ইউরোপ কীভাবে বিশ্ব জয় করেছে

বেলজিয়ামে হিউম্যান জু বা মানব চিড়িয়াখানা নামে প্রদর্শনী হয়েছে এই সেদিন ১৯৫৮ সালেও
ছবি: সংগৃহীত

ফুটবলের বিশ্বকাপ শুরু হয়ে গেছে। ১৯ নভেম্বর ফিফার সভাপতি জিয়ান্নি ইনফান্তিনো সংবাদ সম্মেলনে সব রকম বিভেদ ও বৈষম্যের বিরুদ্ধে তাঁর অবস্থান আবেগপূর্ণ ভাষায় উপস্থাপন করেছেন। তিনি বলেছেন, তিন হাজার বছর ধরে ইউরোপ সারা বিশ্বে যে পাপ কাজ চালিয়েছে, তার জন্য তাদের আগামী তিন হাজার বছর ধরে ক্ষমা চাইতে হবে।

সারা বিশ্বে ইউরোপের অগ্রবর্তিতার শক্ত ভিত দিয়েছে তাদের রেনেসাঁস, বিজ্ঞান ও আবিষ্কার, আলোকন, শিল্পবিপ্লব এবং অবশ্যই আধুনিক জাতি ও রাষ্ট্র গঠনের উপযুক্ত রসদপ্রাপ্তি। এ তাদের অর্জন। আবার এটাও সত্য যে পঞ্চদশ শতাব্দী থেকে, ইউরোপীয় অভিযাত্রী, বণিক, ভাগ্যান্বেষীরা সারা পৃথিবী জয়ে বেরিয়ে পড়েছিল। বলা যায় টানা পাঁচ শ বছর ধরে এরা মূলত নির্বিচার লুণ্ঠন ও নিষ্ঠুরতার সমন্বয়ে তাদের বৈশ্বিক আধিপত্য নিশ্চিত করেছিল।

ইউরোপের অভিযাত্রীদের সঙ্গে ছিল বণিক ও ধর্মপ্রচারকেরা। সেই সঙ্গে অবশ্যই ছিল অজানা মানুষ ও দেশকে মোকাবিলা এবং জয়ের জন্য উপযুক্ত অস্ত্র ও বাহন এবং সেনাবাহিনী।

এই লক্ষ্য নিয়ে প্রথম ইউরোপীয় অভিযাত্রী কলম্বাস আমেরিকায় পা রেখেছিলেন। আমরাও শিখেছি কলম্বাস আমেরিকা আবিষ্কার করেছিলেন ১৪৯২ খ্রিষ্টাব্দে। যেন এর আগে মহাদেশটি ছিল না বা সেখানে কোনো মানুষের বসবাস ছিল না। সেই থেকে শুরু নিজেদের গোলাকার এই গ্রহের মধ্যমণি ধরে নিয়ে বিশ্বের বিভিন্ন অঞ্চলের নামকরণ।

ইউরোপের ইতিহাসকারেরা অনেক কাল ধরে বলে গেছেন এখানকার বনজঙ্গল এবং বিরান অঞ্চলের ফাঁকে ফাঁকে বিচ্ছিন্নভাবে যেসব মানুষ বাস করত, তারা হলো অনুন্নত ও আদিম মানুষ। কিন্তু বাস্তবে দেখা গেল ইউরোপেরও অনেক আগে থেকেই এখানকার মানুষ শুধু সভ্য নয়, মেক্সিকো এবং দক্ষিণ আমেরিকায় গড়ে তুলেছিল তিনটি উন্নত সভ্যতা মায়া, অ্যাজটেক ও ইনকা। কিন্তু ইউরোপীয়রা তখন এদের জীবন ও জ্ঞানের সঙ্গে পরিচিত হতে বা বিনিময়ের জন্য আসেনি, তারা এসেছিল স্রেফ এদের হটিয়ে বা মেরে ইচ্ছেমতো লুটপাট ও নিজেদের রাজত্ব প্রতিষ্ঠা করতে। ফলে দুই মহাদেশের আদিবাসী, যাদের তারা ভুলভাবে রেড ইন্ডিয়ান নামকরণ করেছিল, সরল বলিষ্ঠ মানুষদের তারা ভাঁওতা দিয়ে, চক্রান্ত করে এবং সীমাহীন নিষ্ঠুরতার আশ্রয় নিয়ে রাজ্যচ্যুত, ভূমিচ্যুত এবং শেষ পর্যন্ত নির্বিচার হত্যা করেছিল। বহিরাগতরা সঙ্গে করে নিয়ে এসেছিল গুটিবসন্ত, টাইফয়েড, কলেরা, প্লেগের মতো ভয়ংকর মড়ক।

