একই সময়ে সচিবালয়ের ৭ নম্বর ভবনের দুই প্রান্তে আগুন লাগে। রাজধানীর সেগুনবাগিচায়
একই সময়ে সচিবালয়ের ৭ নম্বর ভবনের দুই প্রান্তে আগুন লাগে। রাজধানীর সেগুনবাগিচায়

মতামত

আগুন: লামা থেকে সচিবালয়, কে বা কারা দায়ী

দুটি আগুনের ঘটনা। ২৫ ডিসেম্বরের আগের রাতে বান্দরবানে লামা উপজেলায় সরই ইউনিয়নের তংগোঝিরি ত্রিপুরাপাড়ায় খ্রিষ্টধর্মাবলম্বী ত্রিপুরাদের ১৭টি ঘরে আগুন দেয় দুর্বৃত্তরা। আর ২৫ ডিসেম্বর দিবাগত রাত একটার দিকে ঢাকায় প্রশাসনের প্রাণকেন্দ্র সচিবালয়ের সপ্তম ভবনে আগুন লেগে বেশ কিছু সম্পদ পুড়ে যায়।

দুটি ঘটনার মধ্যে কোনো সংযোগ আছে বলে মনে হয় না। বান্দরবানের খ্রিষ্টানপল্লিতে আগুনের ঘটনাটি রহস্যজনক। সাবেক আইজিপি বেনজীর আহমেদের স্ত্রীর নামে ওই পাড়ার জমি ইজারা দেওয়া হয়েছিল আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে। বেনজীর গং পাড়ার বাসিন্দাদের উচ্ছেদ করে সেখানে একটি বাগান করেন।

গত ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর পাড়ার বাসিন্দারা আবার সেখানে এসে ঘর তৈরি করে বসবাস শুরু করেন। সেখানে গির্জা না থাকায় বড়দিন উপলক্ষে তাঁরা ঘরবাড়ি খালি রেখে তংগোঝিরি ত্রিপুরাপাড়ায় যান। রাতে নির্জন এলাকা পেয়ে দুর্বৃত্তরা পাড়ায় আগুন দিলে ১৭টি ঘর পুড়ে যায়।

প্রশ্ন হলো, এই দুর্বৃত্ত কারা? সাবেক আইজিপি বেনজীর আহমেদ অনেক দিন ধরে পলাতক। আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর বেনজীরের লোকজন এখানে এসে আগুন দেবে, এটা কঠিন। সেখানে নতুন করে কারা ভূমিদস্যু হিসেবে আবির্ভূত হলো, তা বের করতে হবে সরকারকেই। ইতিমধ্যে পাড়াবাসীর অভিযোগের প্রেক্ষিতে কয়েকজনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। সরকারের দায়িত্ব দোষীদের শাস্তির আওতায় আনা।

যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা আমাদের প্রধান উপদেষ্টাকে টেলিফোন করে যখন ধর্মবর্ণ-নির্বিশেষে সব নাগরিকের নিরাপত্তা দেওয়ার কথা বললেন, এর কয়েক দিন পর এ ধরনের আগুন দেওয়ার পেছনে অন্য কোনো মহলের ইন্ধন আছে কি না, সেটা খুঁজে বের করা দরকার।

আর বড়দিনের রাতে সচিবালয়ের সাত নম্বর ভবনে যে আগুনের ঘটনা ঘটেছে, তা নিয়েও চলছে নানা জল্পনা। এটা নিছকই দুর্ঘটনা, না এর পেছনেও নাশকতা আছে? স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী বৃহস্পতিবার সাংবাদিকদের বলেছেন, সচিবালয়ে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় তদন্তের পর আগুন লাগার কারণ সম্পর্কে জানা যাবে। ইতিমধ্যে সাত সদস্যের কমিটি গঠন করা হয়েছে।

