ঘূর্ণিঝড় ব্যবস্থাপনায় বাংলাদেশের সাফল্য আছে, কিন্তু এই সাফল্য ‘বেসিক’ থেকে গেছে এবং এর ‘অ্যাডভান্স’ স্তরে রূপান্তর দরকার।
ঘূর্ণিঝড় ব্যবস্থাপনায় বাংলাদেশের সাফল্য আছে, কিন্তু এই সাফল্য ‘বেসিক’ থেকে গেছে এবং এর ‘অ্যাডভান্স’ স্তরে রূপান্তর দরকার।

ঘূর্ণিঝড় নিয়ে এমন সুরক্ষাব্যবস্থা হোক—শুধু জান নয় যাতে মালও বাঁচে

ঘূর্ণিঝড়ের ক্ষয়ক্ষতি মোকাবিলায় বাংলাদেশের কিছু অর্জন আছে, সেটি অবশ্যই বলা যায়। মূলত সেটি মানুষের জীবনরক্ষাকেন্দ্রিক, সম্পদরক্ষাকেন্দ্রিক নয়। মানুষের সঞ্চিত ফসল ও সম্পদ, আবাসনের গৃহ, মাঠের ফসল, গৃহপালিত পশু, প্রাকৃতিক সম্পদ (লোনাপানি থেকে স্বাদু পানির জলাশয়, গাছপালা) এবং বন্য প্রাণী ইত্যাদি খাতে ঘূর্ণিঝড় ব্যবস্থাপনার স্কোপ বাড়িয়ে জাতীয় সম্পদের  ক্ষয়ক্ষতি মোকাবিলার নতুনতর দায় তৈরি হয়েছে।

বাংলাদেশে ঘূর্ণিঝড় আশ্রয়কেন্দ্রগুলো বৈশ্বিক স্তরে সাফল্যের একেকটি গল্প। ঝড়ের আগে মানুষ জীবনের সব উপকরণ ও সম্পদ পেছনে ফেলে এখানে এসে জীবন রক্ষা করে। প্রশাসন থেকে স্বেচ্ছাসেবকেরা তাঁদের আগাম সতর্ক করে সাইক্লোন শেল্টারে আনেন এবং কিছু শুকনা খাবার সরবরাহ করেন। এটা জীবনরক্ষাকারী মৌলিক ব্যবস্থাপনা।  

আশ্রয়কেন্দ্রগুলোর নকশা, নির্মাণ এবং তহবিল জোগানে বাংলাদেশের স্থানীয় সরকার প্রকৌশল বিভাগ (এলজিইডি), বিশ্বব্যাংক, এডিবি, সৌদি ফায়েল খায়ের, ব্র্যাকসহ বিভিন্ন দেশি–বিদেশি সংস্থা জড়িত। বিশ্বব্যাংকের মাল্টিপারপাস ডিজাস্টার শেল্টার প্রজেক্ট (এমডিএসপি) উপকূলীয় জনগোষ্ঠীকে রক্ষা করার জন্য শত শত আশ্রয়কেন্দ্র নির্মাণ ও পুনর্বাসন করেছে। বিশ্বব্যাংক তার এমডিএসপি প্রকল্পের মাধ্যমে বাংলাদেশের ঘূর্ণিঝড়প্রবণ উপকূলীয় অঞ্চলে জনগণকে রক্ষায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে।

