তৃণমূলে যে বিবাদ ছড়িয়ে পড়ছে, সেই তিক্ততা কি মুছবে সহজে

দেশের সবচেয়ে বড় দুটি রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগ ও বিএনপিতে অভ্যন্তরীণ কোন্দল কেন্দ্র থেকে তৃণমূল পর্যন্ত বিস্তৃত। দলের যেকোনো পর্যায়ের কমিটি গঠনের সময় সেই সুপ্ত কোন্দলের প্রকাশ্য রূপ দেখা যায়।

একই দলের সমর্থকেরা তখন পরস্পরের বিরুদ্ধে সর্বশক্তি নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েন। এ লড়াই যে প্রাণঘাতীও হয়ে উঠতে পারে, এ রকম অসংখ্য উদাহরণও আমাদের সামনে আছে। কেন্দ্র থেকে বারবার হুমকিধমকি দিয়ে, এমনকি দায়ী ব্যক্তিদের বহিষ্কার বা অব্যাহতি দিয়েও সেই বিরোধের মীমাংসা করা যায় না।

জাতীয় পার্টি তার প্রয়াত চেয়ারম্যানের সকাল-বিকাল ভোল পাল্টানোর চরিত্র থেকে যে এখনো বেরিয়ে আসতে পারেনি এবং ওপর-নিচ সব স্তরেই এ নিয়ে যে দ্বিধাবিভক্তি আছে, তা সাম্প্রতিক নির্বাচনে অংশ নেওয়া বা না নেওয়ার হেলদোলের মধ্যেই প্রকাশিত।

এদিক দিয়ে সুবিধাজনক অবস্থানে আছে ছোট দলগুলো। তাদের তৃণমূল বলে কোনো ব্যাপার নেই, এ নিয়ে বিশেষ মাথাব্যথাও নেই। বরং ছোট দলের ‘বড়’ নেতারা নিজেরাই দ্বন্দ্বে জড়িয়ে দলকে আরও সংক্ষিপ্ত সংস্করণে পরিণত করতে কুণ্ঠাহীন।

বিরোধী দল বিএনপি ও সমমনা দলগুলোর নির্বাচন বর্জনের মধ্যেও নির্বাচনকে ‘অংশগ্রহণমূলক’ করার একটি কার্যকর (?) উদ্যোগ এবার নিয়েছে সরকারি দল আওয়ামী লীগ।

জাতীয় পার্টিকে অধীনতামূলক মিত্রতা নীতিতে কাছে টেনে; তৃণমূল বিএনপি, বিএনএম প্রভৃতি নানা নামের তথাকথিত কিংস পার্টিকে মাঠে নামিয়েও যেখানে ভোটকেন্দ্রের সামনে ভোটারদের উপস্থিতির সম্ভাবনা দেখা যাচ্ছিল না; তখন নিজেদের দলের লোকজনকে স্বতন্ত্র পরিচয়ে নিজেদেরই প্রার্থীর বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে যাওয়ার ‘অধিকার’ দিয়ে মাঠ গরম করার একটি অভিনব ফর্মুলা উদ্ভাবন করেছে তারা।

এখন প্রার্থীদের পরস্পরের বিরুদ্ধে বিষোদ্গার, নির্বাচনী ক্যাম্প ভাংচুর, গাড়িবহরে হামলা, সমর্থকদের মারধর প্রভৃতি এই দেশের ভোট উত্সবের চিরাচরিত দৃশ্যাবলি দেখে কে বলবে যে নির্বাচন অংশগ্রহণমূলক নয়! প্রতিপক্ষহীন মাঠে দুই দলে ভাগ হয়ে খেলার এই নতুন কৌশলের জন্য ২০২৪ সালের ৭ জানুয়ারি হয়তো এ দেশের নির্বাচনের ইতিহাসে স্মরণীয় হয়ে থাকবে।

আসন্ন নির্বাচনে ২৬৩ আসনে প্রার্থী দিয়েছে আওয়ামী লীগ। সেখানে অন্তত শতাধিক আসনে স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়েছেন দলীয় নেতারা। জয়-পরাজয়ের লড়াইয়ে এসব এলাকায় দ্বিধাবিভক্ত হয়ে পড়বেন সমর্থকেরা। বিবাদ, সংঘর্ষে জড়াবেন তাঁরা। সেই তিক্ততা কি মুছবে সহজে? অন্যের যাত্রা ভঙ্গ করার জন্য নিজের নাক কাটার যে ঝুঁকি নিল আওয়ামী লীগ, সাংগঠনিকভাবে জেলা, উপজেলা, গ্রাম সর্বত্র তার খেসারত দিতে হবে না তাকে?

সন্দেহ নেই, দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনে অংশ না নিতে অনড় দেশের অধিকাংশ রাজনৈতিক দলকে বেশ একটা ভেলকি দেখানো গেল। কিন্তু এতেও শেষ রক্ষা হলো কি না, সেটা এখন ভেবে দেখতে হবে সরকারি দলকে।

আগেই বলেছি, বড় দুই দলের অন্তর্কোন্দল তৃণমূল পর্যন্ত বিস্তৃত। এখন শক্তির পরীক্ষায় নামিয়ে সেই বিভক্তিকে দীর্ঘস্থায়ী রূপ দিল আওয়ামী লীগ। প্রতীক বরাদ্দের পর থেকে শুরু হয়েছে বিভিন্ন এলাকায় আওয়ামী লীগের নৌকা প্রতীক বনাম আওয়ামী লীগ স্বতন্ত্রের লড়াই। এই লড়াই থামানোর ইচ্ছা আদৌ হাইকমান্ডের আছে কি না জানি না, তবে নৈতিক জোর যে নেই, তা তো স্পষ্ট।

