ভারত তাদের আইনসভাগুলোয় ৩৩ শতাংশ আসন নারীদের জন্য সংরক্ষণ করতে সংবিধান সংশোধন করেছে। এ–সংক্রান্ত বিলটি ২০ সেপ্টেম্বর লোকসভায় ও ২১ সেপ্টেম্বর রাজ্যসভায় পাস হয়। লোকসভায় দুজন সদস্য এর বিরোধিতা করলেও রাজ্যসভায় পাস হয় সর্বসম্মতিক্রমে। সংশোধনীতে বলা হয়েছে, লোকসভা, রাজ্যগুলোর বিধানসভা এবং দিল্লির বিধানসভায় এক-তৃতীয়াংশ আসন নারীদের জন্য সংরক্ষিত থাকবে। অর্থাৎ ৫৪৩টি লোকসভা আসনের মধ্যে ১৮১টি নারীদের জন্য সংরক্ষিত থাকবে।
ভারতে ৯৫ কোটি নিবন্ধিত ভোটারের প্রায় অর্ধেক নারী। বর্তমানে লোকসভা ও রাজ্যসভায় মাত্র ১৫ শতাংশ এবং রাজ্যের বিধানসভাগুলোয় মাত্র ১০ শতাংশ নারী আইনপ্রণেতা রয়েছেন। উল্লেখ্য, ভারতে নারীদের জন্য এক-তৃতীয়াংশ আসনসংক্রান্ত বিল প্রথমে পার্লামেন্টে উত্থাপিত হয় ১৯৯৬ সালে। ২০১০ সালে রাজ্যসভায় সেটি পাসও হয়েছিল। কিন্তু লোকসভায় আটকে যায়। এ প্রেক্ষাপটে কংগ্রেস নেত্রী সোনিয়া গান্ধী বলেছেন, ‘সংরক্ষণ বিল, সেটা তো আমাদেরই।’
জাতীয় সংসদের সাধারণ আসনে নির্বাচিত সংসদ সদস্যদের নির্দিষ্ট নির্বাচনী এলাকা আছে। নারী সদস্যদের কার্যত তা নেই। এ কারণে সাধারণ আসনে নির্বাচিত সদস্যের সঙ্গে নারী আসনের নির্বাচিত সদস্যের দ্বন্দ্ব তৈরি হয়। স্থানীয় প্রশাসন সাধারণত পুরুষ সদস্যের কথা শোনে, নারী সদস্যকে আমলে নেয় না।
মাস কয়েক আগে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিকে কটাক্ষ করার জের ধরে কংগ্রেস নেতা রাহুল গান্ধী লোকসভার সদস্য পদ হারিয়েছিলেন। আগস্ট মাসে সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশে আবার ফিরেও পান। এ নিয়ে বিজেপি ও কংগ্রেসের মধ্যে পার্লামেন্টের ভেতরে ও রাজনীতির মঞ্চে তুমুল বাগ্বিতণ্ডা হয়। আগামী লোকসভা নির্বাচনে বিজেপিকে ঠেকাতে কংগ্রেসের নেতৃত্বে ‘ইন্ডিয়া’ জোট গঠিত হয়েছে। রাজ্য বিধানসভাগুলোতেও তারা একজোট হয়ে নির্বাচন করছে। এসব সত্ত্বেও বিজেপি যখন পার্লামেন্টে সংরক্ষিত নারী আসন বিলটি আনল, কংগ্রেস বা অন্যান্য বিরোধী দল বাধা দেয়নি। সমর্থন করেছে।
কংগ্রেসের সাধারণ সম্পাদক জয়রাম রমেশ প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিকে পাঠানো রাহুল গান্ধীর ২০১৮ সালের একটি চিঠি এক্স প্ল্যাটফর্মে শেয়ার করেছেন। রাহুল লিখেছিলেন, ‘দলীয় রাজনীতির ঊর্ধ্বে উঠে এবার প্রধানমন্ত্রীর উচিত পার্লামেন্টে নারী সংরক্ষণ বিলকে পাস করানো। কংগ্রেস নিঃশর্তে সমর্থন করবে।’
একাদশ জাতীয় সংসদের শেষ অধিবেশনটি বসবে অক্টোবরে। আওয়ামী লীগ সরকার কি সেই অধিবেশনে ১৫ বছর আগে দেওয়া প্রতিশ্রুতিটি রক্ষা করবে? যদি করে, তাহলে দেশবাসী ভাববে, সরকার নারীর ক্ষমতায়নের কথা শুধু মুখে বলে না, অন্তরেও বিশ্বাস করে। আর যদি না করে তারা মনে করবে, সরকার যা বলে তা করে না, যা করে তা বলে না।
