গত মঙ্গলবার লেবাননে যে পরিস্থিতির অবতারণা হলো, তা দেখলে মনে হবে যেন কোনো জেমস বন্ড ছবি থেকে নেওয়া অদ্ভুত দৃশ্য। দেশজুড়ে শত শত হিজবুল্লাহ যোদ্ধাদের পকেটে থাকা পেজার একযোগে বিস্ফোরিত হওয়া শুরু হলো। সাইবার যুদ্ধের সঙ্গে নাশকতা মিলিয়ে ইসরায়েল এই আক্রমণ করেছে।
তবে বাস্তব জীবনে ঘটা এই রোমাঞ্চ উপন্যাসের পরবর্তী অধ্যায় কে লিখবে—হিজবুল্লাহ, না ইসরায়েল? ইসরায়েলি কর্তৃপক্ষ মঙ্গলবার রাতে পাল্টা আক্রমণের জন্য প্রস্তুত হচ্ছিল। এই আক্রমণ এক সর্বাত্মক আঞ্চলিক যুদ্ধ শুরু করে দিতে পারে। এই যুদ্ধ এড়িয়ে যেতে আমেরিকানরা চেষ্টা করছিল এক বছর ধরে।
ইসরায়েল মঙ্গলবারের আক্রমণের দায় নেয়নি এখনো। তার প্রয়োজনও নেই। লেবাননের ভেতরে এমন চতুর, পরিশীলিত আর দুঃসাহসী আক্রমণ আর কোন দেশ করবে? ভিডিওতে দেখা গেছে, হিজবুল্লাহ যোদ্ধারা নিজেদেরই যোগাযোগ ডিভাইসের বিস্ফোরণে ছিটকে গিয়ে পড়েছেন মেঝেতে। এ ছিল ইরান-সমর্থিত হিজবুল্লাহর জন্য ইসরায়েলিদের দেওয়া এক অব্যর্থ বার্তা—‘তোমরা যেখানে যাও, আমরা সেখানেই যেতে পারি।’
গত মঙ্গলবারই সাক্ষাৎকারে একজন বললেন, ‘হিজবুল্লাহ যখন বিবেচনা করে যে সে কীভাবে প্রতিক্রিয়া দেখাবে, তখন তাদের হিসাবে রাখা উচিত যে ইসরায়েল হয়তো তাদের জন্য আরও বিস্ময় জমা রেখেছে। আর আসলেও তা-ই।’ কথাগুলো যিনি বলেছেন, তিনি ইসরায়েলিদের ভাবনার ধরন-ধারণ সম্পর্কে ভালোমতোই ওয়াকিবহাল।
বাইডেন প্রশাসন লেবাননে এই আক্রমণের পর দেরি না করেই জানিয়েছে যে তাদের আগাম কোনো কিছু জানানো হয়নি। বোঝাই যায় তারা এ ঘটনা থেকে নিজেদের নিরাপদ দূরত্বে রাখতে চায়।
প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন আর ভাইস প্রেসিডেন্ট কমলা হ্যারিসের জন্য এই আক্রমণটা খুব খারাপ সময়ে হলো। আর মাত্র দুই মাসেরও কম সময়ের পর আমেরিকায় নির্বাচন। এ সময় পরিস্থিতির এমন অবনতি আর বিস্মৃত এক যুদ্ধের ঝুঁকি ভালো কথা নয়। গাজায় যুদ্ধবিরতি আর ইসরায়েলি জিম্মিদের মুক্তির প্রসঙ্গটি এই একঝটকায় ভেঙে পড়তে পারে।
আমেরিকান কর্মকর্তারা মঙ্গলবার একটি গোপন মাধ্যমে ইরানের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করছিলেন। উদ্দেশ্য ছিল এ কথা জানানো যে এই হামলায় যুক্তরাষ্ট্রের কোনো ভূমিকা নেই। তাদের প্রশাসনের ধারণা, আপাতত হিজবুল্লাহ বিভ্রান্ত ও আতঙ্কিত। এখনই তারা কোনো পাল্টা সামরিক জবাব দেবে না। যদি কোনো হামলা হয়, মার্কিন কর্মকর্তারা বিশ্বাস করেন যে ইসরায়েল সেই ক্ষয়ক্ষতি সামলে নিতে পারবে। এবং প্রয়োজনে যুক্তরাষ্ট্র ইসরায়েলকে রক্ষা করতে সাহায্য করবে।
