রোজায় হোক তাকওয়ার চর্চা: বেশি মুনাফা ও অতিরিক্ত পণ্যক্রয় নয়

রহমত, মাগফিরাত ও নাজাতের বারতা নিয়ে এল পবিত্র মাহে রমাদান। সুস্বাগত মাহে রমাদান। আহলান সাহলান মাহে রমাদান।

ইসলামের পঞ্চস্তম্ভের অন্যতম হলো রমাদান মাসে সিয়াম বা রোজা পালন। প্রিয় নবীজি (সা.) বলেন, ইসলাম পাঁচটি স্তম্ভের ওপর প্রতিষ্ঠিত। ১. সাক্ষ্য দেওয়া যে আল্লাহ ছাড়া কোনো ইলাহ বা মাবুদ নেই, আর নিশ্চয়ই হজরত মুহাম্মদ (সা.) আল্লাহর প্রেরিত রাসুল। ২. সালাত কায়েম করা ৩. জাকাত প্রদান করা ৪. হজ করা ৫. রমাদান মাসে সিয়াম পালন করা। (বুখারি, খণ্ড: ১, হাদিস: ৭)

রমাদান মাসে আল্লাহর রহমত ব্যাপক হারে বর্ষিত হয়ে থাকে। জান্নাতের দরজাগুলো খুলে দেওয়া হয়, জাহান্নামের দরজাগুলো বন্ধ করে দেওয়া হয়, শয়তানকে শৃঙ্খলাবদ্ধ করা হয়। ফলে রোজা, নামাজ, তিলাওয়াত, দান-সদকা, ফিতরা, জাকাত, জিকির-আজকার যাবতীয় ইবাদত অনুশীলন ও তাকওয়া অর্জন সহজ হয়।

কোরআন মজিদে আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘রমাদান মাস! যে মাসে মানুষের দিশারি, সৎ পথের স্পষ্ট নিদর্শন ও সত্যাসত্যের পার্থক্য নিরূপণকারী হিসেবে কোরআন অবতীর্ণ করা হয়েছে। সুতরাং তোমাদের মধ্যে যারা এই মাস পাবে, তারা যেন এই মাস সাওম পালন করে।’ (সুরা-২ বাকারা, আয়াত: ১৮৫)

তাকওয়া তথা সংযম ও আত্মনিয়ন্ত্রণের মাস রমাদান। আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘হে ইমানদাররা, তোমাদের ওপর সিয়াম ফরজ করা হয়েছে, যেরূপ ফরজ করা হয়েছিল তোমাদের পূর্ববর্তীদের ওপরও, যাতে তোমরা তাকওয়া লাভ করতে পারো।’ (সুরা-২ বাকারা, আয়াত: ১৮৩)

রমাদানের উদ্দেশ্য তাকওয়া। তাকওয়া অর্থ আল্লাহর ভয়। আল্লাহর ভয়ে সব মন্দ কাজ থেকে বিরত থাকা। সংযম অবলম্বন করা। এ সংযম সব শ্রেণির মানুষের জন্য। ব্যবসায়ী ও বিক্রেতারা অতি মুনাফার লোভ সংবরণ করবেন, কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি থেকে বিরত হবেন। ভোক্তা ও ক্রেতারা অহেতুক অধিক পরিমাণে পণ্য ক্রয় থেকে বিরত থাকবেন। সরকার ও প্রশাসন জনকল্যাণে ব্রতী হবেন। তবেই রমাদানের উদ্দেশ্য সফল হবে। রহমতের অফুরন্ত ফল্গুধারা প্রবাহিত হবে। রহমত, মাগফিরাত ও নাজাত লাভ হবে।

রমাদানে সিয়াম বা রোজার পূর্ণতার সহায়ক ও পরিপূরক আমল হলো নিয়মিত ২০ রাকাত তারাবিহ সালাত আদায় করা, সাহ্‌রি খাওয়া, ইফতার করা, কোরআন মজিদ তিলাওয়াত করা এবং রমাদানের শেষ দশকে ইতিকাফ করা। বিশেষত, অপ্রয়োজন বাক্যালাপ, বেহুদা-অযথা সংলাপ থেকে বিরত থাকা অপরিহার্য।

সিয়াম সাধনার উদ্দেশ্য হলো যাতে ধনীরা অভাবী মানুষের ক্ষুধার যন্ত্রণা উপলব্ধি করতে পারেন। তাই রমাদানকে ভোজের আয়োজনে পরিণত করা উচিত নয়। পানাহারের প্রতি এত বেশি মনোযোগী না হওয়া, যাতে ইবাদতে বিঘ্ন সৃষ্টি হয়। সামর্থ্যবানেরা এত বেশি পরিমাণে বাজার না করা, যাতে গরিব মানুষ কেনার সুযোগ থেকে বঞ্চিত হয়। এসব রমাদানের শিক্ষার ও উদ্দেশ্যের পরিপন্থী। বরং আমাদের আশপাশে প্রতিবেশী ও আত্মীয়স্বজন যাঁরা অভাবী আছেন, তাঁদের ইফতার-সাহ্‌রির ব্যবস্থা করা আমাদের সবার ইমানি কর্তব্য।

প্রিয় নবীজি (সা.) বলেন, ‘যে ব্যক্তি কোনো রোজাদারকে ইফতার করাবে, তার গুনাহ মাফ হয়ে যাবে, সে জাহান্নাম থেকে মুক্তি লাভ করবে এবং রোজাদারের সওয়াবের সমপরিমাণ সওয়াব সে লাভ করবে। তবে ওই রোজাদারের সওয়াব কম করা হবে না।’

সাহাবায়ে কিরাম বলেন, হে আল্লাহর রাসুল (স.)! আমাদের অনেকেরই রোজাদারকে ইফতার করানোর সামর্থ্য নেই। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, পানিমিশ্রিত এক পেয়ালা দুধ বা একটি খেজুর অথবা এক ঢোঁক পানি দ্বারাও যদি কেউ কোনো রোজাদারকে ইফতার করায়, তাতেও সেই পরিমাণ সওয়াব পাবে। আর যে ব্যক্তি কোনো রোজাদারকে তৃপ্তিসহকারে আহার করাবে, আল্লাহ তাআলা তাকে আমার হাউসে কাউসার থেকে এমন পানীয় পান করাবেন, যার ফলে সে জান্নাতে প্রবেশ করার পূর্ব পর্যন্ত তৃষ্ণার্ত হবে না। (মুসনাদে আহমাদ)

হজরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা.) বর্ণনা করেন, ‘রাসুলুল্লাহ (সা.) ছিলেন সব মানুষের মধ্যে সবচেয়ে বড় দানশীল ব্যক্তি। যখন রমাদান মাস আসত, তখন জিবরাইল (আ.) প্রতি রাতে নবীজি (সা.)-এর কাছে আসতেন, কোরআনের তালিম করতেন, তখন রাসুলুল্লাহ (সা.) প্রবাহিত বায়ু অপেক্ষা অধিক হারে দান-খয়রাত করতেন।’ (বুখারি: ৪৭১১, মুসলিম: ২৩০৮)

● মুফতি মাওলানা শাঈখ মুহাম্মাদ উছমান গনী

যুগ্ম মহাসচিব, বাংলাদেশ জাতীয় ইমাম সমিতি; সহকারী অধ্যাপক, আহ্ছানিয়া ইনস্টিটিউট অব সুফিজম

smusmangonee@gmail.com