এই প্রকল্প ২০২৩ সালের জুন পর্যন্ত চলেছে, ৯ জেলার ১৪ মিলিয়ন মানুষকে ৫৫২টি নতুন আশ্রয়কেন্দ্র নির্মাণ, ৪৫০টি বিদ্যমান আশ্রয়কেন্দ্র সংস্কার এবং ৫৫০ কিলোমিটারের বেশি রাস্তা সংস্কার ও নির্মাণের মাধ্যমে নিরাপদ আশ্রয়ে যাওয়ার সুবিধা তৈরি করেছে। আশ্রয়স্থলগুলো নিয়মিত সময়ে প্রাথমিক বিদ্যালয় হিসেবে কাজ করে। উপরন্তু সবুজ জলবায়ু তহবিল (গ্রিন ক্লাইমেট ফান্ড) এবং রিকনস্ট্রাকশন ক্রেডিট ইনস্টিটিউট নামের সংস্থা দুটিও সাইক্লোন শেল্টার নির্মাণের অর্থায়নে জড়িত রয়েছে। এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি) তার উপকূলীয় জলবায়ু-স্থিতিস্থাপক অবকাঠামো প্রকল্পের মাধ্যমে অবদান রেখেছে। অতিসম্প্রতি আইএমএফ রেজিলিয়েনস অ্যান্ড সাসটেইনেবিলিটি ফ্যাসিলিটি (আরএসএফ) হিসেবে বাংলাদেশকে ১ দশমিক ৪ বিলিয়ন মার্কিন ডলার ঋণসহায়তা দিচ্ছে।

সৌদি আরবের ফায়েল খায়ের, সৌদি ফান্ড ফর ডেভেলপমেন্ট (এসএফডি) এর মাধ্যমে বাংলাদেশে সাইক্লোন শেল্টার নির্মাণ ও অর্থায়নে জড়িত। সম্প্রতিক বছরগুলোতে এসএফডি ১৭০টি সাইক্লোন শেল্টার বা আশ্রয়কেন্দ্র সম্পন্ন করেছে যা বাংলাদেশ সরকারের কাছে হস্তান্তর করা হবে। এই আশ্রয়কেন্দ্রগুলো ঘূর্ণিঝড়ের ঝুঁকিপূর্ণ উপকূলীয় অঞ্চলে প্রাকৃতিক দুর্যোগ ও জলোচ্ছ্বাসের সময় নিরাপত্তা ও সহায়তা প্রদানের জন্য ডিজাইন করা হয়েছে। সাইক্লোন শেল্টার নির্মাণের সঙ্গে বাংলাদেশের বহু এনজিও সরাসরি যুক্ত রয়েছে।

ঘূর্ণিঝড়ের আগে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা কর্মীরা মানুষকে সতর্ক করে সাইক্লোন শেল্টারে নিয়ে আসার যে উদ্যোগ নেয়, সেগুলো সাধুবাদ পাওয়ার মতো। এতে মানুষের জীবন রক্ষা পায়। তবুও সাইক্লোন শেল্টার অভিজ্ঞতার ৪০ বছর পেরিয়ে এই ভিত্তিমূলক ব্যবস্থাপনাটাকে পরবর্তী ধাপে নিতে হবে।  

এক

মানুষের পাশাপাশি গবাদিপশুকে নিরাপত্তা দিতে নতুন অবকাঠামো দরকার। কৃষকের ফসল সংরক্ষণ ব্যবস্থাপনা যুক্ত করতে হবে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনার মৌলিক উদ্যোগ হিসেবে। এখানে গুদামঘর ও পরিবহনসুবিধা দরকার। উৎপাদিত ফসল যেমন ধান, গম, ভুট্টা, পেঁয়াজ, রসুন ও আদা ইত্যাদি সংরক্ষণের জন্য সমবায়মূলক কমন ফ্যাসিলিটি বা কমিউনিটি স্টোরেজ অবকাঠামো বা সমবায় স্টোরেজ নিয়ে ভাবা যেতে পারে, ঘূর্ণিঝড়প্রবণ, বিশেষভাবে উপকূলীয় এলাকার জন্য।  

দুই

সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে লোনাপানির অবস্থান ও জলাবদ্ধতা নির্ণয় করা। লবণ পানি সরে যাওয়ার জন্য বা বাইরে ফেলার জন্য স্থায়ী খাল–সংযোগ ও এ–সংক্রান্ত সুবিধা তৈরি করতে হবে। এ জন্য জিআইএস প্রসেসিং বা স্যাটেলাইট ইমেজ প্রসেসিংয়ে যেতে হবে। ঝড়ের আগে এবং পরে ইমেজ প্রসেসিং করে দেখতে হবে কোথায় কোথায় জলোচ্ছ্বাসের লবণ পানি আটকা পড়ে। সেগুলোকে ক্যানেল নেটওয়ার্ক তৈরি করে জলাধারে নিয়ে যেতে হবে (না থাকলে নির্মাণ করতে হবে), যেখান থেকে লবণাক্ত পানি সেচে বাইরে ফেলার সুবিধা থাকবে।  

