মোটরসাইকেল পার্ক করে ফুটপাত বন্ধ করে দেওয়া হয় যেখানে-সেখানে
মোটরসাইকেল পার্ক করে ফুটপাত বন্ধ করে দেওয়া হয় যেখানে-সেখানে

ঢাকার ফুটপাত সবার, শুধু পদচারী ছাড়া

চারপাশে সব যুগান্তকারী ঘটনা। কোভিডের প্রকোপ শেষ না হতেই ইউক্রেন যুদ্ধ; এর মধ্যে আবার শ্রীলঙ্কায় ভয়াবহ সংকট, বিশ্বব্যাপী মন্দা, জ্বালানি সমস্যা। আছে পদ্মা সেতু নিয়ে উৎসব ও দ্রব্যমূল্যে নাভিশ্বাস। আর সেই সঙ্গে আছে অর্থমন্ত্রীর আশ্বাস—মূল্যস্ফীতি নিয়ে আতঙ্কের কিছু নেই। আছে হাজার হাজার কোটি টাকা ক্যাপাসিটি চার্জ দিয়ে অবশেষে লোডশেডিং, নতুন সিইসির তলোয়ার বনাম রাইফেল, মেট্রোরেলের ব্যয় এক ধাক্কায় দেড় গুণ। এত সব আকর্ষণীয় ইস্যুর ভিড়ে ফুটপাতের মতো অনুজ্জ্বল বিষয় উত্থাপন রসভঙ্গের কারণ হতে পারে। তবু আমার মনে হলো এ নিয়ে লেখা যায়।

ফুটপাতের সঙ্গে আমার পরিচয় ১১ বছর বয়সে। অজগাঁও থেকে রংপুর গেছি বেড়াতে, আমার প্রথম শহর দেখা। পিচঢালা রাস্তার পাশ ধরে ফুট চারেক চওড়া একটু উঁচু কংক্রিটের পথ। হাঁটতে গেলে রিকশা বা গাড়ি এসে গায়ে পড়ার ভয় নেই। শিখলাম, ফুটপাত শুধুই পদচারীদের জন্য।

ভ্রমণের নেশা আমাকে পৃথিবীর অনেক শহরে নিয়ে গেছে, আর অনিবার্যভাবে হেঁটেছি সে সব শহরের ফুটপাতে। বেশির ভাগ শহরেই ফুটপাতে হাঁটা এক অনাবিল আনন্দের ব্যাপার। যেখানেই মানুষ বেশি, সেখানেই ফুটপাত চওড়া। অনেক জায়গায়, বিশেষ করে নগর কেন্দ্রে, প্রায়ই দুই পাশের ফুটপাত মিলিয়ে মধ্যে গাড়ি চলাচলের রাস্তার চেয়ে বেশি চওড়া। অনেক ফুটপাত (এবং রাস্তাও) টুকরো পাথর বসিয়ে তৈরি, সাধারণ কংক্রিটে ঢালাই করা ফুটপাতই অবশ্য বেশি। পাথর সিমেন্ট মিশিয়ে পুরু শক্ত অমসৃণ ব্লক দিয়ে তৈরি ফুটপাতও আছে। তবে সব ক্ষেত্রেই সামনে তাকিয়ে স্বচ্ছন্দে হাঁটা যায়, গর্তে পরে পা মচকানোর ভয়ে বা অনাকাঙ্ক্ষিত কিছুতে পা দিয়ে ফেলা এড়াতে নিচে তাকিয়ে থাকতে হয় না।

