে। সি চিন পিংকে ফ্রান্স খুব উষ্ণ অভ্যর্থনা জানিয়েছে। উরসুলা ভন ডার লেনের সঙ্গে সি চিন পিংয়ের আলোচনা হয়েছে।
কিন্তু সি চিন পিংয়ের এবারের ইউরোপ সফরের রাজনৈতিক আবহ, পাঁচ বছর আগের সফর থেকে অনেক বেশি ভিন্ন। পাঁচ বছর আগে ফিরে যাওয়া যাক। সি চিন পিংকে গভীর ভালোবাসায় স্বাগত জানিয়েছিল ইতালি। জি-৭–ভুক্ত দেশের মধ্যেই ইতালিই প্রথম চীনের বেল্ট অ্যান্ড রোডস মহাপরিকল্পনায় স্বাক্ষর করেছিল। যদিও পশ্চিমা বিশ্ব ইতালির এই সিদ্ধান্তকে তখনই বিতর্কিত বলেছিল। ওয়াশিংটনে ট্রাম্প প্রশাসন ইতালির সমালোচনা করেছিল।
ইতালির বর্তমান প্রধানমন্ত্রী জর্জিয়া মেলোনি ২০২২ সালে ক্ষমতায় আসেন। গত বছর তিনি চীনের সঙ্গে চুক্তি বাতিল করেন। অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক প্রশ্নে চীন ও ইউরোপীয় ইউনিয়ন সম্পর্কের যে টানাপোড়েন চলছে, তাতে এটা অনিবার্য ছিল।
রাজনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে বিবেচনা করলে পশ্চিমা বিশ্বের বড় অভিযোগ, জিনজিয়াং প্রদেশে উইঘুর জনগোষ্ঠীর ব্যাপকভাবে মানবাধিকার লঙ্ঘন করছে চীন। আর অর্থনৈতিক প্রেক্ষাপট থেকে বিবেচনা করলে, রাষ্ট্রীয় ভর্তুকি দিয়ে চীন তার ইলেকট্রিক যানবাহন, ব্যাটারি, সৌর প্যানেলের ‘ভাগাড়’ বানানোর চেষ্টা করছে ইউরোপীয় ইউনিয়নকে।
এখানেই শেষ নয়। ইউরোপীয় ইউনিয়নের শীর্ষ নেতারা ক্রমাগত উদ্বেগ জানিয়ে আসছেন যে চীন বাইরে থেকে ইউরোপের রাজনীতিতে হস্তক্ষেপ করছে। তাঁরা বলছেন, ইউরোপে চীন ভাগ করো ও শাসন করো কৌশল নিয়েছে, যা কিনা মহাদেশটির সম্মিলিত স্বার্থ খর্ব করছে।
ইউরোপীয় ইউনিয়নের পররাষ্ট্র বিষয়ের প্রধান জোসেফ বোরেল এমন অভিযোগও করেছেন যে চীন ইউরোপে বিকল্প ধরনের সরকারব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার সুযোগ খুঁজছে।
যা–ই হোক, চীনের প্রতি ইউরোপীয় ইউনিয়নের নীতি স্পষ্টতই কঠোরতর পথে হাঁটছে। এমনকি বেইজিং দীর্ঘদিন অপেক্ষার পর যে বাণিজ্য ক্ষেত্রে সমন্বিত চুক্তি সম্পাদন করতে পেরেছিল, সেটাও ইউরোপীয় পার্লামেন্টে পুনর্নিরীক্ষণের জন্য পাঠানো হয়েছে। এই চুক্তি আটকে যাওয়ার পেছনে মূল উদ্বেগের জায়গা হলো চীনের আচরণ।
চীন ইস্যুতে ইউরোপে আরও সুদৃঢ় ঐক্য প্রতিষ্ঠার চেষ্টা চললেও ২৭টি দেশকে একই ছাতার নিচে আনতে রীতিমতো সংগ্রাম করতে হচ্ছে। এই বিভাজনকেই সুযোগ হিসেবে নিচ্ছে চীন। ইউরোপ সফরে প্রথম পা রাখেন ফ্রান্সের মাটিতে।
ইউক্রেনে আগ্রাসনের পর থেকে রাশিয়ার প্রতি কঠোর অবস্থান নিলেও ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট তাঁর সাম্প্রতিক বক্তব্যে বৃহত্তর ইস্যুতে চীনকে স্বাগত জানিয়ে আসছেন। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, গত বছর ভন ডার লেনের সঙ্গে বেইজিং সফরের সময় এমানুয়েল মাখোঁ ডি-রিস্কিংয়ের বদলে ইকোনমিক রেসিপ্রোসিটি বা অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে পারস্পরিক সুবিধাদানের নীতির কথা বলেন। তাইওয়ান প্রশ্নে ফ্রান্সের অগ্রাধিকারের জায়গা থেকেও সরে আসেন তিনি।
একই সফরে ভন ডার লেন যখন বলছেন, ‘তাইওয়ান প্রণালির স্থিতিশীলতা আমাদের স্থায়ী গুরুত্বের জায়গা।’ সেই সময় মাখোঁ বলছেন, ‘তাইওয়ান আমাদের সংকট নয়, ইউরোপীয়দের উচিত নয় আমেরিকানদের অনুসরণ না করা।’
গত সপ্তাহে চীন ও ফ্রান্সের মধ্যকার আলোচনার বিষয়বস্তু কী ছিল, সেটা শুধু ইউরোপ নয়, যুক্তরাষ্ট্রও ঘনিষ্ঠভাবে নজরে রেখেছিল। প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন এক মাস আগেই ফ্রান্স সফরসূচি চূড়ান্ত করেন।
সামগ্রিক প্রেক্ষাপট বিবেচনায়, সি চিন পিং তাঁর গত সপ্তাহের ইউরোপ সফরকে মহামারির পর ইউরোপের সঙ্গে সম্পর্কের গুরুত্বপূর্ণ বিন্যাস বলে আশা করতেই পারেন। যা–ই হোক, ফ্রান্স, সার্বিয়া ও হাঙ্গেরি সফর ছিল অত্যন্ত আন্তরিক পরিবেশে। কিন্তু বাস্তবতা হলো, ইউরোপের সঙ্গে চীনের বৃহত্তর মৈত্রীর বিষয়টি শীতলই থেকে যাবে; বরং সেটা এ বছর আরও খারাপ হতে পারে।
অ্যান্ড্রু হ্যামন্ড, লন্ডন স্কুল অব ইকোনমিকসের এলএসই আইডিয়াসের সহযোগী
আরব নিউজ থেকে নেওয়া, ইংরেজি থেকে অনূদিত