পোশাকশ্রমিকদের বেতন বৃদ্ধির পরিমাণ ও তাঁদের ওপর পরিচালিত নিপীড়ন গ্রহণযোগ্য নয়
পোশাকশ্রমিকদের বেতন বৃদ্ধির পরিমাণ ও তাঁদের ওপর পরিচালিত নিপীড়ন গ্রহণযোগ্য নয়

মতামত

যুক্তরাষ্ট্রের শ্রমনীতির পেছনে রাজনীতিটাই মূল উদ্দেশ্য

যুক্তরাষ্ট্রের নতুন শ্রমিক অধিকার স্মারক বা নীতির অন্যতম লক্ষ্যবস্তু হতে পারে বাংলাদেশ। রাজনৈতিক বিবেচনায় এ নীতি নিয়ে শঙ্কিত হওয়ার অনেক কারণ রয়েছে। নতুন নীতিতে শ্রম অধিকারের বিষয়ে যা বলা হয়েছে, তার পেছনে রাজনীতি রয়েছে এবং যুক্তরাষ্ট্র নানাভাবে এই রাজনৈতিক অভিপ্রায়কে ব্যবহার করতে পারে।

যুক্তরাষ্ট্রের ওয়াশিংটনে বাংলাদেশের দূতাবাসের পক্ষ থেকে এ শঙ্কার কথা সরকারকে জানানো হয়েছে। ২০ নভেম্বর এ বিষয়ে ঢাকায় বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের জ্যেষ্ঠ সচিবকে চিঠি পাঠিয়েছেন বাংলাদেশ দূতাবাসের মিনিস্টার (বাণিজ্য) সেলিম রেজা। চিঠিতে বলা হয়, কেউ শ্রম অধিকার লঙ্ঘন করলে নতুন নীতিটি ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের পাশাপাশি রাষ্ট্রের ওপরও আরোপ করা হতে পারে। (প্রথম আলো, ৩০ নভেম্বর ২০২৩)

যুক্তরাষ্ট্রের বাংলাদেশ দূতাবাস যে শঙ্কার কথা ব্যক্ত করেছে, তা বেশ কয়েক দিন আগে জাতীয় শ্রমিক ফেডারেশনের প্রয়াত সাধারণ সম্পাদক কমরেড শফিউদ্দিনের তৃতীয় মৃত্যুবার্ষিকীর স্মরণসভায় একই শঙ্কার কথা প্রকাশ করা হয়েছিল। বস্তুত খোদ যুক্তরাষ্ট্রই আইএলওর কোর কনভেনশনের মূল দুটি বিষয়, অর্থাৎ সংগঠিত হওয়ার অধিকার ও দর-কষাকষির অধিকার যথাক্রমে ৮৭ ও ৯৮ আজ পর্যন্ত স্বাক্ষর করেনি।

এ ছাড়া যুক্তরাষ্ট্র আইএলওর ১০৫ বাধ্যতামূলক শ্রমের অবসান ও ১৭২ সর্বাপেক্ষা নিকৃষ্ট শিশুশ্রমের অবসান-সম্পর্কিত দুটি কোর কনভেনশন স্বাক্ষর করলেও সে দেশে বাধ্যতামূলক শ্রম ও শিশুশ্রমের দৃষ্টান্তও রয়েছে।

বাইডেনের শ্রম অধিকারবিষয়ক এই স্মারক বা নীতির অন্যতম লক্ষ্য যে বাংলাদেশ, তার জন্য বেশি দূর যাওয়ার প্রয়োজন পড়ে না। শ্রমনীতি ঘোষণার পরদিন যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্টনি ব্লিঙ্কেন ওই নীতি সম্পর্কে বলতে গিয়ে বলেছেন, বাংলাদেশের গার্মেন্টস শ্রমিকনেত্রী কল্পনা আক্তারের পাশে মার্কিন দূতাবাস না থাকলে তিনি বেঁচে থাকতেন কি না সন্দেহ।