দৈবচয়ন পদ্ধতিতে দু–একটি উদাহরণ এখানে বাহুল্য মনে হবে না। গত শুক্রবার গাজীপুর-৩ আসনের স্বতন্ত্র প্রার্থী মুহাম্মদ ইকবাল হোসেনের পাঁচটি পথসভায় হামলার ঘটনা ঘটেছে। আওয়ামী লীগ মনোনীত নৌকা প্রতীকের প্রার্থীর সমর্থকেরা হামলা করেছেন তাঁর পথসভায়।

নিয়তির পরিহাস, ইকবাল হোসেন হচ্ছেন গাজীপুর জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও বর্তমান সংসদ সদস্য। অর্থাৎ জেলা পর্যায়ে যে দলকে তিনি এত দিন নেতৃত্ব দিয়েছেন এবং যে প্রতীকে নির্বাচন করে হয়েছেন সংসদ সদস্য, এখন সেই দল ও প্রতীকের কর্মীরা তাঁকে আক্রমণ করতে দ্বিধা করছেন না। নির্বাচনে তিনি জয়ী বা পরাজিত যা–ই হোন, দলীয় শৃঙ্খলার কী হবে?

চট্টগ্রাম-১২ আসনের সংসদ সদস্য ও হুইপ শামসুল হক চৌধুরী এবার দলীয় মনোনয়ন না পেয়ে স্বতন্ত্র হিসেবে নির্বাচন করছেন।

এত দিন এলাকায় যাঁর ছিল একচ্ছত্র আধিপত্য, দলের নেতৃত্ব যাঁর হাতে ছিল, উন্নয়ন কাজের কৃতিত্ব যাঁর ঝুলিতে জমা হতো, সেই শামসুল হক চৌধুরীকে এখন অসহায় মনে হচ্ছে তাঁরই দলীয় কর্মীদের সামনে।

নৌকা প্রতীকের লোকজনের হাতে ইতিমধ্যেই বেশ কয়েক দফা হামলার শিকার হয়েছেন তিনি ও তাঁর সমর্থকেরা।

কক্সবাজার-১ আসনে দলীয় মনোনয়ন পাননি বর্তমান সংসদ সদস্য জাফর আলম। সম্প্রতি দলীয় প্রধান শেখ হাসিনার ‘সমালোচনা’ করায় তাঁকে চকরিয়া উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি পদ থেকে অব্যাহতি দিয়েছে জেলা আওয়ামী লীগ।

কথা হচ্ছে, যিনি দলের বিরুদ্ধে নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করবেন, তিনি মন খুলে সেই দলের নেতৃত্বের সমালোচনা করতে না পারলে তো প্রতিদ্বন্দ্বিতা জমে না। আবার দলীয় প্রধানের সমালোচনা করলে শৃঙ্খলা রক্ষা হয় না। এখন এই উভয় সংকট থেকে মুক্তির উপায় কী?

নির্বাচনী প্রচারণার শুরু থেকেই উত্তপ্ত চট্টগ্রামের সাতকানিয়া-লোহাগাড়া (চট্টগ্রাম-১৫) আসন। বর্তমান সংসদ সদস্য ও আওয়ামী লীগের দলীয় প্রার্থী আবু রেজা মুহাম্মদ নদভী এলাকায় কতটা ক্ষমতাবান, তাঁর স্ত্রী প্রয়াত জামায়াত নেতা মমিনুল হকের কন্যা রিজিয়া বেগমকে মহিলা আওয়ামী লীগ কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য ও শ্যালক রুহুল্লাহ চৌধুরীকে ইউপি চেয়ারম্যান বানিয়ে তার প্রমাণ তিনি দিয়েছিলেন।

কিন্তু সম্প্রতি এলাকায় স্বতন্ত্র প্রার্থীর সমর্থকেরা তাঁর স্ত্রী, শ্যালকসহ ২০ জনের ওপর আক্রমণ করে বুঝিয়ে দিলেন, ‘বিনা যুদ্ধে নাহি দিব সুচাগ্র মেদিনী’।

নদভীর বিরুদ্ধে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন এম এ মোতালেব। তিনি আওয়ামী লীগের পদত্যাগী উপজেলা চেয়ারম্যান। এলাকার সাধারণ মানুষ তো বটেই, আওয়ামী লীগের কর্মী-সমর্থকেরাও ভাবছেন, ফলাফল যা-ই হোক, নির্বাচনের পরও দলীয় কোন্দল ও সহিংসতা কি আদৌ থামবে?

আসন্ন নির্বাচনে ২৬৩ আসনে প্রার্থী দিয়েছে আওয়ামী লীগ। সেখানে অন্তত শতাধিক আসনে স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়েছেন দলীয় নেতারা। জয়-পরাজয়ের লড়াইয়ে এসব এলাকায় দ্বিধাবিভক্ত হয়ে পড়বেন সমর্থকেরা। বিবাদ, সংঘর্ষে জড়াবেন তাঁরা। সেই তিক্ততা কি মুছবে সহজে? অন্যের যাত্রা ভঙ্গ করার জন্য নিজের নাক কাটার যে ঝুঁকি নিল আওয়ামী লীগ, সাংগঠনিকভাবে জেলা, উপজেলা, গ্রাম সর্বত্র তার খেসারত দিতে হবে না তাকে?

  • বিশ্বজিৎ চৌধুরী প্রথম আলোর যুগ্ম সম্পাদক, কবি ও সাহিত্যিক