বাংলাদেশ ডেলটা প্ল্যান এ ক্ষেত্রে ঠিক কী কাজ করছে ব্যক্তিগতভাবে আমার জানা নাই। ১০০ বছরের পরিকল্পনায় এসব থাকা চাই। গৃহপালিত পশুর নিরাপত্তা, খাদ্যনিরাপত্তা,  কৃষিনিরাপত্তা, আবাসন নিরাপত্তা, সামাজিক বনায়নের নিরাপত্তা, মাঠে ও গোলায় রাখা ফলনের নিরাপত্তা সবকিছুই ডেলটা প্ল্যানের অংশ হওয়া চাই।

তিন

দুর্যোগ ব্যবস্থাপনার চতুর্থ পর্যায়ে এসে আমাদের ভাবতে হবে, কীভাবে মানুষের ঘরবাড়িগুলো রক্ষা করা যায়। একেকটি ঝড়ে দেশের নিম্নবিত্ত ও সাধারণ মানুষের বিপুল পরিমাণ কাঁচা ও আধা পাকা ঘরবাড়ি ভেঙে যায়, চাল ও বেড়া উড়ে গিয়ে একেকটি পরিবার আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয় এবং অনেকেই দারিদ্র্যসীমার নিচে নেমে আসে। এই জলবায়ু দারিদ্র্য থামাতে ঘূর্ণিঝড় হতে আবাসনকে রক্ষা করতে, সামর্থ্য অনুযায়ী বিভিন্ন ধরনের টেকসই উপকূলীয় গৃহায়ণ মডেল প্রয়োজন।

চার

ঘূর্ণিঝড়প্রবণ উপকূলীয় অঞ্চলে খাওয়ার পানির নিশ্চয়তা নিয়ে গভীরভাবে ভাবতে হবে। ঘূর্ণিঝড়ের কারণে উপকূলীয় এলাকায় জলাশয় কিংবা পুকুরগুলোতে লোনাপানির বিস্তার ঘটে। চারদিকে পানি থাকলেও ব্যবহারোপযোগী পানির হাহাকার। এসব এলাকার টিউবয়েলগুলোতে আর্সেনিকসহ বিভিন্ন ভারী ধাতুর উপস্থিতি থাকে বলে খাওয়ার পানি সংগ্রহ করতে মানুষের দৈনিক তিন থেকে পাঁচ শ্রমঘণ্টা সময় নষ্ট হয়। লবণাক্ততায় উপকূলীয় মানুষ বিভিন্ন ধরনের রোগে আক্রান্ত হয়ে স্বাস্থ্য ব্যয় বাড়ছে। গবেষণায় দেখা গেছে, উপকূলীয় অঞ্চলে এমনকি গর্ভপাতের সংখ্যাও বেশি।

সবশেষে  ঘূর্ণিঝড় থেকে কীভাবে বন্য প্রাণী রক্ষা করা যায়, সেটি নিয়ে ভাবতে হবে। ঘূর্ণিঝড় রিমাল একটি নতুন অভিজ্ঞতার ভেতর দিয়ে আমাদের নিয়েছে। সেটি হচ্ছে, ঝড়ের কেন্দ্র দীর্ঘ সময় প্রায় একই গতিতে একই স্থানে অবস্থান করে। রিমাল ঝড় দেশের উপকূলীয় এলাকায় প্রায় ১০ ঘণ্টা অবস্থান করেছে। এত দীর্ঘ সময়ে জোয়ারের ১০ ফুট জলোচ্ছ্বাসে হরিণসহ বন্য প্রাণী ব্যাপক সংখ্যায় প্রাণ হারিয়েছে। ঘূর্ণিঝড় রিমালে যে সংখ্যক হরিণ নোয়াখালী, বরগুনা বা সুন্দরবন উপকূলের বিভিন্ন অঞ্চলে মারা গেছে, সেটি অভূতপূর্ব। এই অভিজ্ঞতা বন্য প্রাণী সংরক্ষণে নতুন তাগিদ হিসেবে নিতে হবে।  