উল্লেখ্য, বেশ কয়েক বছর আগে গার্মেন্টস শ্রমিকনেতা আমিনুল ইসলাম দুর্বৃত্তের হাতে নিহত হন। তিনি কল্পনা আক্তারের গার্মেন্টস শ্রমিক সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। ওই হত্যাকাণ্ডের সুরাহার ব্যাপারে মার্কিন দূতাবাস বাংলাদেশ সরকারের ওপর চাপ সৃষ্টি করেছিল।

বাংলাদেশের পোশাকশিল্পের বেশ কিছু ট্রেড ইউনিয়নের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের দূতাবাসের সরাসরি সম্পর্কের বিষয়টি এতই প্রকাশ্য যে তারা এটা গোপন রাখতে কোনো চেষ্টা করে না। মার্কিন রাষ্ট্রদূত মাঝেমধ্যেই ওই সব সংগঠনের কার্যালয়ে যান এবং শ্রমিকনেতাদের সঙ্গে তাঁর আলোচনা করার সংবাদ সংবাদপত্রে প্রকাশিত হয়। জানা যায়, এই শ্রমিকনেতাদের মাঝেমধ্যেই যুক্তরাষ্ট্রে উড়িয়ে নিয়ে যাওয়া হয়।

মার্কিন কংগ্রেসের শুনানিতে ব্র্যান্ডস বায়ারদের কনভেনশনে এই শ্রমিকনেতারা বাংলাদেশের শ্রমিকদের প্রতিনিধিত্ব করেন। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে এই শ্রমিকনেতাদের এক বছরের বিদেশ ভ্রমণে বিপুল পরিমাণ অর্থ ব্যয়ের যে তথ্য ঘুরে বেড়াচ্ছে, তা-ও বিস্ময়কর।

বাংলাদেশকে বাগে আনতে প্রয়োজনে সরকার পরিবর্তনের তাদের পুরোনো নীতি বাংলাদেশে প্রয়োগ করতেও তারা দ্বিধা করবে না বলে রাজনৈতিক অভিজ্ঞ মহলের ধারণা। তারা কখনো অবাধ, সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য ‘ভিসা নীতি’র প্রয়োগ, কখনো মানবাধিকার নীতি এবং সর্বশেষ এই শ্রমিক অধিকার নীতিকে তারা সামনে নিয়ে আসছে। বাংলাদেশ বা কোনো দেশের শ্রমিকদের স্বার্থে নয়; এর পেছনে রাজনীতিটাই মুখ্য। আর সেই রাজনীতি হলো যেকোনোভাবে নিজেদের স্বার্থ রক্ষা করা।

বাংলাদেশের পোশাকশ্রমিকেরা খুব সুখকর অবস্থায় নেই। সম্প্রতি মজুরি বোর্ড পোশাকশ্রমিকদের যে ন্যূনতম বেতন নির্ধারণ করেছে, তার পরিমাণ ১২ হাজার ৫০০ টাকা। সরকারের তরফ থেকে দাবি করা হয়েছে, পূর্বের মজুরির চেয়ে এবার ওই মজুরি ৫৬ শতাংশের বেশি বৃদ্ধি করা হয়েছে। তবে পোশাকশ্রমিক সংগঠনগুলোর মতে, এতে বার্ষিক ইনক্রিমেন্ট ধরা হয়নি। সেটা ধরা হলে এই বৃদ্ধির পরিমাণ ২৬ শতাংশ। ইতিমধ্যে দ্রব্যমূল্য কয়েক গুণ বেশি বেড়েছে।