এটাই হলো গণতন্ত্র। যেখানে সরকারের বিরোধিতা করার, সেখানে বিরোধী দল বিরোধিতা করছে। আবার যেখানে সমর্থন করার, সেখানে সমর্থন করছে। কিন্তু বাংলাদেশে সরকার ও বিরোধী দল—কোনো বিষয়েই একমত হতে পারে না। এটা অভ্যন্তরীণ রাজনীতির ক্ষেত্রে যেমন সত্য, তেমনি বিদেশ নীতির বেলায়ও। ২০০১ সালে ক্ষমতায় এসে বিএনপি সরকার মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয় গঠন করে। তখনকার বিরোধী দল আওয়ামী লীগ সেই সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানাতে পারেনি। আবার আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে সমুদ্র জয় হলে বিএনপি প্রধানমন্ত্রীকে ‘ধন্যবাদ’ জানিয়েও পরে তা প্রত্যাহার করে নিয়েছিল।
দুই দলই নিজেদের সংসদীয় গণতন্ত্রের প্রবক্তা বলে দাবি করে, কিন্তু সমস্যা সমাধানের উপায় হিসেবে বরাবর বেছে নিয়েছে রাজপথকে। বাংলাদেশে একবারই সরকারি ও বিরোধী দল ঐকমত্যে পৌঁছাতে পেরেছিল—১৯৯১ সালে দ্বাদশ সংশোধনী পাসের সময়। অর্থাৎ রাষ্ট্রপতি শাসনপদ্ধতি থেকে দেশ সংসদীয় শাসনপদ্ধতিতে ফিরে আসে। কিন্তু কোনো দলই সংসদকে রাজনীতির কেন্দ্রবিন্দু করেনি।
২০০৮ সালের নির্বাচনী ইশতেহারের ১২.২ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছিল, ‘জাতীয় সংসদের সংরক্ষিত মহিলা আসনের সংখ্যা ৩৩ শতাংশে উন্নীত করা হবে।’ এখন ২০২৩ সাল। কিন্তু সংরক্ষিত নারী আসনের বিষয়ে তারা সাহসী কোনো পদক্ষেপ নিতে পারেনি। বিএনপি নারীর সংরক্ষিত আসন নির্ধারণ করেছিল ৪৫টি। আওয়ামী লীগ তা ৫০–এ উন্নীত করে। এ ক্ষেত্রে বিএনপির আইনটি ছিল অপেক্ষাকৃত গণতান্ত্রিক। তারা আনুপাতিক হারে নারী সংসদ সদস্য নির্বাচনের ব্যবস্থা করে। আগে কেবল ক্ষমতাসীন দল থেকেই সংরক্ষিত আসনের সদস্যরা আসতেন।
৩০০ আসনের সংসদে সরাসরি ভোটে নির্বাচিত হয়েছেন ২২ জন নারী। আর সংরক্ষিত আসনে ৫০ জন। সব মিলিয়ে ২০.৭ শতাংশ।
মহিলা পরিষদসহ নারী সংগঠনগুলো দীর্ঘদিন ধরেই নারী আসনের সংখ্যা এক-তৃতীয়াংশ করার পাশাপাশি সরাসরি ভোটের দাবি জানিয়ে আসছে। ১৯৫৪ সালে পূর্ববঙ্গ প্রাদেশিক পরিষদের নির্বাচনে নারীরা সরাসরি ভোটে নির্বাচিত হয়েছিলেন। একুশ শতকে এসে নির্বাচিত হচ্ছেন পরোক্ষ ভোটে। নারী সংগঠনগুলো একাধিক বিকল্প প্রস্তাবও দিয়েছে। একটি হলো, ৩০০ আসনের মধ্যে পর্যায়ক্রমে ১০০ আসন নারীদের জন্য সংরক্ষিত রাখা। সেখানে কেবল নারীরাই প্রার্থী হবেন। আরেকটি বিকল্প হলো ১০০ আসনে রাজনৈতিক দলগুলো নারী প্রার্থীদেরই মনোনয়ন দেবে।
