ট্রাম্প যেভাবে অভিবাসীদের জীবন হুমকিতে ফেলছেন

পেনসিলভানিয়ার বাটলারে সমাবেশে বক্তৃতা দেওয়ার সময় হত্যাচেষ্টার হাত থেকে প্রথম প্রাণে বেঁচে গিয়েছিলেন ট্রাম্প। এর ঠিক দুই মাসের মাথায় দ্বিতীয়বারের মতো হত্যাচেষ্টা থেকে বাঁচলেন তিনি। এবারের ঘটনা ঘটেছে গত রোববার। ঘটনাস্থল ফ্লোরিডার ওয়েস্ট পাম বিচে ট্রাম্পের নিজস্ব গলফ ক্লাব।

প্রথম হত্যাচেষ্টার পর ট্রাম্প জনতার উদ্দেশে বলেছিলেন, ‘তারা শুধু আমার পেছনে লাগেনি, তারা আপনার পেছনেও ধেয়ে আসছে। তবে আমি আমার পথে অবিচল আছি।’

ট্রাম্প ‘তারা’ বলতে যাদেরই বুঝিয়ে থাকুন না কেন, কারোরই আক্রমণ করার অধিকার নেই। গণতন্ত্রে সহিংসতার কোনো স্থান নেই। একই সঙ্গে সহিংসতার হুমকি দেওয়ারও কোনো স্থান নেই।

সহিংসতার হুমকি ছড়ানো প্রসঙ্গে বলতে গিয়ে গত সপ্তাহে ওহাইওর স্প্রিংফিল্ডে অনুষ্ঠিত বিতর্ক অনুষ্ঠানে ট্রাম্পের একটি বিতর্কিত দাবির কথা মনে পড়ল। সেখানে তিনি দাবি করেছেন, ‘হাইতি থেকে যুক্তরাষ্ট্রে আসা অভিবাসীরা কুকুর খেয়ে ফেলছেন...বিড়াল খেয়ে ফেলছেন। তাঁরা যেখানে থাকেন, সেখানকার বাসিন্দাদের পোষা কুকুর-বিড়ালসহ সব পোষ্য প্রাণী ধরে ধরে খেয়ে ফেলছেন।’

ট্রাম্পের এই বক্তব্যের পর ইন্টারনেটে নানা ধরনের হাস্যকৌতুক চলছে। এই নিয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে হাজার হাজার হাস্যকর মিম ও প্যারোডি গান ভেসে বেড়াচ্ছে।

কিন্তু এটি কোনো হাসির বিষয় নয়। কারণ, ট্রাম্প হাইতি থেকে আসা অভিবাসীদের বিরুদ্ধে যে অভিযোগ তুলেছেন, তা ইতিমধ্যেই ওই অভিবাসীদের সহিংসতার মুখে ফেলে দিয়েছে।

পুলিশ জানাচ্ছে, গত সপ্তাহান্তে স্প্রিংফিল্ডের দুটি হাসপাতালে বোমা বিস্ফোরণ হতে পারে, এমন খবর আসে। এরপর হাসপাতাল দুটি সাময়িকভাবে বন্ধ করে দেওয়া হয়।
আরও কয়েকটি হুমকির পরিপ্রেক্ষিতে স্প্রিংফিল্ডের কর্মকর্তারা কয়েকটি সরকারি ভবন বন্ধ করতে বাধ্য হয়েছেন। ট্রাম্প–সমর্থকদের বোমা হামলার হুমকির পর সেখানে দুটি প্রাথমিক বিদ্যালয় খালি করে দ্রুত শিক্ষার্থীদের অন্যত্র পাঠিয়ে দেওয়া হয়। একটি মাধ্যমিক বিদ্যালয় সম্পূর্ণভাবে বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে।

রিপাবলিকান পার্টির মনোনীত ভাইস প্রেসিডেন্ট প্রার্থী জেডি ভ্যান্স প্রথমে স্প্রিংফিল্ডে হাইতিয়ানদের সম্পর্কে ভিত্তিহীন গুজব ছড়ানো শুরু করেন। তাঁর হাইতিয়ান–বিদ্বেষী কথাবার্তার পর ‘ব্লাড ট্রাইব’ নামের একটি নব্য–নাৎসি গ্রুপের সদস্যরা যুদ্ধক্ষেত্রের বর্ম পরে, বন্দুক হাতে নিয়ে নব্য–নাৎসি পতাকা বহন করে শহরে মিছিল করেন।

গত ২৭ আগস্ট স্প্রিংফিল্ডের টাউন হল মিটিংয়ে রিপাবলিকান পার্টির একজন নেতা দাবি করেছেন, শহরটি ‘অধঃপতিত তৃতীয় বিশ্বের’ লোকেরা দখল করেছেন। তিনি অনুপ্রবেশের জন্য ইহুদি লোকদের দায়ী করেছেন এবং লোকদের সতর্ক করে বলেছেন, ‘আপনি যত হাইতিয়ানকে এখানে আসার অনুমতি দেবেন, তত অপরাধ ও বর্বরতা বাড়বে।’

