‘বহু বছরের কঠিন পরীক্ষার পর আমি এ সিদ্ধান্তে পৌঁছেছি যে “নতুন বছর”, “নতুন বছর” বলে খুব হইচই করার কিস্যু নেই। যখনই “নতুন বছর” এসেছে, এক বছরের বেশি টেকেনি।’ শিবরাম চক্রবর্তী বলে গেছেন। মন্দ বলেননি। তবে চিরকাল এ কথাও শুনে এসেছি, হায় হায় ডিসেম্বর এসে গেছে, এই বছরটা কীভাবে চোখের পলকে চলে গেল! বছরটা দ্রুত চলে যায়, নাকি আমাদের চোখ পলক ফেলতে ১১ মাস সময় নেয়, সেটা একটা প্রশ্ন বটে।
আমাদের একটা সাধারণ প্রবণতা হলো এ কথা বলা যে আগের মতো কিছুই হচ্ছে না। দাদা–দাদিরা নাতি-নাতনিদের বলেন, ‘তোরা আর কী পেলি, কী খেলি, কী দেখলি! পেয়েছিলাম আমরা, খেয়েছিলাম আমরা, দেখেছিলাম আমরা! আমাদের সময়ে! উফ, তখনকার মাছ ছিল ইয়া বড়, সবজিতে ছিল স্বাদ, আম কেনা হতো শ ধরে, ১৩২টায় এক শ। খেতে পারতাম আমরা! আমাদের বিয়েবাড়িতে এমন লোক ছিল, দুই সের ভাত খেয়ে উঠে একটা বুকডন দিয়ে ৪০টা রসগোল্লা সাবাড় করে ফেলত!’ জিহ্বা-সিঞ্চনী বর্ণনা আছে তপন রায় চৌধুরীর বাঙালনামায়—‘ট্রাকে করে মাছ আসত। সেই ট্রাক থেকে নামানোর পরও যা অবশিষ্ট থাকত, তাতে কয়েক বালতি ছোট মাছ পাওয়া যেত। ঠাকুরমা সেগুলো রান্নাঘরে পাঠিয়ে বলতেন, ধনেরা খাইব!’
কিন্তু আমি আমার ক্ষুদ্র জীবনে দেখছি, সময় ক্রমাগতভাবে ভালো আসছে। অন্তত বাংলাদেশে। আমাদের ছোটবেলায় দেখেছি, মানুষ কার্তিক মাসে না খেয়ে থাকত, আধপেটা খেত, কোনো কোনো রাতে ঘুমাতে যেত খালি পেটে। বেশির ভাগ মানুষের পায়ে জুতা বা স্যান্ডেল থাকত না। আমরা ছোটবেলায় খালি পায়েও স্কুলে গেছি। আমাদের বন্ধুদের অনেকেই স্কুলে গেছে লুঙ্গি পরে। এখন আমি অজপাড়াগাঁয়ে শীতের সন্ধ্যায় সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে দেখি, একজন তরুণ-যুবাও নেই, যার পরনে লুঙ্গি আছে, সবাই জিনসের প্যান্ট পরা। সবার হাতে মুঠোফোন।
২০২২ সাল আমরা শুরু করেছিলাম বেশ হইহুল্লোড় করে। পদ্মা সেতুর উদ্বোধন আমাদের সাহস আর সম্ভাবনা সত্যিই বাড়িয়ে দিয়েছে। পৃথিবীর সবচেয়ে বড় এবং খেয়ালি নদীর ওপর এই সেতু নির্মাণ ছিল ইঞ্জিনিয়ারিং চ্যালেঞ্জ। নদী শাসন করতে হয়েছে বৃহত্তম, পাইল বসানোর হ্যামারটা বানাতে হয়েছে পৃথিবীর মধ্যে সবচেয়ে বড় আর নদীর গভীরে পাইল বসাতে গিয়ে নতুন সমস্যায় পড়ে হাতের আঙুলের মতো করে পাইলের নিচটাকে বানাতে হয়েছে। এখন তিন/চার ঘণ্টায় লোকে খুলনা-ঢাকা যাতায়াত করছে। এরপর হলো, শতভাগ বিদ্যুতায়নের উৎসব। ঠিক তারপরই ডলারের দাম বেড়ে যেতে লাগল, বিদেশি মুদ্রার রিজার্ভ কমতে লাগল আশঙ্কাজনকভাবে আর স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী বলতে লাগলেন, ‘খাদ্য উৎপাদন বাড়ান, দুর্ভিক্ষ ঠেকান।’ কারণ, ইউক্রেন-যুদ্ধ এবং নিষেধাজ্ঞা। আমরা আবার লোডশেডিং দেখতে শুরু করলাম। সব বড় বড় আর্থিক প্রতিষ্ঠান এবং গবেষকেরা বলছেন, ২০২৩ সালে বিশ্বের আর্থিক খাত খারাপ যাবে। মন্দা অব্যাহত থাকবে। মুদ্রাস্ফীতি জনজীবনকে নাকাল করবে। ইউরোপ-আমেরিকারই অবস্থা খারাপ। তারা খারাপ থাকলে তার প্রতিক্রিয়া আমাদের ওপরও পড়তে বাধ্য। এ অবস্থায় ২০২৩ নিয়ে আশাবাদী হবেন কী করে? তার ওপর যখন খবরে পড়ি, হাজার কোটি টাকা ব্যাংক থেকে তুলে নিয়ে পগাড় পার হচ্ছে ঠিকানাবিহীন সংস্থা, তখন মনে হয় হুমায়ুন আজাদের উক্তি, ‘এখন প্রকৃত আশাবাদীর পক্ষে আর কোনোই উপায় নেই কেবল হতাশ হওয়া ছাড়া।’