নারী সংগঠনগুলোর এ দাবি গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশের (আরপিও) সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ। ২০০৮ সালে গণপ্রতিনিধিত্ব আইনের সংশোধনীতে রাজনৈতিক দলগুলোর জন্য ২০২০ সালের মধ্যে সর্বস্তরে ৩৩ শতাংশ নারীর অংশগ্রহণের যে বাধ্যবাধকতা ছিল, কোনো দলই এই শর্ত পূরণ করতে পারেনি। তারা মুখে নারীর ক্ষমতায়নের কথা বলে, বাস্তবে বিপক্ষেই কাজ করে।
আমাদের সংবিধানের ২৮ অনুচ্ছেদের ২ উপধারায় আছে, ‘রাষ্ট্র ও জনজীবনের সর্বস্তরে নারী পুরুষের সমানাধিকার লাভ করিবেন।’ দেশের জনসংখ্যার অর্ধেক নারী। রাজনৈতিক দল, রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানে তাঁদের অংশীদারত্ব ৫০: ৫০ হওয়ার কথা। কিন্তু বাস্তবতা হলো সব রাজনৈতিক দলের জেলা-উপজেলা পর্যায়ের কমিটিগুলো প্রায় পুরোটাই পুরুষ নিয়ন্ত্রিত। ‘ক’ দলের মাস্তান ঠেকাতে ‘খ’ দলকেও মাস্তান পুষতে হয়। রাজনৈতিক দলে নারীর অংশগ্রহণ বাড়লে রাজনৈতিক মাস্তানি ও হানাহানি অনেকাংশে কমে যাবে।
স্থানীয় সরকারে এক-তৃতীয়াংশ নারী সদস্য রাখার কথাটি রাজনৈতিক নেতৃত্ব ঢাকঢোল পিটিয়ে প্রচার করে থাকেন। কিন্তু নারী জনপ্রতিনিধি নির্বাচনের কাঠামোটাই এমনভাবে করা হয়েছে, যাতে তাঁরা নির্বাচিত হলেও ক্ষমতায়ন থেকে বঞ্চিত হন।
এ ক্ষেত্রে নেপালের দৃষ্টান্ত আমরা অনুসরণ করতে পারি। সেখানে নির্বাচিত সংস্থার প্রধান নারী হলে, উপপ্রধান পদে একজন পুরুষ থাকেন। আবার প্রধান পুরুষ হলে উপপ্রধান পদে নারী আসেন। নেপালের পার্লামেন্টের নিম্নকক্ষে ৩২.৭ শতাংশ এবং উচ্চকক্ষে ৩৭.৯ শতাংশ নারী। নতুন আইন বাস্তবায়নের পর ভারতের পার্লামেন্টেও নারীর প্রতিনিধিত্ব বেড়ে যাবে।
জাতীয় সংসদের সাধারণ আসনে নির্বাচিত সংসদ সদস্যদের নির্দিষ্ট নির্বাচনী এলাকা আছে। নারী সদস্যদের কার্যত তা নেই। এ কারণে সাধারণ আসনে নির্বাচিত সদস্যের সঙ্গে নারী আসনের নির্বাচিত সদস্যের দ্বন্দ্ব তৈরি হয়। স্থানীয় প্রশাসন সাধারণত পুরুষ সদস্যের কথা শোনে, নারী সদস্যকে আমলে নেয় না।
গত তিন দশকের বেশি সময় ধরে জাতীয় সংসদের প্রধান নারী। বিরোধী দলের নেতাও নারী। বর্তমান ও আগের সংসদের স্পিকারের পদও অলংকৃত করে আছেন নারী। তারপরও জাতীয় সংসদে নারীর আসন বাড়ছে না কেন?
একাদশ জাতীয় সংসদের শেষ অধিবেশনটি বসবে অক্টোবরে। আওয়ামী লীগ সরকার কি সেই অধিবেশনে ১৫ বছর আগে দেওয়া প্রতিশ্রুতিটি রক্ষা করবে? যদি করে, তাহলে দেশবাসী ভাববে, সরকার নারীর ক্ষমতায়নের কথা শুধু মুখে বলে না, অন্তরেও বিশ্বাস করে। আর যদি না করে তারা মনে করবে, সরকার যা বলে তা করে না, যা করে তা বলে না।
● সোহরাব হাসান প্রথম আলোর যুগ্ম সম্পাদক ও কবি
sohrabhassan55@gmail.com