মতামত

ক্ষমতার ঘোরে রাজনীতির অগস্ত্যযাত্রা

বিএনপির প্রতিষ্ঠা, প্রতিষ্ঠাতা ও রাজনীতি নিয়ে নানা কথা আছে। কিন্তু এ সময়ে সত্য হলো, দলটি মাঠপর্যায়ের আন্দোলনে এবার সাড়া পাচ্ছে। ২০১৪ সালের নির্বাচনের পরে তারা অগ্নিবোমা-সন্ত্রাসের ওপর নির্ভর করে আন্দোলন চালাতে গিয়ে নেতিবাচক সমালোচনার সম্মুখীন হয়েছিল।

তারপর দীর্ঘ প্রায় আট বছর বিএনপি মাঠে আন্দোলন জমাতে পারেনি। এ সময় ক্ষমতাসীন সরকার উন্নয়নের অনেক কাজ করে আত্মবিশ্বাস বাড়িয়েছে। আন্তর্জাতিক অঙ্গনেও দেশের ও রাষ্ট্রনেতা হিসেবে শেখ হাসিনার ভাবমূর্তিও বেড়েছে। এর সুফল আওয়ামী লীগেরই পাওয়ার কথা এবং এতে তাদের অনুকূলে জনমতও বাড়ার কথা।

এ সময়ে আওয়ামী লীগ নেতৃত্ব সরকার পরিচালনা, ক্ষমতা সংহত রাখা এবং বিভিন্ন উন্নয়ন ও জনবান্ধব কার্যক্রম বাস্তবায়নেই মনোযোগী ছিল। কিন্তু দল ও রাজনীতির দিকে নজর দেয়নি। এর পরিণতি দলের জন্য ভালো হয়নি আর গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় দুর্বল দল ও দলীয় রাজনীতি নিয়ে সরকারের পক্ষে গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ বজায় রেখে এগিয়ে চলা কঠিন হয়ে পড়ে। আওয়ামী লীগ বর্তমানে এ রকম একটা কঠিন বাস্তবতার মুখোমুখি রয়েছে বলেই মনে হচ্ছে।

১৯৯১ সালের নির্বাচনে অপ্রত্যাশিত পরাজয়ের বিমূঢ়তা কাটিয়ে ক্ষমতায় ফেরার কৌশল নিয়ে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বকে গভীরভাবে ভাবতে হয়েছে। তখন বিএনপি-জামায়াত জোটের তরফ থেকে আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে প্রধান দুটি সমালোচনার তির ছিল—১. ইসলাম বিপন্ন হবে দলটি ক্ষমতায় এলে এবং ২. দেশ ভারতের করদ রাজ্যে পরিণত হবে।

প্রথম সমালোচনার ভিত্তিতেই পরের সমালোচনাটি জোরালো হতে পারে। তাই আওয়ামী লীগ ইসলামসংক্রান্ত সমালোচনাটি অকার্যকর করার জন্য কৌশল নির্ধারণ করে। বলা দরকার, এ সমালোচনার আদত ভিত্তি তেমন ছিল না। বঙ্গবন্ধুর আমলেই বাংলাদেশ ওআইসি বা ইসলামি সহযোগিতা সংস্থার সদস্য পদ গ্রহণ করেছিল, তিনি নিজে এর শীর্ষ সম্মেলনে যোগ দিয়েছিলেন।

এ ছাড়া দলটি অসাম্প্রদায়িক আদর্শের কথা বললেও এর সঙ্গে যুক্ত মুসলিম নেতা-কর্মীরা বিএনপির নেতা-কর্মীদের মতোই ছিলেন ধর্মবিশ্বাসী উদার মুসলিম। তবু ১৯৯১ সালের পর থেকে, সম্ভবত রাজনৈতিক কৌশল হিসেবেই, এ দলের নেতা-কর্মীরা ধর্মীয় পরিচয় ও ধর্ম পালনের প্রমাণ যেন ভালোভাবে জাহির করতে শুরু করলেন। আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে রাজনীতিতে ধর্মের ব্যবহারও শুরু হলো তখন থেকে। বিএনপির মতো এ দলেও জামায়াতিদের অনুপ্রবেশ ঘটেছে।

আওয়ামী লীগ যে ইতিহাসের দায়বদ্ধ, সে দায় কেবল খুনিদের বিচার আর উন্নয়নের মাধ্যমে পূরণ হবে না। তাতে মানুষের চেতনার উন্নয়ন একই রকম জরুরি। আর সে কাজ করার মাধ্যম হলো রাজনীতি, হাতিয়ার হলো রাজনৈতিক দল, রূপকার হলো জনগণ বা ভোটার। ক্ষমতায় থেকে সে কথা বিস্মৃত হওয়া যায় না।

১৯৯১ সালের পরে ৩০ বছর অতিবাহিত হয়েছে। এ সময়ে আওয়ামী লীগে ধর্মীয় সংস্কৃতির প্রকাশ প্রকট হয়েছে। দলে এমন অনেক নতুন নেতা-কর্মী যুক্ত হয়েছেন, যাঁরা অসাম্প্রদায়িক চেতনা ধারণ করেন না। আবার পুরোনোদের মধ্যেও ধর্মীয় ধারায় নিজেদের রূপান্তর করে নিতে দেখা যাচ্ছে।

