মতামত

‘তলাবিহীন খেলাপি ঋণের’ দেশ থেকে বেরিয়ে আসব কীভাবে

বাংলাদেশে সম্প্রতি ঘটে যাওয়া বহুল আকাঙ্ক্ষিত বৈষম্যবিরোধী গণ-অভ্যুত্থান দেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে দৃশ্যমান পরিবর্তন ঘটিয়েছে এবং এর ধারাবাহিকতায় আমরা একটি স্বৈরাচারী মনোবৃত্তির সরকারের পতন ও নতুন অন্তর্বর্তী সরকারের আগমন দেখেছি।

যেকোনো দেশে গণ-অভ্যুত্থান–পরবর্তী সরকারের কাছে জনগণের আশা–আকাঙ্ক্ষা হয় আকাশচুম্বী আর তার পরিপ্রেক্ষিতে নতুন সরকারকে বিভিন্ন চ্যালেঞ্জের মোকাবিলা করতে হয়। বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের সামনেও এ রকম বহু রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জ ধীরে ধীরে দৃশ্যমান হচ্ছে, যা তাদেরকে যথোপযুক্তভাবে মোকাবিলা করতে হবে।

এমনি একটি গুরুত্বপূর্ণ চ্যালেঞ্জ হচ্ছে দেশের বর্তমান ভগ্নপ্রায় অর্থনীতির মেরামত ও সংস্কার। অর্থনীতির মেরামত স্বল্পমেয়াদি ধারণা হলেও তা সংস্কারের মতো দীর্ঘমেয়াদি কার্যক্রমের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত।

বাংলাদেশের অর্থনীতি বিগত বছরগুলোতে কঠিন সংকটময় সময় পার করেছে এবং এখনো তা চলমান। আর্থিক খাতের বিশৃঙ্খলা আজ সর্বজনবিদিত। ব্যাংকিং খাতে সুশাসনের চরম অধঃপতন ও দলীয়করণ আমাদের দেশকে আজ ‘তলাবিহীন ঝুড়ির’ দেশ থেকে ‘তলাবিহীন খেলাপি ঋণের’ দেশে পরিণত করেছে। এ ছাড়া ঢালাওভাবে মুদ্রা পাচার ও শেয়ারবাজার কেলেঙ্কারির কথা আমরা সবাই অবগত।

এত কিছুর মধ্যেও দেশের চলমান উচ্চ মূল্যস্ফীতি আমাদের জন্য একটি আলোচিত চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। বাংলাদেশের বর্তমান মূল্যস্ফীতির হার প্রায় ১২ শতাংশ, যদিও সাম্প্রতিক সময়ে প্রকাশিত বিগত সরকারের অর্থনৈতিক তথ্য–উপাত্ত গড়াপেটার খবর বিবেচনায় নিলে এই হার আরও বেশি হতে পারে।

যদিও অর্থনীতির তাত্ত্বিকদের মতে নিয়ন্ত্রিত মূল্যস্ফীতি অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির জন্য সহায়ক, কিন্তু দীর্ঘ মেয়াদে উচ্চ মূল্যস্ফীতি অর্থনীতির জন্য যে ক্ষতিকর, সে ব্যাপারে দ্বিমত নেই। উচ্চ মূল্যস্ফীতি মানুষের ক্রয়ক্ষমতা ব্যাপকভাবে হ্রাস করে। ফলে নিম্ন ও মধ্যবিত্তের মানুষের জীবনযাত্রা দুর্বিষহ করে তোলে।

উচ্চ মূল্যস্ফীতির কারণে সঞ্চয়প্রবণতা কমে গেলে দীর্ঘ মেয়াদে বেসরকারি বিনিয়োগ বাধাগ্রস্ত হয়। তা ছাড়া বৈদেশিক মুদ্রার বিনিময় হার, আমদানি খরচ, বিদেশি বিনিয়োগ ইত্যাদি উচ্চ মূল্যস্ফীতি কারণে প্রভাবিত হতে পারে। অবসরপ্রাপ্ত নাগরিকেরা, যাঁরা পেনশন–সুবিধা পেয়ে থাকেন, তাঁরাও উচ্চ মূল্যস্ফীতির করুণ শিকার।

আরও উল্লেখ্য, ইনফ্লেশন এক্সপেক্টেশন হাইপোথিসিস অনুযায়ী উচ্চ মূল্যস্ফীতির দীর্ঘসূত্রতা ভবিষ্যতের জন্য আরও বেশি মূল্যস্ফীতির সম্ভাবনা তৈরি করে। সুতরাং বর্তমান ও ভবিষ্যৎ অর্থনৈতিক সুরক্ষার জন্য উচ্চ মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ একান্ত অপরিহার্য।

মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের জন্য প্রধানত কেন্দ্রীয় ব্যাংকের বিভিন্ন মুদ্রানীতিকে প্রাধান্য দেওয়া হয়। কেন্দ্রীয় ব্যাংক দেশের নীতি সুদের হার পরিবর্তনের মাধ্যমে ও মুদ্রার সরবরাহ নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে মূল্যস্ফীতিকে নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করে। নতুন অন্তর্বর্তী সরকারের সময়ে নিয়োগপ্রাপ্ত বাংলাদেশ ব্যাংকের বর্তমান গভর্নর ইতিমধ্যে মুদ্রা সরবরাহে বাংলাদেশ ব্যাংকের অতিরক্ষণশীল অবস্থানের কথা জানিয়ে দিয়েছে, যা অবশ্যই আশাব্যঞ্জক।

এ ছাড়া বাংলাদেশ ব্যাংক ইতিমধ্যে নীতি সুদের হার বৃদ্ধি করেছে, যা প্রকারান্তরে মূল্যস্ফীতিকে নিয়ন্ত্রণ করতে সাহায্য করবে বলে মনে করা হচ্ছে। কিন্তু নীতি সুদের হার যে পরিমাণ বৃদ্ধি করা হয়েছে, তা মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের জন্য যথেষ্ট নয়। দেশের মূল্যস্ফীতির হারের যে লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছে, তার সঙ্গে বর্তমান মূল্যস্ফীতির হার বিবেচনায় নিলে নীতি সুদের হার বর্তমানের ৯ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ১২ শতাংশের ওপরে নির্ধারণ করতে হবে আর তা না হলে নীতি সুদহার বৃদ্ধির সুফল পেতে দীর্ঘ অপেক্ষার পথ পাড়ি দিতে হবে, যা বর্তমান পরিস্থিতিতে কাম্য নয়।

বর্তমানে বাংলাদেশে কিছু ব্যক্তি তাদের সামাজিক, রাজনৈতিক ও কর্মক্ষেত্রের প্রভাব ব্যবহার করে প্রয়োজনাতিরিক্ত সম্পদের পাহাড় গড়ে তুলেছে। যদিও জমাকৃত আর্থিক সম্পদের ওপর বিভিন্ন ধরনের করারোপের ব্যবস্থা রয়েছে কিন্তু স্থাবর সম্পদ, যেমন একাধিক বাড়ি বা অতিরিক্ত জমি ইত্যাদির ওপর যথোপযুক্ত করারোপ করা হয় না।

কিন্তু কেন্দ্রীয় ব্যাংককে তার নীতি সুদের হারের উচ্চতর সমন্বয়ের ক্ষেত্রে সরকারের নেওয়া ঋণের ব্যাপারেও সতর্ক থাকতে হয়। বাংলাদেশের বর্তমান সরকারি ঋণের পরিমাণ তার ঋণ গ্রহণের সক্ষমতার চেয়েও অনেক বেশি। সরকারকে এখন ঋণ করে পূর্ববর্তী ঋণের সুদ পরিশোধ করতে হচ্ছে বলে শোনা যায়।

এ অবস্থায় নীতি সুদের হার অতিরিক্ত বৃদ্ধি করলে সরকারের ঋণের স্থিতি যেমন বাড়বে, তেমনিভাবে ঋণের সুদের বোঝাও বাড়বে, যা ঋণ পরিশোধের সক্ষমতাকে আরও কমিয়ে দেবে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে এই দ্বিমুখী সমস্যা সমাধানে সরকারের রাজস্ব বিভাগ সাহায্য করতে পারে।

উচ্চ নীতি সুদহারের জন্য কেন্দ্রীয় ব্যাংককে সরকারি ঋণের জন্য যে বাড়তি অর্থ গুনতে হবে, রাজস্ব বিভাগ তা করের মাধ্যমে সংগৃহীত অর্থ দিয়ে জোগান দিতে পারে। তা ছাড়া করারোপের মাধ্যমে ভোক্তার খরচযোগ্য আয় কমিয়ে দেশের সামষ্টিক চাহিদাকে সংকোচন করতে পারে, যা উচ্চ মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে সহায়ক হবে। কিন্তু কর আয় বৃদ্ধির জন্য করের হার বৃদ্ধি বর্তমান প্রেক্ষাপটে মোটেও সমীচীন নয়।

তাই রাজস্ব বিভাগের উচিত নতুন করারোপের ক্ষেত্র অনুসন্ধান করা যাতে করে নিম্ন ও মধ্য আয়ের মানুষ কোনোভাবে ক্ষতিগ্রস্ত না হয়। এ প্রসঙ্গে ইনহেরিট্যান্স ট্যাক্স ও সেকেন্ড হোম ট্যাক্স উল্লেখযোগ্য। উত্তরাধিকার কর ও একের অধিক বাড়ি থাকলে তার ওপর কর ধার্য করে সরকারের রাজস্ব আয় বৃদ্ধি করা যেতে পারে এবং এর ফলে দীর্ঘ মেয়াদে সমাজে সমতাও ফিরিয়ে আনা সম্ভব হবে।

বর্তমানে বাংলাদেশে কিছু ব্যক্তি তাদের সামাজিক, রাজনৈতিক ও কর্মক্ষেত্রের প্রভাব ব্যবহার করে প্রয়োজনাতিরিক্ত সম্পদের পাহাড় গড়ে তুলেছে। যদিও জমাকৃত আর্থিক সম্পদের ওপর বিভিন্ন ধরনের করারোপের ব্যবস্থা রয়েছে কিন্তু স্থাবর সম্পদ, যেমন একাধিক বাড়ি বা অতিরিক্ত জমি ইত্যাদির ওপর যথোপযুক্ত করারোপ করা হয় না।

এমতাবস্থায় অতিরিক্ত বাড়ি বা জমির বার্ষিক মূল্যায়নের ভিত্তিতে বার্ষিক বর্ধিত মূল্যের ওপর উচ্চ হারে কর আরোপ করা বাঞ্ছনীয়। এর ফলে সরকারের রাজস্ব যেমন বৃদ্ধি পাবে, তেমনি প্রয়োজনাতিরিক্ত সম্পদ জমা করার প্রবণতা হ্রাস পাবে। এ ছাড়া উত্তরাধিকার করও হতে পারে কর আহরণের একটি আদর্শ ক্ষেত্র। উত্তরাধিকারের মাধ্যমে প্রাপ্ত সম্পদ নীতিগত দিক থেকে অন্যায্য।

কারণ, একজন ব্যক্তি কোনো মেধা বা শ্রম ব্যয় না করে শুধু জন্মসূত্রে বিপুল পরিমাণ অর্থসম্পদের মালিক হয়ে ওঠে। দীর্ঘ মেয়াদে এর ফলে সামাজিক মূলধন বৃদ্ধি বাধাগ্রস্ত হতে পারে। উপরন্তু এই সম্পদ হস্তান্তর প্রক্রিয়ায় কোনো আর্থিক ক্ষতির সুযোগ না থাকায় মানুষের সম্পদ আহরণের অপলিপ্সা বৃদ্ধি পেতে পারে, যা কিনা মানুষকে বিভিন্ন অনৈতিক কর্মকাণ্ডে সম্পৃক্ত হতে প্রভাবিত করতে পারে।

বিশ্বের বহু দেশে উত্তরাধিকার কর প্রচলিত আছে এবং এই করের হার এত বেশি যে অনেক সময় হস্তান্তরিত সম্পদ উত্তরাধিকারের জন্য লাভজনক হয় না। ফলে মানুষ তার মেধা ও শ্রম দিয়ে সম্পদ আহরণে মনোনিবেশ করে আর দাতাও অতিরিক্ত সম্পদ আহরণে নিরুৎসাহিত হয়। সুতরাং রাজস্ব বিভাগ কর আহরণ বৃদ্ধি ও ভবিষ্যৎ সামাজিক শৃঙ্খলাবোধ আনয়নের জন্য উত্তরাধিকার কর আরোপ করতে পারে।

এ ছাড়া রাজস্ব বিভাগের উচিত ব্যক্তিগত করের সর্বোচ্চ হার পুনর্বিবেচনা করা। বর্তমানে সর্বোচ্চ করের হার ৩০ শতাংশ, যা সুপার রিচ বা অতি বিত্তশালী জনগোষ্ঠীর জন্য আরও সম্পদ আহরণকে উৎসাহিত করবে। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে এই করে হার ন্যূনতম ৪০ শতাংশ থেকে ৬০ শতাংশ পর্যন্ত হয়। বাংলাদেশের রাজস্ব বিভাগেরও উচিত অতি বিত্তশালীদের জন্য উচ্চ হারে কর ধার্য করা, যা প্রগ্রেসিভ ট্যাক্সেশন নীতির সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ।

পরিশেষে এ কথা বলা অপরিহার্য যে বাংলাদেশের বর্তমান উচ্চ মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গ্রহণকৃত মুদ্রানীতি যথেষ্ট নয়। মুদ্রানীতির পাশাপাশি সরকারের রাজস্বনীতিরও প্রয়োজনীয়তা রয়েছে। তাই বাংলাদেশ ব্যাংক ও রাজস্ব বিভাগ দুটি ভিন্ন প্রতিষ্ঠান হলেও মূল্যস্ফীতির কঠিন শৃঙ্খল ভাঙতে এই দুই প্রতিষ্ঠানের একসঙ্গে কাজ করতে হবে। নীতিনির্ধারকদের এমনভাবে দিকনির্দেশনা দিতে হবে যেন মুদ্রানীতি ও রাজস্বনীতি একে অন্যের পরিপূরক হিসেবে কাজ করে।

  • অধ্যাপক মসফিক উদ্দিন লিডস বিশ্ববিদ্যালয় যুক্তরাজ্য