উত্তর আমেরিকা ও দক্ষিণ আমেরিকা দুটি মহাদেশ দখলে নিয়েছিল ইউরোপীয়রা। আর তৎকালীন ইউরোপের শক্তিধর দেশ ব্রিটেন অস্ট্রেলিয়া মহাদেশকে বেছে নিয়েছিল ভয়ংকর অপরাধীদের কারাগার বানানোর জন্য। ইতিহাস বলছে, ১৭৮৮ সালের ২৬ জানুয়ারি নতুন উপনিবেশের গভর্নর ক্যাপ্টেন আর্থার ফিলিপ মোট ৭৫৯ জন কারাবন্দী নিয়ে সিডনিতে পৌঁছান।

এই দলের ৫৬৮ জন পুরুষ ও ১৯১ জন নারীই অস্ট্রেলিয়ায় ইউরোপীয় কারাবন্দীদের প্রথম চালান। ফলে দাগি অপরাধীদের নিয়েই অস্ট্রেলিয়ায় ইউরোপীয়দের বসতি শুরু হয়। ধীরে ধীরে প্রশাসন, শিক্ষাদীক্ষা, জনস্বাস্থ্যসহ পূর্ণাঙ্গ আধুনিক ব্যবস্থার পত্তনে যুক্ত হন আরও মানুষ। ইউরোপের নানা দেশ থেকেও অভিবাসীদের স্থান দেওয়া হয়। আর এখানেও আদিবাসী অস্ট্রেলয়েড জাতির মানুষকে হয় মরতে হয়েছে, নয়তো সরে যেতে হয়েছে মহাদেশের মধ্যবর্তী দুর্গম ঊষর মরু অঞ্চলে।

আফ্রিকার মানুষ সম্পর্কে তারা রেড ইন্ডিয়ানদের চেয়েও খারাপ ধারণা পোষণ করত। আধুনিক নৃতত্ত্ব বলছে, মানবজাতির উৎপত্তি হয়েছে আফ্রিকায় অন্তত ৩০ লাখ বছর আগে। আর তাদের সম্পর্কেই ইউরোপীয়দের প্রচারণা ছিল এরা ঠিক মানুষ নয়, শিম্পাঞ্জি ও মানুষের মাঝামাঝি কোনো প্রাণী হবে। এমনকি তারা ধরে আনা দাসদের প্রদর্শনীও করত ইউরোপে। হিউম্যান জু বা মানব চিড়িয়াখানা নামে এমন প্রদর্শনী হয়েছে বেলজিয়ামে এই সেদিন ১৯৫৮ সালে।

বাকি যে দুটি মহাদেশে মানববসতি আছে আফ্রিকা ও এশিয়া—সেখানে ব্রিটেন, স্পেন ও পর্তুগালের পাশাপাশি ইউরোপের আরও দেশ হানা দিয়েছে বারবার। এখানে তারা উপনিবেশ স্থাপন করেছে। ব্রিটিশ, ডাচ, ফরাসি, দিনেমার বণিক আর স্প্যানিশ ও পর্তুগিজ অভিযাত্রী ও ভাড়াটে সৈনিকেরা ধনরত্নের লোভে হানা দিয়েছে এশিয়ায় সেই ষষ্ঠদশ শতাব্দী থেকে।