এ কথা বললে অত্যুক্তি হবে না যে আওয়ামী লীগ ও অঙ্গসংগঠনগুলোয় আর বিশুদ্ধ বাঙালি সংস্কৃতির চর্চা হয় না। ধর্মের চাপ যখন ভেতর ও বাইরে থেকে বাড়তে থাকে, তখন সে চাপ সামলানো কঠিন। আবার যেহেতু ক্ষমতায় থাকতে থাকতে ধীরে ধীরে আওয়ামী লীগে রাজনীতির চর্চা কমেছে, তাই পুরোনো ধারার অনেক নেতা-কর্মীও বিত্তবৈভব বাড়ানোর দিকে মনোযোগ দিয়েছেন।

সব এলাকায় এমন ধারার নেতা ও কর্মী তৈরি হয়েছে। তারা যখন দুর্নীতি ও ক্ষমতার মত্ততায় ব্যস্ত, তখন ধর্মীয় রাজনীতির অ্যাজেন্ডা নিয়ে আসা ব্যক্তিরা বিনা বাধায় নিজেদের কাজ গুছিয়ে নিচ্ছে। এ প্রেক্ষাপটে কিছু পুরোনো, তবে প্রাসঙ্গিক কথা মনে করা যায়।

২.

মনে পড়ছে পঁচাত্তরের পরে বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে কার্যকর চর্চা শুরু করেছিল বঙ্গবন্ধু পরিষদ, প্রথমে এর সভাপতি ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য আবদুল মতিন চৌধুরী। তাঁর মৃত্যুর পরে দীর্ঘদিন অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক মোশাররফ হোসেন সভাপতির দায়িত্ব পালন করেছেন। সংগঠনটির শাখা সারা দেশেই গড়ে উঠেছিল এবং এরশাদের আমলে এটি বঙ্গবন্ধু ও বাংলাদেশ, গণতন্ত্র ও মুক্তিযুদ্ধচর্চার একটি প্ল্যাটফর্ম হয়ে ওঠে।

এ সংগঠনের কাজে আওয়ামী লীগের অনেক নেতা-কর্মীও যুক্ত থাকতেন। এভাবে এই সংগঠন ছাড়া আরও সংগঠন এবং বিভিন্ন জাতীয় উপলক্ষভিত্তিক বহু সাময়িক উদ্যোগের মাধ্যমে সেই স্বৈরাচারী আমলে বাংলাদেশ ও মুক্তিযুদ্ধের চর্চা এগিয়ে গিয়েছিল। এর বিপরীতে ভাবতে হয় বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবর্ষ ও স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী উদ্‌যাপনের কথা।

এ দুটিই মূলত সরকারিভাবে উদ্‌যাপিত হয়েছে। আওয়ামী লীগ বা তার অঙ্গসংগঠনের উদ্‌যাপনগুলো পাকিস্তান আমলের সরকারি দলের আয়োজনের কথাই মনে করিয়ে দিয়েছিল। দুঃখের বিষয় হলো সরকারি উদ্যোগের বাইরে নাগরিক সমাজের উদ্যোগেও বড় আকারের জাতীয় আয়োজন হয়নি। বহু অনুষ্ঠান, বহু প্রকাশনা হলেও জনমানসে প্রভাব ফেলার মতো কাজ হয়েছে—এ কথা বলা যাবে না।

দেখা যাচ্ছে, রাজনৈতিক স্থবিরতার মধ্যে অসাম্প্রদায়িক গণতান্ত্রিক তথা মুক্তিযুদ্ধের চেতনার রাজনীতির অবক্ষয় কেবল রাজনৈতিক দলের ক্ষেত্রেই ঘটেনি, তা ঘটেছে নাগরিক সমাজেও। আওয়ামী লীগের ক্ষমতাকালে সমাজের এই অংশও—অতি ক্ষুদ্র ব্যতিক্রম ছাড়া—একইভাবে অবক্ষয়ের শিকার হয়েছে।

সরকারের কাছ থেকে অনেকেই নানা রকম সুবিধা পেয়েছেন, পাচ্ছেন। আর পাশাপাশি ধর্মান্ধ ব্যক্তি ও ধর্ম ব্যবসায়ীদের মাধ্যমে সমাজে যে ইসলামিকরণ-আরবিকরণের প্রক্রিয়া চলছে, তাতে তাঁরাও গা ভাসিয়েছেন। সরকার তার ক্ষমতাবলয় বৃদ্ধি ও সুসংহত করার জন্য আমলাতন্ত্রের সঙ্গে কার্যকর বোঝাপড়া করে নিতে সক্ষম হয়েছে।

সামরিক আমলাতন্ত্র, গোয়েন্দা সংস্থা ও সরকারের অন্যান্য অঙ্গের সঙ্গে মিলে যে শক্তিশালী বহুমাত্রিক ক্ষমতাবলয় তৈরি হয়েছে, তার পক্ষে যথার্থ গণতান্ত্রিক আচরণ কঠিন। এমন প্রতিষ্ঠানের নিয়মতান্ত্রিক সংস্কৃতিকে সংরক্ষণ করে জনমানুষের গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক সংস্কৃতির বিকাশ সম্ভব নয়। এমন কঠিন বাধা ডিঙানো কোনো একক দলের পক্ষে সহজ নয়, আওয়ামী লীগের জন্যও নয়।

৩.