এই মজুরি বৃদ্ধি সম্পর্কে পোশাকশিল্পের নেতারা মৌখিক কিছু প্রতিবাদ জানিয়ে চুপ করে গেলেও পোশাকশ্রমিকেরা তা মেনে নেননি। তাঁদের অব্যাহত আন্দোলন দমাতে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী যে ব্যবস্থা নিয়েছে, তাতে আঞ্জুআরা নামের এক নারী শ্রমিকসহ চারজন শ্রমিক নিহত হয়েছেন। শ্রমিক ও শ্রমিকনেতা মিলিয়ে ৮৮ জন গ্রেপ্তার হয়েছেন। দেড় হাজারের বেশি মামলায় ২০ হাজার শ্রমিককে অভিযুক্ত করা হয়েছে।

পোশাকশ্রমিকদের এই বেতন বৃদ্ধির পরিমাণ ও তাঁদের ওপর পরিচালিত নিপীড়ন কোনোক্রমেই গ্রহণযোগ্য নয়। পোশাকশিল্প নিয়ে যাঁরা গবেষণা করেন, তাঁদের মতে এই বেতন দিয়ে পোশাকশ্রমিকেরা মাসের অর্ধেক পর্যন্ত চলতে পারবেন, বাকি অর্ধেক সময় তাঁদের ধারদেনা করে চলতে হবে। ফলে একজন পোশাকশ্রমিক সারা জীবন ঋণের চক্রব্যূহের মধ্যেই থাকবেন।

পোশাকশ্রমিকদের এই বেহালের সুযোগ নিতে চলেছে যুক্তরাষ্ট্র। বাংলাদেশের নির্বাচন সামনে রেখে অবাধ, নিরপেক্ষ, শান্তিপূর্ণ ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন অনুষ্ঠানের বিষয়ে রাষ্ট্রদূতের অতিমাত্রায় তৎপরতা সবাই অবহিত। এই সময়কালে বাংলাদেশের মানবাধিকার পরিস্থিতি নিয়ে যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় ইউনিয়ন সোচ্চার ছিল।

তবে ২৮ অক্টোবর বিএনপির সমাবেশ ভন্ডুল হয়ে যাওয়ার পর বিএনপি যেমন ব্যাকফুটে চলে গেছে, তেমনি অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে যুক্তরাষ্ট্রও ব্যাকফুটে চলে গেছে। মাঝখানে অবশ্য যুক্তরাষ্ট্রের দক্ষিণ ও মধ্য এশিয়াবিষয়ক সহকারী মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডোনাল্ড লুর সংলাপের আহ্বান-সংবলিত তিন দলের কাছে দেওয়া চিঠি নিয়ে এ-পার্টি ও-পার্টির কাছে ছোটাছুটি করেছিলেন রাষ্ট্রদূত পিটার হাস।

সেই চিঠিতেও নির্বাচন তাদের মনঃপূত না হলে ভিসা নীতি প্রয়োগের প্রচ্ছন্ন হুমকি ছিল। কিন্তু ওই সংলাপের আহ্বান প্রত্যাখ্যাত হওয়ার পর পিটার হাস ‘ছুটি’ কাটাতে বাইরে চলে যান। ছুটি শেষে অবশ্য তিনি আবার ফেরত এসেছেন।

 তাঁর বিদেশ গমন ও ফিরে আসার সময়কালে মার্কিন দূতাবাস অথবা ইউরোপীয় দেশগুলোর নির্বাচনকেন্দ্রিক আর কোনো তৎপরতা দেখা যায়নি। তবে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তাঁর এক বক্তৃতায় বলেছেন, বিএনপি নির্বাচন নিয়ে কিছু করতে না পেরে বাংলাদেশকে অর্থনৈতিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করার চেষ্টা করছে। প্রধান নির্বাচন কমিশনার নির্বাচনকে অবাধ, নিরপেক্ষ করার গুরুত্ব বোঝাতে গিয়ে আরেক ধাপ এগিয়ে বলেছেন, বাংলাদেশের ওপর বিদেশি থাবা পড়তে পারে নির্বাচনে, এমন কিছু করা উচিত হবে না।

