চিঠিপত্র

ঘোড়ায় টানা টমটম: ঐতিহ্যের নামে প্রাণী নির্যাতন বন্ধ করুন

ভিড় ও যানজটের মধ্য দিয়ে চাবুক মেরে ঘোড়াগুলোকে গাড়ি টানতে বাধ্য করা হয়। কখনো ভেবে দেখেছেন, দুটো ছোট্ট প্রাণী কতটা ভার সহ্য করতে পারে?
ফাইল ছবি

আমরা রূপকথার গল্পে পক্ষীরাজ ঘোড়ার কাহিনি পড়েছি। শুনেছি রাজপুত্রের টগবগিয়ে চলা তেজি ঘোড়ার গল্পকথা। দেখেছি, ঠাকুমার ঝুলিতে রাজার রাজসিক ঘোড়ার গাড়ি। আগের দিনের রাজা-বাদশাহ এই ঘোড়ার গাড়িতে করে এক স্থান থেকে অন্য স্থানে যাতায়াত করতেন। এটি ছিল তাঁদের ঐতিহ্য। তবে বর্তমান এই জ্যামের শহরে যান্ত্রিক বাহনের ভিড়ে অযান্ত্রিক বাহন হিসেবে ঘোড়ার গাড়ি মানানসই লাগে না। ইতিহাসবিদদের মতে, ঢাকায় ঘোড়ার গাড়ির প্রচলন শুরু হয় ১৮৩০ সালে নবাবি শাসনামলে। নবাবেরা রাজকীয় ভ্রমণে ঘোড়ার গাড়ি ব্যবহার করতেন। আবার গবেষকদের একাংশ মনে করেন, ঢাকায় বসবাসরত আর্মেনীয়রা ১৮৫৬ সালে প্রথম এটি চালু করে। বিভিন্ন রকমের খাবার, ইতিহাস ও ঐতিহ্যের ধারক হিসেবে খ্যাত পুরান ঢাকায় প্রায় ২০০ বছর ধরে বহাল রয়েছে স্থানীয়ভাবে টমটম নামে পরিচিত এই ঘোড়ার গাড়ি।

ঢাকার গুলিস্তান থেকে সদরঘাট যাওয়ার পথে প্রতিদিন চোখে পড়ে চার চাকাবিশিষ্ট টমটম গাড়ি। এ ছাড়া বাংলাবাজার, লক্ষ্মীবাজার, সিদ্দিকবাজার, নারিন্দা ইত্যাদি স্থানেও প্রতিদিন ৩০-৪০টি গাড়ি সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত চলাচল করে। একটি বড় গাড়িতে ১২ থেকে ১৪ জন মানুষ বসতে পারেন। জনপ্রতি ভাড়া ৩০ টাকা। বলা যায়, শখের বসে ঢাকার অধিকাংশ মানুষ এই গাড়িতে চড়ে যাতায়াত করেন। যাত্রীর পাশাপাশি এসব গাড়িতে মালামাল বোঝাই করে টানা হয়‌। ভিড় ও যানজটের মধ্য দিয়ে চাবুক মেরে ঘোড়াগুলোকে গাড়ি টানতে বাধ্য করা হয়। কখনো ভেবে দেখেছেন, দুটো ছোট্ট প্রাণী কতটা ভার সহ্য করতে পারে?

জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক মোহাম্মদ সাইফুল ইসলাম বলেন, প্রতিদিন একটি ঘোড়াকে তার ওজনের ৬ থেকে ৮ শতাংশ প্রোটিন খাওয়ানো উচিত। সারা দিন অতিরিক্ত যাত্রী ও মালামাল বহনের কারণে প্রাণীগুলো ক্লান্ত হয়ে যায় এবং অসুস্থ হয়ে পড়ে। যেহেতু জিনিসের দাম বেড়েছে, সেহেতু ঘোড়ার খাবার খড়, ভুট্টা, গম, যব, ভুসিসহ অন্যান্য খাদ্যসামগ্রীর দামও বেড়েছে। তাই আগের মতো ঘোড়ার পরিচর্যা করা, নিয়মিত তিনবেলা খাবার খেতে দেওয়া সম্ভব হয় না। আর ঘোড়াগুলো যে স্থানে রাখা হয়, সেসব স্থানও পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন নয়। প্রতিদিন শহরের পিচঢালা পথে চলতে গিয়ে ঘোড়ার পায়ের ক্ষুর ক্ষয় হয়ে নরম মাংস বের হয়ে যায়। এতে করে তাদের চলাচলে কষ্ট হয়। এই অবলা প্রাণী চলতে চলতে যখন পায়ের ব্যথায় থেমে যায়, তখন কোচোয়ান ঘোড়ার পিঠে চাবুক মেরে আবারও চলতে বাধ্য করেন। এই নিষ্ঠুরতার চিত্র যেন আমরা প্রতিনিয়ত দেখেও দেখি না, বুঝেও বুঝি না।

