ছাত্র–জনতার অভ্যুত্থানের পর রাষ্ট্র সংস্কারের বড় একটি সুযোগ আমাদের সামনে এসেছে। শিক্ষা সংস্কারে কী কী পদক্ষেপ নেওয়া যায়, তা নিয়ে লিখেছেন সমীর রঞ্জন নাথ
কর্তৃত্ববাদী শাসনের আপাত অবসানের পর সমাজ ও রাষ্ট্রের সর্বত্র সংস্কারের কথা উঠেছে। শিক্ষাক্ষেত্রও তার ব্যতিক্রম নয়। বিগত বছরগুলোয় সমাজ ও রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠানগুলো ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, এমন উপলব্ধি থেকেই সংস্কারের প্রয়োজনীয়তা। সংস্কার একটি চলমান প্রক্রিয়া। এর কোনো সংক্ষিপ্ত পথ নেই। প্রায় ৪ কোটি শিক্ষার্থী এবং ১২ লাখ ৭২ হাজার শিক্ষকের সমন্বয়ে গঠিত এই শিক্ষাব্যবস্থাটি পথে আনতে একটু দীর্ঘ সময়ের প্রয়োজন। কিন্তু কাজটি এখনই শুরু করতে হবে। সংস্কার কার্যক্রমকে ফলদায়ক ও টেকসই করার জন্য দায়িত্বশীলতার সঙ্গে এবং যৌক্তিকভাবে এটিকে এগিয়ে নেওয়া এই সময়ের চ্যালেঞ্জ। অনুকূল পরিবেশ বিবেচনায় কিছু সুপারিশ তুলে ধরা হলো।
১. প্রাক্-প্রাথমিক, প্রাথমিক, মাধ্যমিক, কারিগরি, মাদ্রাসা ও উচ্চশিক্ষা নিয়ে আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা। এর সুসমন্বিত পরিচালনার জন্য দুটি শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের পরিবর্তে একটি মন্ত্রণালয় তৈরি করা প্রয়োজন। মন্ত্রণালয়ের অধীন বিভাগগুলো হতে পারে। প্রাক্–প্রাথমিক শিক্ষা (৪ বছর বয়সী শিশুদের জন্য প্রাক্-প্রাথমিক থেকে তৃতীয় শ্রেণি পর্যন্ত), প্রাথমিক (চতুর্থ থেকে অষ্টম শ্রেণি), মাধ্যমিক (নবম থেকে দ্বাদশ শ্রেণি) ও উচ্চশিক্ষা। কারিগরি ও মাদ্রাসা শিক্ষার জন্যও আলাদা বিভাগ থাকবে। সেই দুই বিভাগের শিক্ষার্থীদের অন্যান্য বিভাগের সঙ্গে যুক্ত হওয়ার সুযোগও রাখতে হবে। মানসম্মত কারিগরি শিক্ষার ওপর জোর দিতে হবে।
২. একটি স্থায়ী শিক্ষা কমিশন গঠন করা দরকার। মন্ত্রণালয়ের আমলাতান্ত্রিক কাঠামোর বাইরে বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ, শিক্ষা গবেষক এবং শিক্ষা প্রশাসকদের সমন্বয়ে এটি গঠিত হতে হবে। এর কাজ হবে প্রাক্-প্রাথমিক থেকে উচ্চশিক্ষা পর্যন্ত পুরো শিক্ষাব্যবস্থার ওপর নজর রাখা এবং গবেষণা ফলাফলের ওপর ভিত্তি করে মন্ত্রণালয়কে পরামর্শ দেওয়া। মন্ত্রণালয় কমিশনের পরামর্শকে মান্যতা দেবে।
৩. একটি শিক্ষা গবেষণা পরিষদ গঠন করা প্রয়োজন। এই পরিষদ মন্ত্রণালয় ও কমিশনের কাছ থেকে গবেষণার ইস্যু নেবে। তারপর ইস্যুভিত্তিক টার্মস অ্যান্ড রেফারেন্স তৈরি করে প্রতিযোগিতামূলকভাবে গবেষণা প্রস্তাব আহ্বান করবে। সরকারি-বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় এবং গবেষণা প্রতিষ্ঠানগুলো নিজ নিজ বিধি অনুসারে সেখানে অংশ নেবে। উৎকৃষ্ট প্রস্তাবকারী অগ্রাধিকার পাবে সেখানে। গবেষণার উচ্চমান রক্ষার্থে যা যা করণীয়, পরিষদ তা-ই করবে। এর ফলে শিক্ষানীতি প্রণয়ন ও পরিমার্জনে গবেষণা ভিত্তি জোরালো হবে এবং দেশে শিক্ষা গবেষণার মান উন্নত হবে। সরকার প্রাথমিকভাবে একটা এন্ডোউমেন্ট ফান্ড দেবে, পর্যায়ক্রমে পরিষদ অন্য সোর্স থেকেও অর্থের ব্যবস্থা করবে।
৪. শিক্ষাতথ্যের অসামঞ্জস্য দূর করতে তথ্যসংগ্রহ ও বিতরণের জন্য একটি একক প্রতিষ্ঠান গঠন করা প্রয়োজন। বর্তমানে বাংলাদেশ শিক্ষাতথ্য ও পরিসংখ্যান ব্যুরো (বেনবেইস) এবং বাধ্যতামূলক প্রাথমিক শিক্ষা বাস্তবায়ন পরিবীক্ষণ ইউনিট দুই মন্ত্রণালয়ের অধীন শিক্ষাতথ্য সংগ্রহ করে। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) সাক্ষরতা জরিপের মতো কিছু কাজ করে। এই তিন প্রতিষ্ঠানের শিক্ষাসংক্রান্ত কাজ এক প্রতিষ্ঠানের অধীন আনা গেলে শিক্ষাতথ্যের গরমিল রোধ করা সম্ভব হবে। নিয়মিত প্রতিবেদন প্রকাশের বাইরে গবেষকদের জন্য প্রাথমিক শিক্ষাতথ্যপ্রাপ্তি নিশ্চিত করতে হবে।
৫. বিদ্যালয় পর্যায়ে নিয়মিতভাবে বছরে দুই–তিনটি অভিভাবক-শিক্ষক সভা করতে হবে। অভিভাবক ও শিক্ষকদের মতামত বিদ্যালয় পর্যায়ে গুরুত্বসহকারে বিবেচনায় নিতে হবে। মতামতগুলো যেন ওপর পর্যন্ত পৌঁছায়, তার ব্যবস্থা করা প্রয়োজন। শিক্ষা বোর্ডগুলোর স্বাধীনভাবে কাজ করা প্রয়োজন, ঢাকা বোর্ডের আঞ্চলিক শাখার মতো নয়। আমাদের দরকার একই মানের মূল্যায়ন প্রক্রিয়া অনুসরণ করা। এটি একই প্রশ্নপত্রে হতে হবে, এমন কোনো কথা নেই।
৬. বিদ্যালয় পর্যায়ের প্রশিক্ষণহীন শিক্ষকদের দ্রুত প্রশিক্ষণের আওতায় আনা দরকার। শিক্ষক প্রশিক্ষণের দৈর্ঘ্যও বাড়ানো উচিত। প্রশিক্ষণ গ্রহণের পর পর্যাপ্ত যোগ্যতা অর্জন করে একজন সনদপ্রাপ্ত শিক্ষক হবেন। সনদের মেয়াদ হবে পাঁচ বছর, যা একটি প্রক্রিয়ায় নবায়ন হবে। এ ধরনের ব্যবস্থা শিক্ষকদের ক্ষমতায়নের ভিত্তি মজবুত করবে।
৭.অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত শিক্ষা বাধ্যতামূলক ও বিনা মূল্যের (কেবল অবৈতনিক নয়) করার আইনি ব্যবস্থা নেওয়া দরকার। শ্রেণিকক্ষের পাঠদান এমন হওয়া উচিত, যেন গৃহশিক্ষক বা গাইড–নোট বইয়ের সাহায্য না লাগে। এতে ব্যক্তি খাতে শিক্ষাব্যয় কমবে। রাষ্ট্রীয় শিক্ষাব্যয় বাড়িয়ে অন্তত বিদ্যালয় পর্যায়ে ব্যক্তি খাতের খরচ কমনো যায়।
৮. উচ্চশিক্ষায় স্বায়ত্তশাসন নিশ্চিত করা প্রয়োজন। উপাচার্য বিশ্ববিদ্যালয়ের এবং প্রভোস্ট ছাত্রাবাসের সার্বভৌম কর্তা, এই নীতি সব বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রয়োগ হওয়া দরকার। উভয়েরই একমাত্র স্টেকহোল্ডার হলো শিক্ষার্থীরা। আইন ও বিধির যথাযথ প্রয়োগই পারে সব মত ও পথের শিক্ষার্থীদের সহাবস্থান নিশ্চিত করতে। ছাত্রাবাসগুলোকে শিক্ষার্থীদের জীবনের কেন্দ্রে স্থান দিয়ে নানান সৃজনশীল কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে তাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষাজীবন ঢেলে সাজানো প্রয়োজন। এর জন্য হল সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠানও জরুরি। শিক্ষার্থী ও শিক্ষক—উভয়ের জন্য গবেষণার অপার সুযোগ সৃষ্টি করা দরকার।
৯. শিক্ষার সার্বিক অবস্থার নির্মোহ পর্যালোচনা এবং করণীয় সম্পর্কে স্বাধীন মতামত দেওয়ার জন্য একটি শ্বেতপত্র প্রণয়ন কমিটি করা যেতে পারে।
সুপারিশ আরও দেওয়া যায়। অনেকেই দেবেন। প্রয়োজন সব মহলের মতামত নেওয়া। শিক্ষার্থী, শিক্ষক ও অভিভাবকদের মধ্যে শিক্ষাসংস্কার নিয়ে ব্যাপক আলোচনা শুরু করা দরকার। সবার অংশগ্রহণেই কেবল একটি টেকসই সংস্কার কার্যক্রম এগিয়ে যেতে পারে।
সমীর রঞ্জন নাথ কর্মসূচি প্রধান, ব্র্যাক শিক্ষা উন্নয়ন ইনস্টিটিউট, ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়