ঢাকার ফুটপাত সম্পূর্ণ অন্য এক জগৎ। দখলের যে সংস্কৃতি আমাদের সমাজে সুপ্রতিষ্ঠিত, তার সবচেয়ে নিকৃষ্ট উদাহরণ সম্ভবত ফুটপাত। পুরো ফুটপাত দখল করে রান্না এবং বেঞ্চ-টেবিল পেতে খাওয়ার ব্যবস্থা যত্রতত্র। তথাকথিত অভিজাত আবাসিক এলাকা গুলশান, বনানীরও মুক্তি নেই এ থেকে। আর আছে গাছ। প্রাকৃতিক বন ধ্বংস করে ফুটপাতে বেশি করে গাছ লাগিয়ে আমরা বনায়নে বাহবা দিচ্ছি নিজেদের। পাঁচ ফুট চওড়া ফুটপাতের মাঝখানে গাছ দখল করেছে দুই ফুট, কোনো পাশ দিয়ের সহজভাবে পার হওয়ার উপায় নেই। এক সরু ফুটপাতে দেখলাম দুই সারি গাছ। আশপাশের বাড়ির বাসিন্দারাও কম যান না। ১২ কাঠার প্লটে ঠেসে বিল্ডিং বানিয়ে বাগান করার শখ মেটাচ্ছেন পাশের ফুটপাতে। সারি বাঁধা টব তো আছেই, নারকেল, কলাগাছও লাগিয়েছেন কেউ। এক ভদ্রলোক তো এসবের তোয়াক্কা না করে তাঁর গেটের পাশে ফুটপাত পুরো বন্ধ করে মার্বেল পাথর দিয়ে বাঁধিয়ে আড়াআড়ি ফুলের বেড করে দিয়েছেন চমৎকার।

এসবই হয়তো অরণ্যে রোদন। কারণ, এর কোনোটিতেই সিদ্ধান্ত গ্রহণকারীদের তেমন কোনো স্বার্থ নেই। তারপরও, যে বিপুলসংখ্যক মানুষ ফুটপাতে হাঁটেন, তাঁদের একটু স্বস্তি দেওয়া যদি প্রয়োজন মনে করেন তাঁদের কেউ কখনো, সেই আশায় আমার এই নিবেদন।

মোটরসাইকেল পার্ক করে ফুটপাত বন্ধ করে দেওয়া হচ্ছে যেখানে-সেখানে। কোথাও কোথাও ফুটপাতজুড়ে একটি গাড়ি দাঁড়িয়ে আছে, এমনও দেখা যায়। রাস্তায় জ্যাম লাগলে ফুটপাতে মোটরসাইকেল চালানো তো মামুলি ব্যাপার। পদচারীদের দায়িত্ব পাশে সরে গিয়ে জায়গা করে দেওয়া।

বাংলাদেশে আসা রাষ্ট্রদূতদের আমরা বেশ আদরযত্ন করি, এতে দোষের কিছু নেই। তাঁদের বাড়ির নিরাপত্তায় যে পুলিশচৌকি বসানো হয়, প্রায়ই তা হয় ফুটপাত বন্ধ করে। পৃথিবীর কোথাও এটা নেই। বেশির ভাগ দেশে এলাকার নিরাপত্তা বিধান করা হয় সম্পূর্ণ অলক্ষ্যে, আলাদাভাবে বাড়ি পাহারা দেওয়া হয় না।

১২ কাঠার প্লটে ঠেসে বিল্ডিং বানিয়ে বাগান করার শখ মেটাচ্ছেন পাশের ফুটপাতে

সবশেষে দেখা যাক কী দিয়ে বানায় ফুটপাত। সত্তরের দশকে সব ফুটপাত ছিল ইট বিছিয়ে তার ওপর কংক্রিটের ঢালাই। শক্তপোক্ত, ভাঙত না সহজে। আশির দশকে শুরু হলো বিভিন্ন পরীক্ষা-নিরীক্ষা, যা আজও চলছে। প্রথমে এল জিগজ্যাগ ব্রিক। পুরু এবং শক্ত, দেখতেও মন্দ নয়। তবে কোনো কারণে একটি উঠে গেলে আশপাশ ভাঙা শুরু হতো। এরপর যত দিন গেল, দুর্বল থেকে দুর্বলতর সামগ্রীর ব্যবহার চালু হলো, সেই সঙ্গে নিম্নমানের কাজ। প্রথমে যে টাইলস এল, সেগুলো তবু কিছুদিন টিকত। সাম্প্রতিক যে পাতলা চকচকে রঙিন টাইলস ব্যবহৃত হচ্ছে, এগুলো ফাটা–ভাঙা শুরু হয় কয়েক মাসের মধ্যেই। বৃষ্টিভেজা ফুটপাতে হাঁটতে গেলে পিছলানোর আশঙ্কাও ছিল সমূহ। তবে সৌভাগ্যক্রমে নিম্নমানের গ্লেস অনেকটাই উঠে গেছে মানুষের পায়ের ঘষায়।