ঘূর্ণিঝড় ব্যবস্থাপনায় বাংলাদেশের সাফল্য আছে, কিন্তু এই সাফল্য ‘বেসিক’ থেকে গেছে এবং এর ‘অ্যাডভান্স’ স্তরে রূপান্তর দরকার। গবাদিপশু, মানুষের ঘরের ফসল, কৃষিজমির ফসল, লবণাক্ততা, খাওয়ার পানি ইত্যাদির টেকসই অবকাঠামো, মানুষের ঘরবাড়ির নিরাপত্তা এবং সর্বোপরি বন্য প্রাণীর নিরাপত্তা যদি নিশ্চিত করা যায়, তবেই বলা যাবে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনায় বাংলাদেশের অর্জিত জ্ঞান এবং অভিজ্ঞতাকে আধুনিক স্তরে রূপান্তর করা সম্ভব হয়েছে।

পাঁচ.

সম্প্রতি একটি ছবি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ভাইরাল হয়েছে। এক যুবক বুকের ওপর লিখেছেন ‘ত্রাণ ভিক্ষা চাই না, টেকসই বেড়িবাঁধ চাই’। প্রতিবার ঘূর্ণিঝড়ের জলোচ্ছ্বাস এলে গ্রামের মানুষকে ঘর, রোগব্যাধির হুমকি ও প্রাণের নিরাপত্তা হাতে নিয়ে কাদামাটি দিয়ে তাদের জীবন ও সম্পদ রক্ষাকারী বেড়িবাঁধ মেরামতের সর্বোচ্চ চেষ্টায় নিয়োজিত থাকতে দেখা যায়। অথচ কাজটি ছিল সরকারের। প্রতিবছর নিম্নমানের বেড়িবাঁধে অর্থ ঢালা হয় এবং ঠিকাদার, এমপি, চেয়ারম্যান দুর্বৃত্ত চক্র সেটা মেরে দেয়।

মানুষকে ঝড়-বৃষ্টি, জোয়ার আর বজ্রপাতের বিরূপ প্রাকৃতিক পরিবেশে জীবনের ঝুঁকে নিয়ে বেড়িবাঁধ মেরামতে ঠেলে দেওয়া রাষ্ট্রের তীব্র  অনুপস্থিতিকে জানান দেয় মাত্র। এটাকে টেকসই দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা বলা যায় না। স্লুইস গেট ও পাম্প-আউট সুবিধাহীন মাটির তৈরি ক্ষণস্থায়ী নিম্নমানের বেড়িবাঁধগুলো একদিকে জোয়ারের পানিতে ভেঙে পড়ে, অন্যদিকে বিভিন্ন স্থানে লোনাপানির জলাবদ্ধতা তৈরি করে। এতে খাদ্য, কৃষি ও গবাদিপশুর নিরাপত্তার সমূহ ক্ষতি হচ্ছে।

টেকসই বেড়িবাঁধসহ উপকূলীয় মানুষের জীবন ও সম্পদের, প্রাকৃতিক সম্পদের ‘টোটাল’ সুরক্ষার সমন্বিত অবকাঠামো সমাধান এখনই না খুঁজলে আগামী সময়ে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনায় বাংলাদেশের সব অর্জন ম্লান হয়ে যাবে।  

  • ফয়েজ আহমদ তৈয়্যব টেকসই উন্নয়নবিষয়ক লেখক। গ্রন্থকার: চতুর্থ শিল্পবিপ্লব ও বাংলাদেশ; বাংলাদেশ: অর্থনীতির ৫০ বছর; অপ্রতিরোধ্য উন্নয়নের অভাবিত কথামালা; বাংলাদেশের পানি, পরিবেশ ও বর্জ্য; উন্নয়নের নীতি ও দর্শন; ক্ষুদ্রঋণ, শিক্ষা, বেকারত্ব ও বিসিএস। ই-মেইল: faiz.taiyeb@gmail.com