বর্তমানে শহরের প্রতিটি রাস্তায় যাতায়াতের জন্য রিকশা, বাস, সিএনজি, প্রাইভেট কার অহরহ রয়েছে। এসব যানবাহন থাকা সত্ত্বেও ঘোড়ার গাড়িতে করে অতিরিক্ত যাত্রী ও মালামাল বহন করে ঘোড়াগুলোকে কষ্ট দেওয়ার কোনো মানে হয় না। এই সভ্যতার যুগে শহরের সভ্য মানুষেরা নিজেদের উপার্জনের জন্য অসহায় প্রাণীগুলোর প্রতি যে অমানবিক আচরণ করছেন, তা থেকে এটাই প্রমাণ হয় যুগে যুগে দুর্বলের প্রতি চলে সবলের অত্যাচার। ঘোড়াগুলো তো আমাদের মতো কথা বলতে পারে না, প্রতিবাদ করতে পারে না, বোঝাতে পারে না তাদেরও সহ্য ক্ষমতার একটা সীমা আছে।

ব্যবসাক্ষেত্রে ঘোড়ার মালিকেরা এখন আর আগের মতো লাভ করতে পারছেন না। তাই ঘোড়ার পরিচর্যার জন্য পর্যাপ্ত খরচ তাঁরা করতে পারেন না, যা ঘোড়াগুলোর অবস্থা দেখলে বোঝা যায়। যত্ন ও খাবারের অভাবে কোনোমতে ঘোড়াগুলো বেঁচে আছে। একটু লক্ষ করলেই দেখা যায়, ঘোড়াগুলোর ঢুলু ঢুলু চোখ ও ফ্যাকাশে মুখ। যাত্রী ও মালামাল বহন ছাড়াও ঘোড়ার গাড়ি বিভিন্ন অনুষ্ঠান, বিশেষ করে পুরান ঢাকার বিয়েতে এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ হিসেবে বিবেচনা করা হয়। পুরান ঢাকার বাসিন্দাদের মধ্যে অনেকেই বংশানুক্রমে এই পেশা ধরে রেখেছেন, যাঁদের বাবা-দাদারা এই পেশায় নিয়োজিত ছিলেন।

স্বামী বিবেকানন্দের একটি গুরুত্বপূর্ণ উক্তি আছে—‘জীবে প্রেম করে যেই জন, সেই জন সেবিছে ঈশ্বর।’ আজকাল মানুষ এই উক্তি মানে না। টমটমচালিত ঘোড়াগুলোকে সাজিয়ে রাখা হয় রঙিন কাপড় দিয়ে, তাই তাদের বর্ণহীন জীবনের কথা কেউ জানতে পারে না। ঘোড়ার টগবগিয়ে ছুটে চলার শব্দ যেন আরোহীদের মনে আনন্দ বয়ে আনে, রাজকীয় অনুভূতি কাজ করে। আর যাত্রীদের গন্তব্যে পৌঁছে দেওয়াই যেন ঘোড়াগুলোর একমাত্র দায়িত্ব। বিনিময়ে পর্যাপ্ত খাবার, পরিচ্ছন্ন আস্তাবল, রোগাক্রান্ত হলে চিকিৎসাসেবা—কোনোটাই তাদের কপালে জোটে না। নিরীহ ঘোড়াগুলোকে মানুষ নিজেদের প্রয়োজনে দিনের পর দিন ব্যবহার করছে। স্বার্থ ও অর্থের কাছে মানুষের মানবিকতা বিক্রি হয়ে গেছে। ঐতিহ্যকে ধরে রাখার নামে এ কেমন অমানবিকতা চলছে আমাদের সমাজে? ঐতিহ্যকে যদি ধরেই রাখতে হয়, তবে ঐতিহ্যের যথাযথ সংরক্ষণ করা জরুরি। সপ্তাহে ছুটির দিন, বিভিন্ন অনুষ্ঠান ও বছরের বিশেষ উৎসবের দিনগুলোতে ঘোড়ার গাড়ি ব্যবহার করা যেতে পারে।

মাত্রাতিরিক্তভাবে ঘোড়াকে যেন কোনো কাজে ব্যবহার করা না হয়, এ বিষয়ে সরকারের সংশ্লিষ্ট বিভাগকে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে। ঘোড়াগুলো যাঁদের অধীন থাকবে, তাঁরা যেন নিয়মিত খাবার দেন এবং পরিচ্ছন্ন আস্তাবলে রাখেন। চিকিৎসাসেবা ও পরিচর্যা নিশ্চিত করতে পারে এ বিষয়ে দৃষ্টি দিতে হবে। তবেই এই ঘোড়ার গাড়ির ইতিহাস ও ঐতিহ্য প্রজন্মের পর প্রজন্মের কাছে তুলে ধরা সম্ভব।

রুহানা আক্তার বৃষ্টি
শিক্ষার্থী, লোক প্রশাসন বিভাগ
জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা।