২০২২ সালে গণ-আন্দোলন ও গাজা যুদ্ধ শুরুর পর প্রথমবারের মতো ১ মার্চ ইরানে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হলো। এই ভোট পার্লামেন্ট ও অ্যাসেম্বলি অব এক্সপার্টস নির্ধারণী ভোট, যাদের কাজ হবে ইরানের শীর্ষ নেতা নির্ধারণ। এই নির্বাচনে দেশের বর্তমান নেতৃত্বের কাজের মূল্যায়নের কোনো ব্যাপার নেই। এর পেছনে অন্য কারণ আছে।
নির্বাচনের পর নেতা কে হয়েছেন, কে কত ভোট পেয়েছেন, তা ছাপিয়ে আলোচনায় এসেছে কতসংখ্যক মানুষ ভোট দিতে পারেননি সে বিষয়টি। যদি আমরা সরকারি হিসাবও মেনে নিই, তাহলে এবারের নির্বাচনে ১৯৭৯ সালের ইসলামিক রেভল্যুশনের পর সবচেয়ে কম ভোট পড়ল। মাত্র ৪১ শতাংশ মানুষ এবার ভোট দিয়েছেন।
ব্যালট বাক্সে ভোট বেশি পড়লেও লক্ষণীয় কোনো পরিবর্তন ঘটত না। ইরানের কট্টরপন্থী সরকার কখনোই অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের পথে হাঁটেনি। তারা কেবল এমন একটা আবহের জন্ম দিয়ে গেছে যে ভোট সুষ্ঠু হয়েছে। এবার সে চেষ্টাও ব্যর্থ হয়েছে।
বেশির ভাগ সংস্কার ও মধ্যপন্থী নেতাদের এবার নির্বাচনে অংশই নিতে দেওয়া হয়নি। প্রার্থী হিসেবে ইরানিরা যাঁদের পেয়েছেন, তাঁরা প্রত্যেকেই রক্ষণশীল ও কট্টরপন্থী এবং শীর্ষ নেতা আয়াতুল্লাহ খামেনির বশংবদ। তবে তাঁদের এই মতামত ও আনুগত্যের মাত্রায় কিছু পরিবর্তন আছে।
তবে এই ধারণা ভুল যে কট্টরপন্থীদের বিজয় ও রাজনৈতিক স্থবিরতা ইরানে দীর্ঘায়িত হবে। কারণ, নিজেদের ইসলামপন্থী হিসেবে ঘোষণা দেওয়ার পরও ইসলামিক রিপাবলিকের অনেক রাজনীতিবিদই আদর্শবাদী বা বিপ্লবী নন। তাঁরা টেকনোক্র্যাট অথবা পণ্ডিত। ক্ষমতার কাছাকাছি থাকতে আয়াতুল্লাহ খামেনির অনুগ্রহ চান।
আজকের ইরান অশীতিপর আয়াতুল্লাহ খামেনির নেতৃত্বে পরিচালিত। তাঁর মৃত্যুর পর ইরানের বিভিন্ন নীতিতে জোরদার পরিবর্তনের ইঙ্গিত পাওয়া যায়। ইরানে ক্ষমতার দৌড়ে থাকা প্রার্থীদের নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করলে দেখা যাবে, আয়াতুল্লাহ খামেনির মৃত্যুর পর তাঁরা এমন নীতি গ্রহণ করতে পারেন, যা জনগণ ও পশ্চিমাদের কাছে গ্রহণযোগ্য হবে।
এই সম্ভাবনা জোরালো হচ্ছে যে ইরান কট্টরপন্থীদের হাত থেকে একটি সামরিক কর্তৃত্বপরায়ণ সরকারের হাতে চলে যেতে পারে। অর্থাৎ একটি নতুন ইরান দ্বারে কড়া নাড়ছে বটে, তবে এই ইরান সেই ইরান নয়, যে ইরানের জন্য সরকারবিরোধীরা আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছেন।
আয়াতুল্লাহ খামেনির ৩৫ বছরের শাসনামলে ইরান অর্থনৈতিকভাবে একা হয়ে পড়েছে, সমাজে দমনমূলক ব্যবস্থা জারি হয়েছে এবং লেবানন, গাজা, ইয়েমেনসহ ইরাক অন্যান্য জায়গায় ইসলামপন্থী মিলিশিয়াদের প্রতি ইরানের সমর্থন বেড়েছে।
এসব কর্মকাণ্ডের ফল ভালো হয়নি, তবে ফলাফল যা–ই হোক না কেন, আয়াতুল্লাহ খামেনি ১৯৭৯ সালের বিপ্লবের যে আদর্শ, তাতে একচুলও ছাড় দিতে রাজি নন। আজকের ইরানে খুব কমসংখ্যক মানুষই এখন এই মূল্য চুকাতে প্রস্তুত।
গ্রেপ্তার ও শাস্তিকে তোয়াক্কা না করে লাখ লাখ মানুষ ২০২২–২৩ সালে হিজাব নীতির বিপক্ষে আন্দোলনে যুক্ত হয়। এই আন্দোলন ইরানের প্রধানতম নীতিগুলোর বিরুদ্ধে মানুষের ব্যাপক অসন্তোষের ইঙ্গিত দেয়।
ইরানের কট্টরপন্থী নীতি নিয়ে প্রশাসনের শীর্ষ পর্যায়ে মতবিরোধ পৌঁছেছে। ইরানের শীর্ষ কূটনীতিকরা এখন প্রকাশ্যে ইরানের পশ্চিমা বিরোধী নীতির সমালোচনা করছেন। তাঁরা মনে করেন, এই নীতির কারণে একের পর এক নিষেধাজ্ঞা এসে দেশটিকে পঙ্গু করে দিয়েছে এবং যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরায়েলের সঙ্গে বিরোধের পথকে সুগম করেছে। সাবেক কূটনীতিকদের অনেকেই ইউক্রেনের বিরুদ্ধে যুদ্ধে রাশিয়াকে সমর্থন দেওয়ার সমালোচনা করেছেন।
তা ছাড়া জীবনযাত্রার মান ক্রমে নিম্নমুখী হওয়ায় দেশের শ্রমজীবী মানুষ নিয়মিত বিক্ষোভ করছে। এমনকি দেশটির সুপ্রিম ন্যাশনাল সিকিউরিটি কাউন্সিল স্বীকার করেছে, দেশের অর্থনৈতিক দুরবস্থার কারণে সমাজের প্রতে৵ক মানুষের আস্থা ক্ষীণ হয়ে আসছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সাবেক গভর্নর সম্প্রতি বলেছেন, উন্নয়নমুখী কোনো কৌশল ইরান গ্রহণ করেনি। তিনি ইরানের অর্থনৈতিক দুরবস্থাকে ‘বিপর্যয়কর’ বলেও মন্তব্য করেন।
ইরানের কট্টরপন্থী নীতি নিয়ে প্রশাসনের শীর্ষ পর্যায়ে মতবিরোধ পৌঁছেছে। ইরানের শীর্ষ কূটনীতিকরা এখন প্রকাশ্যে ইরানের পশ্চিমা বিরোধী নীতির সমালোচনা করছেন। তাঁরা মনে করেন, এই নীতির কারণে একের পর এক নিষেধাজ্ঞা এসে দেশটিকে পঙ্গু করে দিয়েছে এবং যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরায়েলের সঙ্গে বিরোধের পথকে সুগম করেছে। সাবেক কূটনীতিকদের অনেকেই ইউক্রেনের বিরুদ্ধে যুদ্ধে রাশিয়াকে সমর্থন দেওয়ার সমালোচনা করেছেন।
সিরিয়া ও লেবাননের সাবেক একজন রাষ্ট্রদূত হিজবুল্লাহ ও হামাসের মতো গোষ্ঠীগুলো পেল্লায় হয়ে ওঠা নিয়ে তাঁর বিরক্তি প্রকাশ করেছেন। যদিও এই রাষ্ট্রদূতই মিলিশিয়াগুলোকে ইরান সরকারের ছাড় করা অর্থ পৌঁছে দিত। ওই রাষ্ট্রদূত আরও বলেন, এই মিলিশিয়ারা সরাসরি আয়াতুল্লাহ খামেনির উদ্দেশ্য বাস্তবায়ন করে থাকে।
গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করলে দেখা যাবে, আজকের দিনে ইরানের যারা রক্ষণশীল অথবা কট্টরপন্থী তাঁরাও পরিবর্তন চাইছেন। মোহাম্মদ বাকের গালিবাফের কথা ধরুন। তিনি রাজনীতিতে যুক্ত হওয়ার আগে ইরানের শক্তিশালী ইসলামিক রেভল্যুশনারি গার্ডস কর্পের কমান্ডার ছিলেন। (২০২০ সালে তিনি সংসদের স্পিকার হয়েছিলেন)। আয়াতুল্লাহর প্রতি তাঁর জোরালো সমর্থন আছে।
গালিবাফ ২০০৫–১৭ সাল পর্যন্ত তেহরানের মেয়রের দায়িত্ব পালন করেন। চূড়ান্ত দুর্নীতির মধ্যেও তিনি তেহরানের পরিবহনব্যবস্থার আমূল পরিবর্তন ঘটিয়ে রাজধানীকে সক্রিয় করে তুলতে সমর্থ হন।
এই দক্ষতা শুধু গালিবাফের নয়। খামেনির কট্টর বিরোধীদের মধ্যেও গালিবাফের মতো ব্যক্তিত্ব রয়েছে। শুক্রবারের নির্বাচনের অন্যতম প্রার্থী সাঈদ মোহাম্মদ রেভল্যুশনারি গার্ডের প্রকৌশল বিভাগের প্রধান ছিলেন।
তেহরানের শীর্ষ একটি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পুরকৌশলে পিএইচডিধারী এই ব্যক্তির রাজনৈতিক বক্তব্যে শুধু যে তার ইসলামপন্থী অবস্থানের কথা জানিয়েছেন তা নয়। তিনি অতীতের নির্মাণ প্রকল্প ও কীভাবে ইরানের অর্থনৈতিক উন্নতি সম্ভব, তা নিয়েও কথা বলেন।
সাঈদ মোহাম্মদ যখন ২০২১ সালে প্রেসিডেন্ট পদে নির্বাচনে দাঁড়ানোর প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন, তখন তাঁর বক্তৃতা ছিল জনপ্রিয় ইস্যুকেন্দ্রিক, বক্তৃতার ধরনও ছিলেন দেশপ্রেমীদের মতো। ফলে যা ঘটার তা–ই ঘটেছে। তিনি নির্বাচনে অংশ নিতে পারেননি। তিনি ইরানিয়ান ডন ফ্রন্টের সহপ্রতিষ্ঠাতা, যাঁরা বেশ কয়েকজন সফল প্রতিদ্বন্দ্বীকে নির্বাচনে দাঁড় করাতে পেরেছেন। দলটি ইসলামিক রিপাবলিকের শাসনমন্ত্রগুলোর সমালোচনাও করছে, যদিও নিচুস্বরে। তাদের সমর্থনে অবশ্য কট্টরপন্থীরাও জিতে এসেছেন।
ইরানের শক্তি কাঠামোয় গালিবাফ বা সাঈদ মোহাম্মদের মতো প্রচুর নেতা আছেন। সরকারের বর্তমান ও সাবেক অনেক সদস্যই আয়াতুল্লাহ খামেনির অভ্যন্তরীণ ও কূটনৈতিক নীতি–কৌশলের প্রকাশ্য সমালোচনা করেছেন।
ইরান ও রেভল্যুশনারি গার্ড নিয়ে গবেষণার সময়, আমি নিয়মিত এ ধরনের সমালোচনা শুনেছি। এখন এই সমালোচনা আসছে শীর্ষ কূটনীতিকদের কাছ থেকে। যার অর্থ দাঁড়ায়, তাঁদের এই ধ্যানধারণা বিশ্বাস ছড়িয়েছে অনেকটাই।
কর্পস নেতা ও অন্যান্য কট্টরপন্থী যা ভাবেন, তা–ই বলে থাকেন। তাঁরা আয়াতুল্লাহর নীতিই বাস্তবায়ন করবেন। শীর্ষ নেতা যাকে বলছেন বিপ্লবের দ্বিতীয় পর্ব।
কিন্তু আয়াতুল্লাহ খামেনির নীতি এত অজনপ্রিয় যে তাঁর উত্তরাধিকারী যে–ই হোন না কেন, দেশের ওপর যদি তিনি কিছুটা নিয়ন্ত্রণও রাখতে চান, তাঁকে পরিবর্তনের পথে হাঁটতেই হবে। পরিবর্তন নানাদিক থেকে হতে পারে। অভ্যন্তরীণ পরিবর্তনের মধ্যে একটি হতে পারে বাধ্যতামূলক হিজাব নীতিকে সহজ করে দেওয়া এবং নারী, সাহিত্য ও শিল্পের ওপর নিয়ন্ত্রণ শিথিল করা ও বাক্স্বাধীনতা দেওয়া।
বিদেশ নীতির ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে পরমাণু চুক্তিতে কিছু পরিবর্তন আসতে পারে। নীরবে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে শত্রুতা মিটিয়ে নেওয়ার উদ্যোগ এবং কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপনের বিষয়টি আসতে পারে।
ইরান এই অঞ্চলে যুক্তরাষ্ট্রবিরোধী মিলিশিয়াদের সমর্থন দেওয়া কমিয়ে দিতে পারে এবং সৌদি আরব ও মিসরের মতো আঞ্চলিক শক্তিগুলোর সঙ্গে চুক্তি করতে পারে। এমনকি ইসরায়েলকে ধ্বংসের যে হুমকি তারা দিয়ে আসছে, তা থেকে সরে আসতে পারে। অনিচ্ছা সত্ত্বেও ইরান এখন ইসরায়েলের অস্তিত্বকে স্বীকার করে নিতে পারে। আয়াতুল্লাহ খামেনির ইরান টিকে আছে এই নীতিগুলোর ওপর।
এই নীতিগুলো পরিহার করলে নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার হতে পারে। ফলে বিদেশি বিনিয়োগ বাড়বে, অর্থনীতিও গতি পাবে। এই উন্নয়নের ভাবনা এখনো অকল্পনীয়। কিন্তু আমাদের ইসলামিক রিপাবলিকের সাম্প্রতিক ইতিহাস ঘাঁটলে দেখা যাবে, অনেকেই পশ্চিমাদের সঙ্গে সম্পর্কোন্নয়নের জন্য সুপারিশ করেছেন।
২০১৫ সালে সাবেক প্রেসিডেন্ট হাসান রুহানির পরমাণু চুক্তির কথা মনে করুন, অথবা বর্তমান নেতৃত্ব সৌদি আরবের সঙ্গে বিরোধ মেটাতে কি উদ্যোগ নিয়েছে, তা ভেবে দেখুন।
আজকের সমস্যাসংকুল ইরানের জন্য পরিবর্তিত ইরান ভালো অগ্রগতি হিসেবে বিবেচিত হতে পারে। তবে এই পরিবর্তনের জন্য আমি ও আমার সহযাত্রীরা ২০০৯, ২০১৭, ২০১৯ ও ২০২২ সালে সরকারবিরোধী আন্দোলন করিনি।
আমাদের অত্যন্ত সক্রিয় নাগরিক সম্প্রদায়, নারীবাদী, শ্রমিক ও ছাত্রসংগঠন এমন ইরানের স্বপ্ন দেখে না। তারা একটি সত্যিকারের গণতান্ত্রিক দেশ চায়, যেখানে সামাজিক, অর্থনৈতিক ও জেন্ডারভিত্তিক ন্যায়বিচার নিশ্চিত হবে।
সম্ভবত নিকট ভবিষ্যতে এমন একটি পরিবর্তনই দেখতে যাচ্ছি আমরা। কারণ, সামরিক বাহিনী থেকে আসা টেকনোক্র্যাটরা অনেক বেশি সংঘবদ্ধ এবং আয়াতুল্লাহ খামেনির মৃত্যুর পর তাঁরা দ্রুতই শূন্যস্থান পূরণ করবে। তাদের জন্য বলতে চাই, শাসক কিংবা তাদের নীতিতে সামান্য পরিবর্তনে আমাদের সংগ্রাম শেষ হবে না।
আরাশ আজিজি ক্লেমসন বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক। হোয়াট ইরানিয়ানস ওয়ান্ট: উইমেন, লাইফ, ফ্রিডম নামক গ্রন্থের লেখক।
নিউইয়র্ক টাইমস–এ প্রকাশিত লেখাটি অনুবাদ করেছেন শেখ সাবিহা আলম।