কিন্তু হতাশ হব না। ২০২০-২১ সালে করোনায় তো বাংলাদেশের শেষ হয়ে যাওয়ার কথাই ছিল। ঘনবসতির দেশ। ঘর নেই, ঘরে থাকব কী করে? করোনার কালে রাস্তায় রাস্তায় লাশ পড়ে থাকবে, এই ছিল আশঙ্কা। কিন্তু সে রকম ঘটতে আমরা দেখেছি নিউইয়র্কে, শহর বিরান হতে দেখেছি স্পেনে, ইতালিতে। বাংলাদেশে আমরা টিকে গেলাম। আমাদের পোশাককারখানা যে সাহস করে খুলে দেওয়া হয়েছিল, টক শোবিদদের সমালোচনা সত্ত্বেও সেটা আমাদের অর্থনীতিকে বাঁচিয়ে দিয়েছে। আর বাঙালির টিকে থাকার অসম্ভব ক্ষমতা হারিয়ে দিয়েছে করোনাভাইরাসকে। প্রথম দিকে লোভী মানুষদের দাঁও মারার প্রবণতার পরপর সরকারও টিকাদান এবং নিযুত পরিবারকে মুঠোফোনে টাকা পাঠানোর মতো কর্মসূচি ভালোভাবেই সম্পন্ন করেছে। ২০২২ সালেও একবার মনে হলো, তাহলে কি যে তিমির, সেই তিমিরেই থেকে যাব। ২০২৩ সালের শুরুতে তো ভালো খবরও পাচ্ছি। ভিয়েতনামকে পেছনে ফেলে গার্মেন্টস রপ্তানির দ্বিতীয় স্থান পূর্ণদখল করা গেছে। এ মাসে প্রবাসী আয় বেড়েছে। রপ্তানি আয়ও বেড়েছে। ২০২৩ সালে আমরা হারব না। বাঙালি হারতে জানে না। কোনো না কোনো উপায় ঠিকই বের হয়ে যাবে যে বাংলাদেশ ভালো করার প্রকৃত উপলক্ষ ও পটভূমি পেয়ে যাবে।
গতস্য শোচনা নাস্তি। অতীতকে নিয়ে অনুশোচনা করতে নেই। ভবিষ্যতের ভাবনা ভাবাই জ্ঞানীর কাজ—‘ভবিষ্যতের মানুষ’ প্রবন্ধে লিখে গেছেন ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ। সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত পবিত্র কোরআন শরিফের সুরা আদ দোহা থেকে পদ্যানুবাদ করেছিলেন: ‘অতীতের চেয়ে নিশ্চয়ই ভালো হবে রে ভবিষ্যৎ।’ হাদিস শরিফে আছে, ‘তোমরা সময়কে গালি দিয়ো না, কারণ সময়ের নিয়ন্ত্রক হচ্ছে আল্লাহ তাআলা।’
গতস্য শোচনা নাস্তি। অতীতকে নিয়ে অনুশোচনা করতে নেই। ভবিষ্যতের ভাবনা ভাবাই জ্ঞানীর কাজ—‘ভবিষ্যতের মানুষ’ প্রবন্ধে লিখে গেছেন ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ। সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত পবিত্র কোরআন শরিফের সুরা আদ দোহা থেকে পদ্যানুবাদ করেছিলেন: ‘অতীতের চেয়ে নিশ্চয়ই ভালো হবে রে ভবিষ্যৎ।’ হাদিস শরিফে আছে, ‘তোমরা সময়কে গালি দিয়ো না, কারণ সময়ের নিয়ন্ত্রক হচ্ছে আল্লাহ তাআলা।’
গীতা বলছে, সবকিছুই পরিবর্তনশীল, একমাত্র স্থির হচ্ছে সময়।
পদার্থবিজ্ঞান সময় সম্পর্কে নতুন ধারণা দেয়। আইনস্টাইনের আপেক্ষিকতার তত্ত্ব থেকে জানি, সময় সব জায়গায় একই গতিতে যায় না। আর ‘ব্রিফ হিস্ট্রি অব টাইমস’–এ স্টিফেন হকিং বলছেন, সময়ের শুরু বিগব্যাং থেকে। সময় সব জায়গায় এক গতিতে প্রবাহিত হয় না। এক জোড়া জমজ শিশুর একজনকে সমুদ্রতটে আর একজনকে পাহাড়ের চূড়ায় রাখা হলে বহু বছর পর দেখা যাবে, দুই জনের বয়স দুই রকম। সময় ও নদীর স্রোত কারও জন্য অপেক্ষা করে না বটে, কিন্তু টাইম ডাইলুশেন করা গেলে সময়কে অপেক্ষা করানো যেতে পারে।
যে দশটা কারণে আপনি ২০২৩ নিয়ে আশাবাদী হতে পারেন, তার একটা তালিকা প্রণয়ন করা যাক।
এক. ২০২১ সালের তুলনায় বাংলাদেশ থেকে অভিবাসী কর্মী ২০২২ সালে বেড়েছে, যদিও রেমিট্যান্স কমেছে। ব্যাংকিং খাতে ডলারের দাম বাড়ানোর পর রেমিট্যান্স আবার বাড়তে শুরু করেছে। কাজেই ২০২৩ সালে রেমিট্যান্স বাড়বে বলে আশা করা যায়।
দুই. পোশাকশিল্পসহ খাতে রপ্তানি আয় বাড়তে পারে।
তিন. ২০২৪ সালে নির্বাচন হবে। ফলে সরকারকে জনবান্ধব কর্মসূচি দিতেই হবে। কাজেই জনগণের জন্য ২০২৩ হবে তুলনামূলকভাবে স্বাচ্ছন্দ্যময়।
চার. ২০২৩ সালে বিশ্বকাপ ক্রিকেট (ওডিআই) হবে ভারতে। সম্প্রতি আমরা ওডিআইতে সিরিজ জিতেছি ভারতের বিরুদ্ধে। এক দিনের ম্যাচে বাংলাদেশ ধারাবাহিকভাবে ভালো করছে। ২০২৩ সালে বিশ্বকাপ ক্রিকেটে খুব ভালো ফল আমরা আশা করতেই পারি।
পাঁচ. ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধ ২০২৩ সালে থেমে যেতে পারে। নিদেনপক্ষে একটা যুদ্ধবিরতি সূচিত হতে পারে। তা না হলেও ইউরোপ-আমেরিকার মূল্যস্ফীতি সামলাতেও একটা অর্থনৈতিক সমাধানে পৃথিবীকে আসতেই হবে।
ছয়. ক্যানসারের টিকা আবিষ্কৃত হতে পারে।
সাত. আণবিক ফিউশন করে সবুজ জ্বালানির পথ উন্মোচিত হয়েছে। বিনিয়োগ আসছে এই ক্ষেত্রে। বিকল্প সবুজ জ্বালানি এসে গেলে পৃথিবীর চেহারাই পাল্টে যাবে। এটা আসতে সময় নেবে। তবে সবুজ জ্বালানির জন্য গবেষণা ও বিনিয়োগ বাড়ছেই।
আট. যেভাবে আশঙ্কা করা হচ্ছে, আসলে রোবট মানুষের চাকরি খাবে না। বরং মানুষের জীবনকে সহজ করবে।
নয়. বৈদ্যুতিক উড়োজাহাজের যুগ এসে যাচ্ছে।
দশ. বাংলাদেশের সাধারণ মানুষের শক্তি। তারা এ দেশকে ফল, মাছ, দুধ, সবজি উৎপাদনে চ্যাম্পিয়ন করে রেখেছেন। শেষ পর্যন্ত তাদের শক্তিতেই ২০২৩ সালের মন্দা ও মঙ্গা বাংলাদেশকে কবজা করতে পারবে না।
তলস্তয়ের তিনটি প্রশ্ন (থ্রি কোশ্চেনস) গল্পে তিনটা প্রশ্ন করা হয়। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি কে, সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কাজ কী, সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সময় কোনটা। গল্পের শেষে আমরা উত্তর পেয়ে যাই। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি তিনিই, যিনি আপনার সামনে আছেন, সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কাজ হলো তার উপকার করা এবং সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সময় হলো ‘এখন’।
আসুন, এখনই আমাদের সামনে থাকা মানুষটার উপকারের জন্য আমরা একটা কিছু করি। সবাই যদি তা করেন, তাহলে পৃথিবী সুন্দর হবেই।
আনিসুল হক প্রথম আলোর সহযোগী সম্পাদক ও সাহিত্যিক