আপাতদৃষ্টে ইসরায়েলের এই হামলা চালানোর সিদ্ধান্ত সম্ভবত রাজনৈতিক এবং অপারেশনাল উভয় কারণ বিবেচনা করেই নেওয়া হয়েছে। মার্কিন নেতৃত্বাধীন যুদ্ধবিরতি পরিকল্পনা স্থবির হয়ে আছে। সেই সঙ্গে স্থবির সীমান্ত শান্ত করার জন্য হিজবুল্লাহর সঙ্গে কোনো কূটনৈতিক চুক্তির আশা।
হিজবুল্লাহর যোগাযোগ যন্ত্রগুলোকে বোমায় পরিণত করার এই অসাধারণ ক্ষমতা যে ইসরায়েলের আছে, তা কেউ বোঝার আগে বা পেজারগুলো চালু থাকতেই ইসরায়েল ব্যবহার করতে চেয়েছে। গত মঙ্গলবার রাতে মধ্যপ্রাচ্যভিত্তিক সংবাদ সংস্থা আল-মনিটর এমনটিই জানিয়েছে।
ইসরায়েলের হিজবুল্লাহকে কঠোরভাবে আঘাত করার অভিপ্রায় একটা স্পষ্ট দিক উন্মোচন করছে। তারা মনে করে, লেবাননের মিলিশিয়া সদস্যদের সঙ্গে দীর্ঘস্থায়ী যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়ার সামর্থ্য তাদের নেই। যদিও ইসরায়েল কার্যকরভাবে গাজায় হামাসকে সামরিক দিক দিয়ে নিরস্ত করেছে, কিন্তু হিজবুল্লাহ উত্তর ইসরায়েলের বিরুদ্ধে তার রকেট হামলা অব্যাহত রেখেছে। ৬০ হাজারের বেশি ইসরায়েলি নাগরিক উত্তরে তাদের বাড়িঘর খালি করে স্থানান্তরিত হতে বাধ্য হয়েছে।
উত্তর ইসরায়েলের এই সমস্যা মোকাবিলা করার জন্য ইসরায়েলের ভেতর রাজনৈতিক চাপ বাড়ছে। সেই চাপ জিম্মিদের স্বাধীনতার আকাঙ্ক্ষার মতোই তীব্র হয়ে উঠেছে। ‘লেবানন এবং উত্তর ইসরায়েলের প্রসঙ্গে ইসরায়েলে এই কথা সবাই বলে যে—কিছু একটা করা দরকার’, এ কথা বলেছেন আমাদের আগে উল্লিখিত ওয়াকিবহাল ব্যক্তি। তিনি আরও উল্লেখ করেছেন যে সোমবার ইসরায়েলি মন্ত্রিসভা তার যুদ্ধের লক্ষ্যগুলোর তালিকায় একটি নতুন লক্ষ্য যুক্ত করেছে—লেবাননের সীমান্তের কাছে ইসরায়েলিদের তাদের বাড়িতে ফিরিয়ে আনা।
পেজার আক্রমণ শুধু চাতুর্যের কারণে উল্লেখযোগ্য নয়। এ আক্রমণ হিজবুল্লাহর গোপন সরবরাহ চেইনে ইসরায়েলের অনুপ্রবেশ করার সামর্থ্যের কথা জানিয়ে দিয়েছে। হিজবুল্লাহ নেতা হাসান নাসরুল্লাহ ফেব্রুয়ারিতে একটি বক্তৃতায় তার যোদ্ধাদের সেলফোন ব্যবহার বন্ধ করার কথা বলেছিলেন। এই সেলফোন হিজবুল্লাহর সবার জন্য ‘অক্সিজেনের মতো’ হয়ে গেছে। কিন্তু সেলফোনগুলো যোদ্ধাদের অবস্থান প্রকাশ করে দেয় এবং কখনো কখনো কাজ করে ইসরায়েলি গুপ্তচরবৃত্তির যন্ত্র হিসেবে।
নাসরুল্লাহ বলেছিলেন, ‘ইসরায়েলের আর আমাদের ভেতরে তাদের লোক দরকার নেই। তাদের নজরদারির যন্ত্রগুলো আপনি নিজেই আপনার পকেটে নিয়ে ঘুরছেন। ইসরায়েলি এজেন্ট খুঁজতে হলে আপনার নিজের হাতের, আপনার স্ত্রী, সন্তানের হাতের মুঠোফোনের দিকে তাকান’। নাসরুল্লাহ জানেন মুঠোফোন সিগন্যাল পাঠায় বাণিজ্যিক টাওয়ারে, যা সহজেই আটকে ফেলা যায়।
এরপর হিজবুল্লাহ দ্রুত নিজের সামরিক নেটওয়ার্ক রক্ষা করতে সদস্যদের বিশেষ পেজার সরবরাহ করে। এই পেজার এমন সিস্টেম ব্যবহার করে, যা ভাঙা কঠিন। মিলিশিয়ারা নিশ্চয়ই ভাবতেও পারেনি যে ইসরায়েলি এজেন্টরা তাদের পেজার সরবরাহের সাপ্লাই চেইনে ঢুকে পড়বে। তবে সম্ভবত তাই ঘটেছে, এ কথা আমাকে জানিয়েছেন একজন আমেরিকান সাইবার বিশেষজ্ঞ। হিজবুল্লাহ মঙ্গলবার রাতে তার যোদ্ধাদের বার্তা পাঠিয়েছে, ‘যারাই নতুন পেজার পেয়েছেন, এখনই ফেলে দিন।’
মঙ্গলবার দুপুর সাড়ে তিনটার সময় পেজারগুলো বিস্ফোরিত হলো কেন? বৈরুতের হাসপাতালগুলো প্রায় ২ হাজার ৮০০ হতাহতের ভিড়ে হিমশিম খেল। তখন বেশ কয়েকজন আমেরিকান বিশ্লেষক আমাকে জানিয়েছেন যে তাদের প্রাথমিক সন্দেহ, ইসরায়েলি ম্যালওয়্যার পেজারগুলোর লিথিয়াম ব্যাটারি বিস্ফোরণ ঘটিয়েছে।
কিন্তু পেজার বিস্ফোরণের কয়েকটা ভিডিও দেখে এই ধারণা ঠিক বলে মনে হলো না। লিথিয়াম ব্যাটারি বিস্ফোরিত হওয়ার আগে খুব গরম হয়ে যায়। এত গরম যে কেউ তা পকেটে বেশিক্ষণ রাখতে পারবে না। কিন্তু ভিডিওগুলো দেখে মনে হয়েছে বিস্ফোরণের আগেই ধোঁয়া আর আগুন দেখা গেছে।
আমেরিকান সূত্র আমাকে জানিয়েছে, সম্ভবত ইসরায়েলি এজেন্ট পেজারগুলো সরবরাহ করার আগেই সেগুলোর নাগাল পাওয়ার ব্যবস্থা করে সেখানে অল্প পরিমাণে খুব শক্তিশালী বিস্ফোরক ঢুকিয়ে দিয়েছে। পেজারগুলোর অপারেটিং সিস্টেমের মধ্যে ম্যালওয়ারের ব্যবস্থাও করেছে তারা। যাতে নির্দিষ্ট কোনো নম্বর থেকে কল গেলে বা বিশেষ কোনো সিগন্যাল গেলে ট্রিগার হয়ে বিস্ফোরক তার কাজ করে। এগুলো হচ্ছে, পেজার বিস্ফোরণের ভিডিও দেখে, বিস্ফোরণের ধরন থেকে পাওয়া বিশেষজ্ঞদের মতামত।
পুরো ব্যাপারটার কারিগরি ব্যাপারের দিকে যদি তাকান, তাহলে আপনাকে মানতে হবে যে এই অপারেশন খুব বুদ্ধিমত্তার সঙ্গে সংগঠিত হয়েছে। এই অপারেশনের লক্ষ কে? হিজবুল্লাহর সামরিক নেটওয়ার্কের সঙ্গে যুক্ত প্রত্যেকে। এই অপারেশন টার্গেটের মধ্যে খুব সম্ভবত লেবাননের ইরানি রাষ্ট্রদূতও ছিলেন। আক্রমণ সংগঠিত হওয়ার পর এক ভিডিওতে ইরানি রাষ্ট্রদূতকে আহত অবস্থায় হাসপাতালে ঢুকতে দেখা গেছে।