এ প্রেক্ষাপটেই যুক্তরাষ্ট্রের শ্রমিক অধিকার নীতি নিয়ে যে শঙ্কা তৈরি হয়েছে, তা একেবারে অমূলক মনে হয় না। অ্যান্টনি ব্লিঙ্কেন যে কল্পনা আক্তারদের কথা বলেছেন, তাঁদের দিয়ে এমন পরিস্থিতি তৈরি করা হতে পারে, যাতে শ্রমিক অধিকারের মতো একটি মহৎ বিষয়কে বাংলাদেশের বিরুদ্ধে ব্যবহার করার অজুহাত হিসেবে দাঁড় করানো যায়।

এটা যদি বাস্তব হয়, তাহলে শুধু পোশাকশিল্পের ক্ষেত্রেই নয়; হিমায়িত চিংড়ি, চা, চামড়া প্রভৃতি ক্ষেত্রেও এর বিরূপ প্রভাত পড়বে। বিশেষত যে পোশাকশিল্প এ দেশের রপ্তানির অন্যতম প্রধান খাত, সেই শিল্প কার্যত মুখ থুবড়ে পড়বে। হাজার হাজার পোশাকশ্রমিক কাজ হারিয়ে গ্রামে তাঁদের বাস্তুভিটায় ফিরে যেতে বাধ্য হবেন অথবা নিজেদের অন্য পেশায় যুক্ত হয়ে বাঁচার চেষ্টা করবেন। আর সামগ্রিকভাবে বাংলাদেশের অর্থনীতি কেবল থমকে দাঁড়াবেই না, যে গতিতে বাংলাদেশের অর্থনীতি এগিয়ে চলছিল, তা বড় ধরনের ক্ষতিতে পড়বে।

যুক্তরাষ্ট্রের শ্রমিক অধিকার নীতি ব্যবহার করে পোশাকশ্রমিক ও সাধারণ মানুষকে বিপদে ফেলার একটিই কারণ, তা হলো বাংলাদেশকে বেয়াড়াপনার জন্য শাস্তি দেওয়া। যুক্তরাষ্ট্র তার এশিয়া-প্যাসিফিক স্ট্র্যাটেজি বাস্তবায়নে বাংলাদেশকে তাদের সঙ্গে চায়। তারা চায় বঙ্গোপসাগরে ঘাঁটি। সাগরের গ্যাস উত্তোলনেও তারা একচেটিয়া অধিকার চায়। এমনকি কোয়াডে বাংলাদেশের অন্তর্ভুক্তির ব্যাপারে তারা আগ্রহী। এই চাপ এড়াতে বাংলাদেশ তার পররাষ্ট্রনীতির মূল সূত্র ‘সবার সঙ্গে বন্ধুত্ব, কারও সঙ্গে শত্রুতা নয়’ নীতি যুক্তরাষ্ট্রকে স্মরণ করিয়ে দিয়েছে এই প্রতিটি বিষয়ে একাধিকবার। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্র তা মানতে রাজি নয়।

বাংলাদেশকে বাগে আনতে প্রয়োজনে সরকার পরিবর্তনের তাদের পুরোনো নীতি বাংলাদেশে প্রয়োগ করতেও তারা দ্বিধা করবে না বলে রাজনৈতিক অভিজ্ঞ মহলের ধারণা। তারা কখনো অবাধ, সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য ‘ভিসা নীতি’র প্রয়োগ, কখনো মানবাধিকার নীতি এবং সর্বশেষ এই শ্রমিক অধিকার নীতিকে তারা সামনে নিয়ে আসছে। বাংলাদেশ বা কোনো দেশের শ্রমিকদের স্বার্থে নয়; এর পেছনে রাজনীতিটাই মুখ্য। আর সেই রাজনীতি হলো যেকোনোভাবে নিজেদের স্বার্থ রক্ষা করা।

  • রাশেদ খান মেনন সংসদ সদস্য ও ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি