একবিংশ শতাব্দীর প্রথম প্রান্তিক শেষ হচ্ছে। সেই সঙ্গে দুনিয়াজুড়ে দেশে দেশে প্রতিযোগিতা এক সন্ধিক্ষণে পৌঁছেছে। আজকের যে বিশ্বব্যবস্থা দেখি, তা পুনর্গঠিত হয়েছিল বিংশ শতাব্দীর প্রথমার্ধে। দুটি বিশ্বযুদ্ধের ধ্বংসস্তূপ থেকে। সেই বৈশ্বিক সংঘাত থেকে উঠে আসা শীতল যুদ্ধের যুগটি ছিল যুক্তরাষ্ট্রের আধিপত্যের সূচনা।
আজ আমরা এমন এক যুগে বাস করছি, যেখানে যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাব হ্রাস পাচ্ছে। উত্থান ঘটছে বহুমুখী বৈশ্বিক ব্যবস্থার।
এই পরিবর্তনের কিছু প্রভাব গত ১২ মাসে স্পষ্টভাবে প্রকাশিত হয়েছে। ডোনাল্ড ট্রাম্পের সংরক্ষণবাদ এই পরিবর্তনের একটি দিক। নতুন শিল্প শক্তিগুলো প্রায়ই সংরক্ষণবাদী নীতি প্রয়োগ করে, যেমন বিংশ শতাব্দীর প্রথমার্ধে যুক্তরাষ্ট্র এবং ১৮৪০ সালের আগে ব্রিটেন করেছিল। শিল্প শক্তিগুলো যখন বাজারে প্রভাবশালী অবস্থানে থাকে, তখন সাধারণত তারা সংরক্ষণবাদী নীতির ওপর নির্ভর করে না।
তখন তারা মুক্তবাণিজ্যের পক্ষে থাকে। উদাহরণস্বরূপ, শিল্পবিপ্লবের পর যুক্তরাজ্য মুক্তবাণিজ্য গ্রহণ করেছিল। ১৯৪৫ সালের পর যুক্তরাষ্ট্র বিশ্বের প্রধান শক্তি হয়ে উঠে তা–ই করেছিল। তাদের অর্থনৈতিক শক্তি ব্যবহার করে তারা অন্য রাষ্ট্রগুলোর সুরক্ষিত বাজার উন্মুক্ত করতে বাধ্য করেছিল।
আজ চীন মুক্তবাণিজ্যের প্রধান সমর্থক। অন্যদিকে যুক্তরাষ্ট্র ১৯৩০-এর দশকের পর প্রথমবার সঙ্গরক্ষণবাদের দিকে ঝুঁকেছে। বাণিজ্যযুদ্ধ কখনো কখনো সামরিক সংঘাতে রূপ নিতে পারে। তবে সব সময় তা হয় না।
তবে ডোনাল্ড ট্রাম্পের ক্ষেত্রে সংরক্ষণবাদের সঙ্গে যোগ হয়েছে একঘরে করে দেওয়া। তবে শুধু এই কথা বললে যুক্তরাষ্ট্রের সাম্রাজ্যবাদী অবস্থান ঠিকমতো বোঝা যাবে না। ট্রাম্প হয়তো যুক্তরাষ্ট্রের গত প্রজন্মের ব্যর্থ যুদ্ধগুলো দেখে এখন যুদ্ধ থেকে দূরে থাকতে চাইছেন। তবে তিনি কোনোভাবেই শান্তিবাদী নন।
ট্রাম্প চীনের প্রতি মনোযোগ কেন্দ্রীভূত করতে চান। ইরানের প্রতি তাঁর ঘোরতর শত্রুতা রয়েছে। তিনি যখন ন্যাটো সম্পর্কে অবজ্ঞাসূচক মন্তব্য করেন, তা আসলে ইউরোপীয় শক্তিগুলোর সামরিক ব্যয় বাড়ানোর জন্য চাপ দেওয়ার একটি কৌশল। এই কৌশল তাঁর প্রথম মেয়াদে বেশ সফল ছিল। ট্রাম্প ইউরোপীয় ন্যাটো সদস্যদের অস্ত্র খাতে তাদের মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) ৫ শতাংশ ব্যয় করার দাবি করেছেন। অথচ যুক্তরাষ্ট্র নিজেই খরচ করে ৩.৫ শতাংশ।
এ সবই আসলে যুক্তরাষ্ট্রের দুনিয়াজুড়ে প্রাধান্য কমতে থাকার স্পষ্ট চিহ্ন। সাম্রাজ্যের মূল কেন্দ্র যুক্তরাষ্ট্র এখন নিজ সামরিক শ্রেষ্ঠত্ব বজায় রাখতে ব্যর্থ। তাই সে তার অধীন রাষ্ট্রগুলো থেকে ক্রমাগত বেশি অর্থনৈতিক ও সামরিক সহায়তা দাবি করছে।
ট্রাম্প হয়তো চেয়েছেন এবং সম্ভবত পারতেনও ইউক্রেন যুদ্ধে ক্লান্ত পক্ষগুলোর মধ্যে একটি অস্থায়ী শান্তি প্রতিষ্ঠা করতে। এর ফলে সাময়িক শান্তি আসত। তবে ভবিষ্যতে আবার অস্থিরতা শুরু যে হবে না, তা বলা যায় না।
ইউক্রেন যুদ্ধ ন্যাটো শক্তিগুলোকে যুদ্ধের স্থায়ী প্রস্তুতির পথে ঠেলে দিয়েছে। চীনসহ অন্যদের সঙ্গে রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের মিত্রতাকে শক্তিশালী করেছে। তবে ইউক্রেন ছাড়াও অন্যান্য জায়গায় যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাব কমতে দেখা যাচ্ছে। মধ্যপ্রাচ্যের পরিস্থিতিও একই কাহিনি বলে।
প্রথমত, যুক্তরাষ্ট্র হয়তো মধ্যপ্রাচ্যে তাদের দায়িত্ব কমাতে চাইবে। না হলে পূর্ব এশিয়ার দিকে মনোযোগ কেন্দ্রীভূত করতে পারবে না।
কিন্তু মধ্যপ্রাচ্য থেকে একদম সরে আসা কার্যত অসম্ভব। বিশ্বের সবচেয়ে লাভজনক তেলক্ষেত্রগুলো মধ্যপ্রাচ্যে রয়েছে। হুতিরা সম্প্রতি সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণ করেছে যে লোহিত সাগর-সুয়েজ খালের জাহাজপথ বিশ্ববাণিজ্যের জন্য কতটা গুরুত্বপূর্ণ।
এ ছাড়া এই অঞ্চলের রাজনৈতিক অস্থিরতা সর্বদা দুনিয়াজুড়ে প্রভাব ফেলে। তা কখনোই কেবল আঞ্চলিক ইস্যু হয়ে থাকে না।
মধ্যপ্রাচ্যে যুক্তরাষ্ট্রের মিত্র ইসরায়েল গাজাকে ধ্বংস করেছে, হিজবুল্লাহর কার্যকারিতা কমিয়ে দিয়েছে এবং সিরিয়ায় বাশার আল-আসাদ শাসনের পতন ঘটেছে।
এসব ঘটনার রাজনৈতিক গুরুত্ব বিপুল। ব্যাপকভাবে গণহত্যার অভিযোগে অভিযুক্ত ইসরায়েল একটি অবাঞ্ছিত রাষ্ট্রে পরিণত হয়েছে। তাদের প্রধানমন্ত্রী এমন একজন ব্যক্তি, যিনি ১২৪টি দেশে যুদ্ধাপরাধের জন্য অভিযুক্ত। এই বিদ্রোহী রাষ্ট্রটি পুরোপুরি তার সাম্রাজ্যবাদী প্রভুর নিয়ন্ত্রণে রয়েছে কি না, তা এখন বোঝা যাচ্ছে না।
তবে এটা ঠিক যে ইসরায়েলকে ইরানের তেল স্থাপনাগুলো বা পারমাণবিক অস্ত্রকেন্দ্রগুলোতে আঘাত না করার নির্দেশ দিয়ে যুক্তরাষ্ট্র একটি পূর্ণাঙ্গ আঞ্চলিক যুদ্ধ এড়াতে পেরেছে।