হিজবুল্লাহ নেটওয়ার্ক এখন তাদের অভ্যন্তরীণ বিশেষ যোগাযোগব্যবস্থা হারিয়েছে। ইসরায়েলিদের কাছে সম্ভবত এখন হিজবুল্লাহর নম্বরগুলো আছে। চাইলেই তারা নিরাপদে থাকা হিজবুল্লাহ যোদ্ধাদের কাছে সতর্কবার্তা পাঠাতে পারে যে প্রতিশোধ নেওয়ার চেষ্টা করলে তারাও টিকবে না। বোঝাই যাচ্ছে, পেজার দিয়ে যে আক্রমণ ইসরায়েল ঘটাল, তার অর্থ বহুমাত্রিক। এই বিস্ফোরণ শুধু পেজারে ঘটেনি। এটা ইসরায়েলি কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে হিজবুল্লাহর জন্য এক গুরুত্বপূর্ণ বার্তা।
সাইবার যুদ্ধ এখন প্রচলিত যুদ্ধের ময়দানকে অনেক বড় করে দিয়েছে। আর মঙ্গলবারের এই পেজার দিয়ে বিস্ফোরণ সাইবার যুদ্ধের নতুন এবং অত্যন্ত বিপজ্জনক এক যুগের সূচনার ইঙ্গিত দিয়েছে। ইন্টারনেট এখন পৃথিবীর অধিকাংশ মানুষের প্রাত্যহিক জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ। আর এখন ইন্টারনেটের সঙ্গে সংযুক্ত যেকোনো ডিভাইস সম্ভাব্য অস্ত্রে রূপান্তরিত হতে পারে।
হাতে হাতে এখন স্মার্ট ডিভাইস আছে। ঘরে ঘরে প্রাত্যহিক কাজে ব্যবহার হয় স্মার্ট অ্যাপ্লায়েন্স। সেগুলো ইন্টারনেটের সঙ্গে যুক্ত হয়, ইন্টারনেট দিয়ে পরিচালিত হয়। আমাদের এসব স্মার্ট গ্যাজেটের সার্কিটগুলো ব্যবহার করে দক্ষ কেউ সেগুলোকে বিপজ্জনক উপায়ে ব্যবহার করতে পারে।
ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচির বিরুদ্ধে স্টাক্সনেটের সাইবার আক্রমণ এমনভাবে ম্যালওয়্যার ব্যবহার করেছিল যে সেন্ট্রিফিউজগুলো ঘুরতে ঘুরতে নিয়ন্ত্রণহীন হয়ে যায়। ভবিষ্যতে বিধ্বংসী অস্ত্রের ব্যবহার করতে মাধ্যম হয়ে যেতে পারে আপনার ফোন, রেফ্রিজারেটর বা টেলিভিশন।
অস্ত্রপ্রযুক্তি নিয়ে গবেষণার অন্ত নেই। এর অগ্রগতি তাই ঘটে দ্রুত। প্রতিটি নতুন অগ্রগতির সঙ্গে, অস্ত্র নকশাকারীরা মনে করেন যে যে তাদের নকশা করা মারাত্মক অস্ত্রগুলো কেবল তারাই একচেটিয়াভাবে ব্যবহার করবেন। যুক্তরাষ্ট্রের একসময় ড্রোনের ওপর একচেটিয়া আধিপত্য ছিল। কিন্তু এই ড্রোন এখন পৃথিবীতে সবচেয়ে ব্যাপক ব্যবহৃত যুদ্ধাস্ত্র। এমনকি দুঃসাহসী জেমস বন্ডেরও জানা থাকা উচিত যে তার ব্যবহার করা অস্ত্র শত্রুরা কখন তার বিরুদ্ধে ব্যবহার শুরু করে দেয়, কেউ জানে না।
ডেভিড ইগনাশিয়াস ওয়াশিংটন পোস্ট-এর কলাম লেখক, ঔপন্যাসিক।
ওয়াশিংটন পোস্ট থেকে নেওয়া, ইংরেজি থেকে অনুবাদ জাভেদ হুসেন