এসব থেকে মুক্তি কি সম্ভব? সহজ সমাধান নেই কোনো কিছুরই। তবে ফুটপাতের ক্ষেত্রে প্রথমে যা প্রয়োজন, তা হচ্ছে এ বিষয় মেনে নেওয়া যে ফুটপাত মানুষের হাঁটার জন্য। দোকানদারি, হোটেল ব্যবসা, বেকারত্ব দূরীকরণ, যানবাহন পার্কিং বা বনায়নের জন্য নয়।

ফুটপাত থেকে দোকান সরাতে হবে প্রথমে। সবার আগে রেস্তোরাঁগুলো। দুপুরে প্যাকেট করা লাঞ্চ নিয়ে যেখানে চওড়া ফুটপাত, সেখানে দাঁড়াতে পারেন সীমিতসংখ্যক বিক্রেতা। ফ্লাস্ক থেকে তৈরি চা বিক্রি করতে পারেন কেউ কেউ। কিন্তু রান্নাবান্না, চেয়ার-টেবিল পেতে দিনভর দখল চলতে পারে না। আর আবাসিক এলাকায় যাঁরা অফিস, মার্কেট, স্কুল, বিশ্ববিদ্যালয়, হাসপাতাল খুলে বসেছেন, তাঁদের বাধ্য করতে হবে সব পর্যায়ের কর্মীদের জন্য সাশ্রয়ী মূল্যে নাশতা বা লাঞ্চের ব্যবস্থা রাখার। ফুটপাতে অন্যান্য মালামাল বেচাকেনা সম্পূর্ণ বন্ধ করতে হবে।

রাষ্ট্রদূতদের বাড়ির নিরাপত্তায় যে পুলিশচৌকি বসানো হয়, প্রায়ই তা হয় ফুটপাত বন্ধ করে

ফুটপাতে যে কয়েক লাখ লোক জীবিকা নির্বাহ করেন, তাঁদের প্রসঙ্গ উঠবে। সারা দেশে কৃষিশ্রমিকের অভাব, পোশাককর্মী পাওয়া যাচ্ছে না মন্ত্রীরা বলছেন। ফুটপাতে দোকানদারি বন্ধ হলে বিকল্প কাজ খুঁজে নেবে মানুষ। ছয় ফুট বা তার কম চওড়া ফুটপাতের সব গাছ কেটে ফেলতে হবে। ছয় থেকে দশ ফুট চওড়া হলে এক সারি গাছ থাকতে পারে যেকোনো এক পাশে। আর বাড়ির মালিকদের শখের বাগান সম্পূর্ণ উচ্ছেদ করতে হবে ফুটপাত থেকে।

ফুটপাত ভাঙছে কি না কোথাও, সিটি করপোরেশনকে তা নিয়মিত পর্যবেক্ষণ করতে হবে এবং ভাঙার শুরুতেই মেরামত করতে হবে। ভেঙে গেছে যেসব ফুটপাত, সেগুলোতে বাহারি টাইলসের বিলাসিতা বাদ দিতে হবে। এরপর থেকে ফুটপাত হোক পাথর, সিমেন্টের তৈরি শক্ত কংক্রিটের। রাষ্ট্রদূতের গেটের পাশে যদি পুলিশ বক্স লাগেই, তার বড় অংশ হোক দেয়ালের ভেতর। বড়জোর দুই ফুট পরিমাণ বেরিয়ে থাকুক ফুটপাতে, যাতে নিরাপত্তাকর্মীরা দুই পাশে অবলোকন করতে পারেন।

এসবই হয়তো অরণ্যে রোদন। কারণ, এর কোনোটিতেই সিদ্ধান্ত গ্রহণকারীদের তেমন কোনো স্বার্থ নেই। তারপরও, যে বিপুলসংখ্যক মানুষ ফুটপাতে হাঁটেন, তাঁদের একটু স্বস্তি দেওয়া যদি প্রয়োজন মনে করেন তাঁদের কেউ কখনো, সেই আশায় আমার এই নিবেদন।
মো. তৌহিদ হোসেন সাবেক পররাষ্ট্রসচিব