স্প্রিংফিল্ডের হাইতিয়ান অভিবাসীরা বলছেন, তাঁরা ভয় পাচ্ছেন। কেউ কেউ স্থানীয় ব্যক্তিদের আক্রমণের ভয়ে তাঁদের সন্তানদের স্কুলে না পাঠিয়ে ঘরবন্দী করে রেখেছেন। অনেকে রাস্তায়, গাড়িতে বা দোকানপাটে হয়রানির শিকার হচ্ছেন বলে অভিযোগ করছেন।

স্প্রিংফিল্ডে গত বছর একজন হাইতিয়ান অভিবাসীর গাড়ি একটি স্কুলবাসে ধাক্কা লাগার পর একজন স্কুলছাত্র মারা গিয়েছিল। ওই শিশুর বাবা–মা ট্রাম্প ও ভ্যান্সের প্রতি আবেদন জানিয়েছেন, যেন তাঁরা তাঁদের মৃত ছেলেকে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে ব্যবহার করা বন্ধ করেন।

কিন্তু ট্রাম্প ও ভ্যান্স থামছেন না। তাঁরা দ্বিগুণ বেগে ঘৃণা ছড়ানো বক্তব্য দিয়ে যাচ্ছেন। গত রোববার ট্রাম্পের জীবননাশের চেষ্টার আগে ভ্যান্স সিএনএনকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, ‘হাইতিয়ানরা যে স্প্রিংফিল্ডের বাসিন্দাদের পোষা প্রাণী ধরে খেয়ে ফেলেন, সেই দাবি আমার ভোটারদের কাছ থেকেই প্রথম এসেছে।’

সাক্ষাৎকার গ্রহণকারী ডানা বাশ যখন তাঁকে মনে করিয়ে দিচ্ছিলেন, এসব দাবি বোমার হুমকির কারণ হয়েছিল, তখন বিরক্ত হয়ে ভ্যান্স তাঁকে ‘ডেমোক্র্যাটদের প্রচারক’ বলে আখ্যায়িত করে বসেন। তবে সত্যটা হলো, আসলেই তাঁদের এই দাবির সঙ্গে বোমা হুমকির যোগসূত্র আছে।

ট্রাম্প বা ভ্যান্সের বিষয়ে নেতিবাচক মন্তব্য করার বদলে আসুন, তাঁদের দাবিগুলো পর্যালোচনা করে দেখি। বিতর্কের আগে ট্রাম্প তাঁর নিজের সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ট্রুথ সোশ্যালে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার সহায়তায় বানানো দুটি ছবি পোস্ট করেছিলেন।
একটি ছবিতে দেখা যাচ্ছে, একটি বিড়াল সামরিক পোশাক পরে হাতে একটি অ্যাসল্ট রাইফেল ধরে আছে। বিড়ালটির মাথায় ট্রাম্পের স্লোগান ‘মাগা’ (‘মেক আমেরিকা গ্রেট এগেইন’ স্লোগানের সংক্ষিপ্ত রূপ) লেখা একটি টুপি।

অন্য ছবিতে দেখা যাচ্ছে, ট্রাম্প একটি বিমানের ভেতরে বসে আছেন; তাঁকে বিড়াল ও হাঁস ঘিরে আছে।

ট্রাম্প এখন স্প্রিংফিল্ডে সমাবেশ করবেন বলে ঘোষণা দিয়েছেন। গত শুক্রবার এক সংবাদ সম্মেলনে ট্রাম্প বলেছেন, ‘আমরা এই লোকগুলোকে বের করে দেব।’

স্প্রিংফিল্ডে যে হাইতিয়ান অভিবাসীরা থাকেন, তাঁদের বৈধ নাগরিকত্ব থাকার পরও ট্রাম্প তাঁদের ব্যাপারে বলেছেন, তিনি পুনরায় নির্বাচিত হলে তাঁদের বের করে দেবেন। তিনি বলেছেন, ‘আমাদের দেশের ইতিহাসে সবচেয়ে বড় নির্বাসন মঞ্চস্থ করা হবে।’
এই অভিবাসীদের বিষয়ে ট্রাম্প ও ভ্যান্স যে অভিযোগ করেছেন, তা সম্পূর্ণ ভুয়া। ওহাইওর রিপাবলিকান গভর্নর মাইক ডিওয়াইন গত বুধবার সিবিএস নিউজকে বলেছেন, ‘এখানে প্রচুর কাজ ছিল বলে এই হাইতিয়ানরা এখানে কাজ করতে এসেছিলেন এবং তাঁরা প্রচুর শূন্য কর্মস্থল পূরণ করেছেন। আপনি যদি নিয়োগকারীদের সঙ্গে কথা বলেন তাহলে জানতে পারবেন, তাঁরা খুব, খুব ভালো কাজ করেন; তাঁরা খুব, খুব কঠোর পরিশ্রম করেন।’