তবে এখন পর্যন্ত ইসরায়েল যুক্তরাষ্ট্রের দেওয়া সীমা অধিকাংশ সময় লঙ্ঘন করেছে। সর্বশেষ যা দেখা গেছে ইসরায়েলের গোলান মালভূমি ও আরও সিরীয় অঞ্চল দখল করার মধ্য দিয়ে। আসাদ–পরবর্তী সিরিয়ার রাজনৈতিক পরিবেশ নিয়ে এমনকি ট্রাম্পও স্বীকার করেছেন যে তাতে সিরিয়ার নতুন সরকারের মিত্র তুরস্ক যুক্তরাষ্ট্রের চেয়েও বেশি প্রভাব ফেলবে।
যুক্তরাষ্ট্রের সাম্রাজ্যবাদী শক্তির জন্য ইউরোপ এবং মধ্যপ্রাচ্য থেকে নিজেকে পুরোপুরি সরিয়ে আনা কঠিন। সেই সঙ্গে তাকে বিশ্বক্ষমতার নতুন চ্যালেঞ্জ চীনের মোকাবিলা করার জন্য প্রস্তুত হতে হবে।
প্রতিযোগিতামূলক এক বিশ্ববাজারে যুক্তরাষ্ট্রের অন্য উপায় নেই। মুখে যতই চীন আর পশ্চিমাদের শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের কথা বলা হোক না কেন, বৈশ্বিক সাম্রাজ্যবাদী ব্যবস্থার পক্ষে তা সম্ভব নয়।
অনেক দিন ধরেই দেখা যাচ্ছে যে চীনের প্রবৃদ্ধির হার কমেছে। চীনের কমিউনিস্ট পার্টির শাসকেরা অবশ্য তা বুঝে ফেলেছেন। তাঁরা অভ্যন্তরীণ বাজার বাড়ানোর চেষ্টা করছেন। অনেক শিল্পায়নকারী রাষ্ট্র এর আগে এমন করেছে।
তবে এই তীব্র অর্থনৈতিক পরিবর্তন অনিবার্যভাবে সামাজিক অস্থিরতার সৃষ্টি করবে। তা এমন সব অর্থনৈতিক এবং রাজনৈতিক চ্যালেঞ্জ তৈরি করতে পারে, যা চীনের নেতারা আগে কখনোই মোকাবিলা করেননি।
এই ঘটনা আন্তর্জাতিক উত্তেজনা কমাবে না; বরং বাড়াবে। সাম্রাজ্য এবং অভ্যন্তরীণ অশান্তি একে অপরের সহযাত্রী। ব্রিটেন ও যুক্তরাষ্ট্রের শাসকশ্রেণি নিজেদের অভিজ্ঞতার মাধ্যমেই কথাটা জানে।
২০২৫ সালের দিকে পৃথিবী একটি দুর্বল সাম্রাজ্যবাদী যুক্তরাষ্ট্রকে দেখবে। যার নেতৃত্ব দিচ্ছেন এমন একজন প্রেসিডেন্ট, যিনি প্রায় ১০০ বছর পর প্রথমবারের মতো এই সাম্রাজ্য পরিচালনা করতে সংরক্ষণবাদ, বিচ্ছিন্নতা এবং তৃতীয় পক্ষের ওপর নির্ভরশীলতার মিশ্রণ ব্যবহার করতে যাচ্ছেন। এমন অবস্থায় সরকারগুলো প্রায়ই নিজেদের সমস্যাগুলোকে বাইরের দিকে ঠেলে দেওয়ার চেষ্টা করে।
এর প্রধান চ্যালেঞ্জার চীন চমকপ্রদ প্রবৃদ্ধির বছরগুলো হয়তো ইতিমধ্যে পেছনে ফেলে এসেছে। প্রবৃদ্ধির কারণে সৃষ্টি হওয়া সবচেয়ে গুরুতর অভ্যন্তরীণ সমস্যা চীনের সামনে অপেক্ষা করছে।
এসব বিষয় মিলে খুব ভালো কিছু নতুন বছরে আশা করা যায় না।
জন রিস ইউনিভার্সিটি অব লন্ডনের ভিজিটিং রিসার্চ ফেলো
মিডল ইস্ট আই থেকে নেওয়া, ইংরেজি থেকে অনূদিত