বিএনপি আন্দোলন জমাতে পারে না। সাংগঠনিকভাবে দুর্বল। দলটির তেমন জনসমর্থন নেই। হেন কোনো কথা নেই বিএনপি নিয়ে বলা হয়নি আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে। কিন্তু সব সমালোচনাকে মোকাবিলা করে বেশ ভালোভাবেই ঘুরে দাঁড়িয়েছে বিএনপি। আগের থেকে বেশি আত্মবিশ্বাসী হচ্ছে এখন দলটি। বিএনপির আন্দোলনে নতুন মাত্রা লক্ষ করা যাচ্ছে। ভাষা ও কর্মসূচির কৌশলে পরিবর্তন এনেছে দলটি। দলটির নেতাদের কথাবার্তায় বেশ আত্মপ্রত্যয়ও লক্ষ করা যাচ্ছে।
বিএনপির এই হঠাৎ ঘুরে দাঁড়ানোর কারণ হচ্ছে কৌশলী কর্মসূচি ও তৃণমূলের উত্থান। গত কয়েক মাসের বিভিন্ন কর্মসূচি মাঠপর্যায়ে বিএনপির তৃণমূলের শক্তিকে তুলে ধরছে। কেন্দ্রীয় নেতাদের মধ্যে দ্বিধাদ্বন্দ্ব ও নানা স্বার্থ থাকলেও তৃণমূলের নেতা–কর্মীদের বার্তা পরিষ্কার। তাঁরা আন্দোলনেও মাঠে থাকতে চান। সাম্প্রতিক সময়ে বিএনপির চারজন কর্মী পুলিশের গুলিতে নিহত হলেও মিছিলে উপস্থিতি কমেনি। বরং দিন দিন উপস্থিতি বাড়ছে।
বিশেষ করে সাধারণ মানুষের সম্পৃক্ততা বাড়ছে। বিএনপির কর্মসূচিগুলোয় দৈনন্দিন জীবনের সমস্যা ও সংকট নিয়ে কথা বলা হচ্ছে। অর্থনৈতিক দুরবস্থা নিয়ে দেরিতে হলেও বিএনপি কর্মসূচি দিয়েছে। বিদ্যুতের মূল্যবৃদ্ধির প্রতিবাদে মিছিলে গিয়ে ভোলায় বিএনপির দুই কর্মী প্রাণ দিয়েছেন। এসব মিছিলে শুধু বিএনপির নেতা–কর্মীরাই আসছেন না, সাধারণ মানুষও সম্পৃক্ত হচ্ছে। লক্ষ করলে দেখা যাবে, দেশের বিভিন্ন স্থানে বিএনপির সমাবেশের আশপাশে কিছুটা দূরে দাঁড়িয়ে সাধারণ মানুষ বক্তব্য শুনছে। তারা কিন্তু মধ্যবিত্ত বা উচ্চবিত্ত না। লুঙ্গি পরা, মলিন চেহারার মানুষেরা দাঁড়িয়ে যাচ্ছে মিছিলের পাশে, সমাবেশের পাশে। কারণ, চাল, ডাল, তেলের দামে তারা দিশেহারা। জীবনযাত্রার ব্যয় নির্বাহ করতে তাদের জীবন ওষ্ঠাগত।
বিএনপিকে এই আন্দোলনের গতি এবং তৃণমূল ও সাধারণের জনসমর্থন ধরে রাখতে হবে। তবে একই সঙ্গে বিএনপিকে সতর্ক থাকতে হবে সরকারের সঙ্গে সমঝোতার গুঞ্জন নিয়ে। এ ধরনের গুঞ্জন কর্মীদের হতাশ করবে। কর্মসূচিভিত্তিক গতির রাশ টেনে ধরবে। সম্প্রতি বিভাগভিত্তিক মতবিনিময় সভায় তৃণমূলের নেতারা যেকোনো ধরনের সমঝোতার বিষয়ে সতর্ক করে দিয়েছেন কেন্দ্রীয় নেতাদের। তৃণমূল আর এই সরকারের অধীনে তারা নির্বাচনে যেতে রাজি না।
অর্থনৈতিক উন্নয়নের নানা ফিরিস্তি দিয়ে তাদের পেট ভরছে না। বরং তাদের পেট পুড়ছে। এ অবস্থা থেকে পরিত্রাণের জন্য তারাও পরিবর্তন চায়। অর্থনৈতিক দুরবস্থার অবসান চায়। তারা চায় অর্থ পাচার, লুটপাট বন্ধ হোক। বিদ্যুতের দাম কমানো হোক। চাল–ডালের জন্য টিসিবির ট্রাকের পেছনে মানবসারি ছোট হোক। সাধারণ মানুষের জীবনে নিরাপত্তা ফিরে আসুক। বাড়ি ফেরার পথে সামিয়া প্রীতির মতো আর নিহত হতে চায় না। গুমোট পরিস্থিতি থেকে বের আসতে চায় সাধারণ মানুষ।
মূল্যস্ফীতি, ডলারের সংকট, আমদানি ও প্রবাসী আয়ে হ্রাসের কারণে সরকার বেকায়দায় আছে। জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধিসহ নিত্যদিনের খরচের বোঝা মানুষজন আর টানতে পারছে না। এসব কারণে সাধারণের উপস্থিতি বিএনপির মিছিলে বাড়ছে। নারায়ণগঞ্জে নিহত যুবদল কর্মী শাওন প্রধান গাড়ির গ্যারেজে কাজ করতেন। মুন্সিগঞ্জে নিহত শাওন ভূঁইয়া মিশুক চালাতেন। ভোলায় নিহত দুই কর্মীও সাধারণ পরিবার থেকে আসা। সাধারণ মানুষের অংশগ্রহণই আন্দোলন–সংগ্রামে পরিবর্তন সূচিত করে। অবশ্য অর্বাচীনের মতো অনেকেই মনে করেন মধ্যবিত্ত ও অভিজাতদের অংশগ্রহণ রাজনৈতিক পরিবর্তনে গুরুত্বপূর্ণ। মধ্যবিত্তের নানা টানাপোড়েন থাকে। বিভিন্ন হিসাব–নিকাশ তাদের আন্দোলন–সংগ্রামে সম্পৃক্ত হতে দ্বিধান্বিত করে। আর উচ্চবিত্তের হাত ধরে কোথাও বিপ্লব হয়েছে বলে জানা নেই। বরং সর্বহারা শ্রেণির জোয়ারে এই অভিজাত শ্রেণি ভেসে যায়।
সাধারণের সম্পৃক্ততার পাশাপাশি বিএনপির চলমান আন্দোলনের উল্লেখযোগ্য দিক হচ্ছে হরতাল-অবরোধ না দিয়েও আন্দোলন নিয়ে জনমনে একধরনের আস্থা সৃষ্টি করা। বিএনপি কোনো জ্বালাও–পোড়াও কর্মসূচি দেয়নি। দিনের বেলায় প্রকাশ্যে কর্মসূচি পালন করেছে। এই কর্মসূচিতে বিএনপির নেতা–কর্মীরা জাতীয় পতাকা হাতে নিয়ে যোগ দিয়েছে অনেক জায়গায়। আরব বসন্তের সময় কায়রোর তাহরির স্কয়ার বা তিউনিসিয়ার তিউনিসের রাজপথে আমরা গণতন্ত্রকামীদের জাতীয় পতাকা নিয়ে মিছিল করতে দেখেছি। মিসর, লিবিয়া, তিউনিসিয়ার জাতীয় পতাকা গায়ে জড়িয়ে মিছিল করেছে আরব বসন্তের নায়কেরা। তুরস্কে জাতীয় পতাকা নিয়ে রাতের রাজপথে নেমে অভ্যুত্থান আটকে দিয়েছিল এরদোয়ানের সমর্থকেরা। চিলির গণবিক্ষোভকালে আমরা জাতীয় পতাকা দেখেছি জনতার হাতে। বাগদাদে এখনো জাতীয় পতাকা নিয়ে আন্দোলন করছে ইরাকিরা। যেকোনো ধরনের অপশাসনের বিরুদ্ধে জাতীয় পতাকা নিয়ে আন্দোলন নাগরিকদের শক্তি জোগায়। উদ্বেলিত করে গণতন্ত্রের জন্য।
ফলে বোঝাই যাচ্ছে, সহিংস না হয়ে বিএনপি আন্দোলনে ভিন্নমাত্রা আনার চেষ্টা করছে। বিএনপির দিক থেকে এখন পর্যন্ত হিংসাত্মক কর্মসূচি পরিলক্ষিত হয়নি। বরং বিএনপি নিজেরাই আক্রান্ত হচ্ছে। এর বিপরীতে আওয়ামী লীগ ও পুলিশের একটি সহিংস চরিত্র প্রতিষ্ঠা পেয়েছে। নির্বাচন যতই এগিয়ে আসবে নানা পক্ষ থেকে ততই সহিংস পরিস্থিতি সৃষ্টির পাঁয়তারা চলবে। তবে বিএনপি নিজেদের কতটা সহিংসতা থেকে দূরে রাখতে পারবে বা অন্যান্য দলকে সঙ্গে নিয়ে আন্দোলন শুরু করলে পরিস্থিতি কোন দিকে যাবে, বলা মুশকিল।
বিএনপিকে এই আন্দোলনের গতি এবং তৃণমূল ও সাধারণের জনসমর্থন ধরে রাখতে হবে। তবে একই সঙ্গে বিএনপিকে সতর্ক থাকতে হবে সরকারের সঙ্গে সমঝোতার গুঞ্জন নিয়ে। এ ধরনের গুঞ্জন কর্মীদের হতাশ করবে। কর্মসূচিভিত্তিক গতির রাশ টেনে ধরবে। সম্প্রতি বিভাগভিত্তিক মতবিনিময় সভায় তৃণমূলের নেতারা যেকোনো ধরনের সমঝোতার বিষয়ে সতর্ক করে দিয়েছেন কেন্দ্রীয় নেতাদের। তৃণমূল আর এই সরকারের অধীনে তারা নির্বাচনে যেতে রাজি না। এমনকি বিএনপি যদি নির্বাচনে যেতে রাজিও হয় তবে প্রতিরোধের মুখে পড়বে নিজ দলের তৃণমূলের কর্মীদের পক্ষ থেকেই। বিএনপির তৃণমূলের কর্মীরা বলছেন, নির্দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন ছাড়া কোনো বিকল্প নেই। ভাবেসাবে মনে হচ্ছে, বিএনপির তৃণমূল কেন্দ্রীয় নেতাদের প্রতি আস্থা রাখতে পারছে না। বিগত দিনে আন্দোলন ভেস্তে যাওয়ার জন্য সরাসরিই মাঠপর্যায়ের নেতারা কেন্দ্রীয় নেতাদের দায়ী করেছেন।
বিএনপির কেন্দ্রীয় অনেক নেতাকে নিয়েই তৃণমূলের নেতা-কর্মীদের মধ্যে অবিশ্বাস কাজ করছে। এই অনাস্থা, অবিশ্বাস বিএনপিকে দূর করতে হবে দলের ভেতর থেকে। যাঁদের নিয়ে সরকারের সঙ্গে সমঝোতা বা অতীতে দলীয় স্বার্থ বিসর্জনের গুঞ্জন রয়েছে, তাঁদের বিষয়ে সতর্ক থাকতে হবে। মনে রাখতে হবে, বিএনপির যে সব কর্মীরা মারা গেছেন তাঁরা দলের জন্যই জীবন দিয়েছেন। গুম, বিনা বিচারে হত্যা থেকে বাঁচার জন্য। কোনো সমঝোতার নির্বাচনে যাওয়ার জন্য বিএনপির তৃণমূলের কর্মীরা মিছিলে আসছেন না। জীবনও দিচ্ছেন না।
ড. মারুফ মল্লিক রাজনৈতিক বিশ্লেষক