ট্রাম্পের আরেকটি ভুয়া দাবি এখন কলোরাডোর অরোরা এলাকায় বৈধ অভিবাসীদের হুমকিতে ফেলেছে। ট্রাম্প বলেছেন, এলাকাটি ভেনেজুয়েলা থেকে আসা অপরাধীরা ‘দখল’ করছেন।

অরোরার রিপাবলিকান পার্টির মেয়র ও সিটি কাউন্সিলের সদস্যরা এক যৌথ বিবৃতিতে বলেছেন, ট্রাম্পের এই দাবি মোটেও সত্য নয়।

ট্রাম্পের ভিত্তিহীন এই দাবি স্প্রিংফিল্ডের মতো অরোরার নিরীহ লোকদের জন্যও সর্বনাশ ডেকে আনছে। সেখানকার অভিবাসীরা বলছেন, তাঁদের অনেকে এসে বলছেন, তাঁদের জাতীয়তা চাকরি পাওয়া বা বসবাসের অনুমতি পাওয়ার অযোগ্য করে তুলছে। ট্রাম্পের দাবিগুলো পরিস্থিতিকে হুমকির দিকে নিয়ে যাচ্ছে এবং জাতীয়তাবাদী সশস্ত্র গ্রুপগুলোকে শহরে অভিবাসনবিরোধী সহিংসতা ছড়াতে উসকানি দিচ্ছে।

ট্রাম্প ও ভ্যান্স প্রাচীনতম কুৎসিত চাল দিচ্ছেন। তাঁরা সমাজের মধ্যে ‘আমরা’ ও ‘অন্যরা’ তৈরি করে বিভেদ সৃষ্টি করছেন। তিনি ‘অন্যরা’ শব্দটি অভিবাসীদের ক্ষেত্রে এমনভাবে ব্যবহার করছেন, যাতে তাঁদের অমানবিক মনে হয়। তিনি তাঁদের শহর দখলকারী ও প্রিয়জনকে গ্রাসকারী হিসেবে দেখাতে চাচ্ছেন।

স্প্রিংফিল্ডের মানুষের কাছে তাঁদের পোষা প্রাণী প্রিয়জনের মতো। কিন্তু সেখানকার ইহুদিরা শিশুদের গিলে খাচ্ছে—এই ভয়ংকর নাৎসি দাবি তো ভুয়া দাবি থেকেও অনেক দূরে। স্প্রিংফিল্ডে ‘হাইতিয়ানদের’ কিংবা অরোরাতে ‘ভেনেজুয়েলানদের’ জায়গায় ‘ইহুদি’ শব্দটি প্রতিস্থাপন করুন। দেখবেন, আপনি ১৯৩০ দশকের নাৎসিদের কাছে ফিরে গেছেন।

অভিবাসীদের শয়তান ও অমানবিক হিসেবে তুলে ধরার মাধ্যমে ট্রাম্প ও ভ্যান্স শুধু দেশজুড়ে কিছু দোদুল্যমান ভোটারদের মন জয় করতে চাইছেন তা নয়, এর মধ্য দিয়ে তাঁরা আমেরিকাকে আরও ভয়ংকর ও আরও বর্ণবাদী জাতিতে পরিণত করার চেষ্টা করছেন।

আট মাস আগে নিউ হ্যাম্পশায়ারে একটি সমাবেশে ট্রাম্প অভিবাসীদের সম্পর্কে বলেছিলেন, ‘তাঁরা আমাদের দেশের রক্ত দূষিত করছে।’ তাঁর এই কথা মূলত অ্যাডলফ হিটলারের উদ্ধৃতি থেকে নেওয়া।

প্রচারাভিযানে জয়লাভ করার শেষ চেষ্টা হিসেবে ট্রাম্প ও ভ্যান্স অভিবাসী–বিদ্বেষীদের আরও সহিংস হয়ে ওঠার জন্য তাগিদ দিয়ে যাচ্ছেন। ১০ সেপ্টেম্বর ভ্যান্স তাঁর সমর্থকদের বিড়ালের মিমগুলোকে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে আরও বেশি করে পোস্ট করতে বলেছেন। মজার ব্যাপার হলো, তাঁরা তাঁদের নিজেদের দেশের মানুষকে বিপন্ন করে বিড়াল রক্ষায় প্রচারণা চালাচ্ছেন।

আমি আবার বলছি, আমাদের গণতন্ত্রে সহিংসতা বা সহিংসতার হুমকির কোনো জায়গা নেই। ট্রাম্পের ওপর গত রোববার দ্বিতীয়বার যে হত্যাচেষ্টা হয়েছে, সম্পূর্ণরূপে ঘৃণ্য। এটি স্বীকার করে নিয়েই বলছি, এটি সেই ঘৃণাভরা রাজনীতির একটি উপসর্গ, যা ট্রাম্প ও ভ্যান্স উগরে দিচ্ছেন।

  • রবার্ট রাইশ যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক শ্রমমন্ত্রী ও ইউনিভার্সিটি অব ক্যালিফোর্নিয়া বার্কলের পাবলিক পলিসির অধ্যাপক

দ্য গার্ডিয়ান থেকে নেওয়া, অনুবাদ: সারফুদ্দিন আহমেদ