যাঁরা মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও ষাটের দশক থেকে আগুয়ান রাজনৈতিক আদর্শ থেকে পঁচাত্তরের পরে বাংলাদেশকে তার অভীষ্ট পথে ফিরিয়ে আনার লক্ষ্যে কাজ করেছিলেন এবং ঠিক ব্যক্তিগত প্রাপ্তি অর্জনের কথাও ভাবেননি, তাঁরা এত উন্নয়নের মধ্যেও রাজনীতির অবক্ষয়ে হতাশা বোধ না করে পারেন না। দুঃখের বড় কারণ হলো আওয়ামী লীগ এই পরিণতি ডেকে না আনলেও পারত।

২০০৯ সালের নির্বাচনে বিপুল বিজয়ের ধারাবাহিকতা হয়তো থাকত না, কিন্তু পরবর্তী দুই জাতীয় নির্বাচনে একটু ঝুঁকি নিলে দেশ, দল, গণতন্ত্র—সবকিছুর জন্যই ভালো হতো, কারণ সাধারণ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন তাদের জন্য কঠিন হতো না। অথচ এখন কেবল দলেরই বা রাজনীতিরই অবক্ষয় ঘটেনি, এত বৈষয়িক উন্নয়নও সমাজমানসের পিছিয়ে পড়া ঠেকাতে পারেনি। বর্তমান আওয়ামী লীগ এবং বর্তমান সমাজ কি আর ষাটের দশক বা মুক্তিযুদ্ধকালের মতো অসাম্প্রদায়িক প্রগতিশীল গণতান্ত্রিক চেতনাকে ধারণ করে? করে না, বঙ্গবন্ধু বা মুক্তিযুদ্ধও আর রাজনৈতিক চর্চার বিষয় নেই, কেবল উদ্‌যাপনের ও আনুষ্ঠানিকতার বিষয় হয়ে পড়েছে।

উন্নয়ন প্রসঙ্গে আরেকটি কথা বলা প্রয়োজন। দেখা যাচ্ছে, সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নভুক্ত হয়ে ইউরোপ ও মধ্য এশিয়ার প্রজাতন্ত্রগুলোর ব্যাপক উন্নতি হলেও প্রথম সুযোগেই তারা স্বাধীনতা চেয়েছে। কারণ, মানুষের কাছে আত্মমর্যাদা ও মতপ্রকাশের স্বাধীনতা অত্যন্ত মূল্যবান সম্পদ। ইউক্রেনের প্রতিরোধযুদ্ধও এর আরেকটি দৃষ্টান্ত। বর্তমান সরকার প্রচুর কাজ করেছে, এ রকম উন্নয়ন কিংবা জনবান্ধব কার্যক্রম এ দেশে অতীতে কোনো সরকারই করেনি। বিষয়টা জানি বলেই আফসোসটা বেশি।

প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে প্রথমবার সাক্ষাতেই বলেছিলাম দেশের বড় রকম রূপান্তর ঘটাতে হলে অবশ্যই দীর্ঘ সময়ের জন্য ক্ষমতায় থাকার কথা ভাবতে হবে। উদাহরণ হিসেবে প্রতিবেশী দেশে প্রথম প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরুর দৃষ্টান্ত দিয়েছিলাম। কিন্তু তা তো ঘটতে হবে সরকারের কাজ এবং দলের ভূমিকার মাধ্যমে।

দল হিসেবেই তো নির্বাচনে বিজয়ী হয়ে সরকার গঠন করতে হবে। তাই সরকার বা উন্নয়নের কাজকে গুরুত্ব দিতে গিয়ে দলের পরিচর্যায় ঘাটতি হতে দেওয়া যাবে না। পণ্ডিত নেহরুর দলের বর্তমান পরিণতি দেখেও বুঝতে হবে যে কেবল ক্ষমতানির্ভর হয়ে পড়লে সে দলের পক্ষে ক্ষমতা হারিয়ে ক্ষমতায় ফেরা কঠিন হয়ে পড়ে।

আওয়ামী লীগ যে ইতিহাসের দায়বদ্ধ, সে দায় কেবল খুনিদের বিচার আর উন্নয়নের মাধ্যমে পূরণ হবে না। তাতে মানুষের চেতনার উন্নয়ন একই রকম জরুরি। আর সে কাজ করার মাধ্যম হলো রাজনীতি, হাতিয়ার হলো রাজনৈতিক দল, রূপকার হলো জনগণ বা ভোটার। ক্ষমতায় থেকে সে কথা বিস্মৃত হওয়া যায় না।

আবুল মোমেন কবি, প্রাবন্ধিক ও সাংবাদিক