এ ইতিহাস অনেকটাই আমাদের জানা। এলাকার দখল নেওয়ার জন্য ইউরোপীয় শক্তিগুলোর নিজেদের মধ্যেই লড়াই হয়েছে বারবার। অনেক হাতবদল রক্তপাত এবং ষড়যন্ত্র, ভাঁওতাবাজি, নির্মম নিষ্ঠুরতার মাধ্যমে দক্ষিণ এশিয়ায় প্রধানত ব্রিটেনই আধিপত্য বিস্তার লাভ করতে সক্ষম হয়েছে। ইন্দোচীনে ফরাসি ও ডাচদের প্রাধান্য লক্ষ করা গেছে।

প্রথম ইউরোপীয় যে পর্যটক আফ্রিকার অভ্যন্তরে প্রবেশ করেছিলেন, তিনি ডা. লিভিংস্টোন। তার আগেও অবশ্য দাস ব্যবসার সূত্রে ইউরোপীয় এবং ইউরোপীয়-আমেরিকানরা আফ্রিকায় হানা দিয়েছে। আফ্রিকার কালো মানুষদের দরকার পড়েছিল তাদের অর্জিত বিশাল মহাদেশে চাষবাস, পশুপালন এবং খনিজ সম্পদ উত্তোলন করে ধন উপার্জনের জন্য। আর পরে ঊনবিংশ শতাব্দীতে সোনা, হীরা, রুপা, ইউরোনিয়ামসহ মূল্যবান সব খনিজ পদার্থ ও বনসম্পদের ওপর একচ্ছত্র আধিপত্য প্রতিষ্ঠার জন্য ইউরোপীয়রা হন্যে হয়ে ওঠে।

১৮৮৪ সালে ইউরোপের ১৩টি দেশ ও যুক্তরাষ্ট্র বার্লিনে একটি বৈঠকে বসে, যা ইতিহাসে স্ক্র্যাম্বল ফর আফ্রিকা বা আফ্রিকা টুকরা করে ভাগ করার (কাড়াকাড়ি) বৈঠক নামে খ্যাত। এভাবে বহু যুদ্ধবিগ্রহের পরে আক্ষরিক অর্থে টেবিলে বসে তারা আফ্রিকা মহাদেশ নিজেদের মধ্যে ভাগ করে নেয়।

আফ্রিকার মানুষ সম্পর্কে তারা রেড ইন্ডিয়ানদের চেয়েও খারাপ ধারণা পোষণ করত। আধুনিক নৃতত্ত্ব বলছে, মানবজাতির উৎপত্তি হয়েছে আফ্রিকায় অন্তত ৩০ লাখ বছর আগে। আর তাদের সম্পর্কেই ইউরোপীয়দের প্রচারণা ছিল এরা ঠিক মানুষ নয়, শিম্পাঞ্জি ও মানুষের মাঝামাঝি কোনো প্রাণী হবে। এমনকি তারা ধরে আনা দাসদের প্রদর্শনীও করত ইউরোপে। হিউম্যান জু বা মানব চিড়িয়াখানা নামে এমন প্রদর্শনী হয়েছে বেলজিয়ামে এই সেদিন ১৯৫৮ সালে। আর মানুষের ওপর কী রকম শোষণ চলত, তার একমাত্র দৃষ্টান্ত দেওয়া যায় বিখ্যাত মার্কিন লেখক মার্ক টোয়েনের ছোট্ট একটি বই থেকে।

এই চটি বইয়ের নাম কিং লিওপোল্ডস সলিলকি বা রাজা লিওপোল্ডের স্বগত ভাষণ। তাতে দেখা যায় ইউরোপের ক্ষুদ্র রাজ্য বেলজিয়ামের রাজা দ্বিতীয় লিওপোল্ড তাঁর রানি হেনরিয়েটাকে উপহার দিয়েছিলেন নিজ দেশের চেয়েও বহুগুণ বড় উপনিবেশ কঙ্গো। না, তখন কঙ্গো ঠিক বেলজিয়ামের উপনিবেশ ছিল না, ছিল লিওপোল্ডের ব্যক্তিগত সম্পত্তি। পরিহাসের মতো শোনাবে যে তিনি দেশটির নাম রেখেছিলে কঙ্গো ফ্রি স্টেট। বনজ এবং খনিজ সম্পদে সমৃদ্ধ এই ব্যক্তিগত রাজ্যের অবাধ্য কিছু গোত্রকে শায়েস্তা করার বিধান দিয়েছিলেন এদের কবজি কেটে জমা দেওয়ার জন্য। সরদারদের দায়িত্ব ছিল প্রতিদিন অসংখ্য কাটা কবজি জমা দেওয়া। পাঠক, স্মরণ করুন বাংলার মসলিনের তাঁতিদের বুড়ো আঙুল কেটে দেওয়ার ইতিহাস।

পশ্চিম ও মধ্য ইউরোপের রেনেসাঁস, বিজ্ঞান ও যুক্তিবাদী দর্শনের আঁতুড় দেশগুলোই একে একে দখলে নিয়েছে, আধিপত্যের তাঁবে এনেছে বিশ্বের অন্য পাঁচটি মহাদেশ। অ্যান্টার্কটিকার ওপর তাদের অধিকার প্রতিষ্ঠা অবশ্য বিংশ শতাব্দীর দ্বিতীয়ার্ধের ব্যাপার। উপনিবেশ শেষ পর্যন্ত রক্ষা করা না গেলেও তারা বহুজাতিক কোম্পানি, আন্তর্জাতিক আর্থিক প্রতিষ্ঠান এবং মুক্ত বাজার অর্থনীতি চালুর মাধ্যমে নিজেদের আর্থরাজনৈতিক আধিপত্য ধরে রেখেছে।

এর জন্য তারা এসব মহাদেশের বিভিন্ন দেশে ইচ্ছেমতো সামরিক অভ্যুত্থান ঘটিয়েছে, ইচ্ছেমতো সরকারের পতন ঘটিয়ে পুতুল সরকার তৈরি করেছে। এর সাম্প্রতিক দগদগে দৃষ্টান্ত ইরাক ও লিবিয়া। আবার নিজেদের স্বার্থে তারা স্থানীয় সহযোগী শক্তির ওপর থেকে সমর্থন প্রত্যাহার করেছে অবলীলায়, যেমন আফগানিস্তানে গত বছর। বিশিষ্ট ইউরোপীয় ইতিহাসবিদ এইচ এ এল ফিশার লিখেছেন পশ্চিমের সমস্যা হলো তার মজ্জাগত আগ্রাসী মনোভাব আর প্রাচ্যের হলো সামন্ততন্ত্রের প্রতি পিছুটান।

এ লেখা ঠিক এখানে শেষ করলে সামগ্রিক বিচার হয়তো ভারসাম্য হারাবে। এ কথাও মানতে হবে রেনেসাঁস, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির বিপ্লব, আলোকন ও যুক্তিবাদী দর্শনের বিকাশ, শিল্পবিপ্লব, গণতন্ত্র আইনের শাসন ও মানবাধিকার ইত্যাদি যেসব জ্ঞান, ব্যবস্থা, পদ্ধতি সারা বিশ্বের মানবজীবনকে শুধু প্রভাবিত করেনি, ব্যাপকভাবে পাল্টে দিয়েছে; তা অর্জন, বিকাশ, প্রতিষ্ঠার কৃতিত্বের সবটাই এদের। এসব পরিবর্তন মানবজীবনে বহু ইতিবাচক রূপান্তর ঘটিয়েছে।

ইউরোপের সদর্থক অর্জনগুলোর কথা মনে রেখেও বুঝতে অসুবিধা হওয়ার কথা নয় যে নিশ্চয় ফিফা সভাপতি ইনফান্তিনো সেদিন সংবাদ সম্মেলনে মিথ্যা বলেননি। ইউরোপকে তার আধিপত্যের ও শ্রেয়ম্মন্যতার মানসিকতা থেকে বেরিয়ে এসে সমতার বিশ্ব তৈরিতে ভূমিকা রাখতে বলেছেন তিনি। এবারের বিশ্বকাপের এটিই মূল বাণী। সত্য ভাষণের জন্য ইনফান্তিনোকে ধন্যবাদ।

  • আবুল মোমেন কবি, প্রাবন্ধিক ও সাংবাদিক