সচিবালয়ের সাত নম্বর ভবনের ছয়তলায় দিবাগত রাত ১টা ৫০ মিনিটে আগুন লাগে। ফায়ার সার্ভিসকে ১টা ৫২ মিনিটে খবর দেওয়া হয় এবং ১টা ৫৪ মিনিট থেকে তারা কাজ শুরু করে। সকাল ৮টা ৫ মিনিটে আগুন সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণে আসে। তবে আগুন পুরোপুরি নিভিয়ে ফেলতে দুপুর ১২টা বেজে যায়। এ ঘটনায় ফায়ার সার্ভিসের এক কর্মী নিহত হয়েছেন ও আরও কয়েকজন আহত হন।

পোস্টে আসিফ মাহমুদ আরও লেখেন, স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয়ের বিগত সময়ে হওয়া অর্থ লোপাট, দুর্নীতি নিয়ে আমরা কাজ করছিলাম। কয়েক হাজার কোটি টাকা লুটপাটের প্রমাণও পাওয়া গিয়েছিল। তিনি ইঙ্গিত দিয়েছেন, স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের লুটপাট ও দুর্নীতি ধামা চাপা দিতে এই আগুনের ঘটনা ঘটানো হতে পারে। যদি তাই হয় তবে সেটা খুবই উদ্বেগের বিষয়।

আগুন নেভাতে এত দেরি হওয়ার কারণ কি? ফায়ার সার্ভিসের কর্মকর্তারা বলেন, আগুন নেভানোর জন্য ফায়ার সার্ভিসের মাত্র দুটি টার্ন টেবল লেডার (টিটিএল) ভেতরে ঢুকতে পেরেছিল। যদি আরও বেশি টিটিএল ঢুকতে পারত, তাহলে আরও আগে আগুন নেভানো সম্ভব হতো। সচিবালয় ঢোকার মোট ফটক পাঁচটি। ফায়ার সার্ভিসের গাড়ি ঢোকার ফটক আছে মাত্র দুটি।

প্রথম আলোর জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক আরিফুর রহমান সরেজমিন দেখেন, সাত নম্বর ভবনে সড়ক পরিবহন মন্ত্রণালয়, স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়, যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয়, ডাক ও টেলিযোগাযোগ মন্ত্রণালয়ের মতো গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রণালয় রয়েছে। সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে সড়ক পরিবহন মন্ত্রণালয়, স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়, ডাক ও টেলিযোগাযোগ মন্ত্রণালয়, যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয়।

ফায়ার সার্ভিসের মহাপরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মুহাম্মদ জাহেদ কামাল বলেছেন, সচিবালয়ের আগুন নেভানোর জন্য ১৯টি ইউনিট পাঠানো হয়েছিল। কিন্তু ১০টি ইউনিট ফিজিক্যালি কাজ করেছে। কারণ, কিছু গাড়ি ঢোকাতে সমস্যা হচ্ছিল। ছয়তলা থেকে নয়তলা পর্যন্ত আগুন ছড়িয়ে পড়েছিল।

এদিকে স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন এবং যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়া ফেসবুক আইডিতে দেওয়া এক পোস্টে লিখেছেন, আমাদের ব্যর্থ করার এই ষড়যন্ত্রে যে বা যারাই জড়িত থাকবে, তাদের বিন্দু পরিমাণ ছাড় দেওয়া হবে না।

পোস্টে আসিফ মাহমুদ আরও লেখেন, স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয়ের বিগত সময়ে হওয়া অর্থ লোপাট, দুর্নীতি নিয়ে আমরা কাজ করছিলাম। কয়েক হাজার কোটি টাকা লুটপাটের প্রমাণও পাওয়া গিয়েছিল। তিনি ইঙ্গিত দিয়েছেন, স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের লুটপাট ও দুর্নীতি ধামা চাপা দিতে এই আগুনের ঘটনা ঘটানো হতে পারে। যদি তাই হয় তবে সেটা খুবই উদ্বেগের বিষয়।

এটি দুর্ঘটনা, না নাশকতা, সেটা তদন্তে বেরিয়ে আসবে আশা করা যায়। কিন্তু সেই সত্য বেরিয়ে আসার আগে যে বিষয় জানা দরকার, তা হলো একই সময়ে ভবনের দুই প্রান্তে কীভাবে আগুন লাগল। দ্বিতীয় প্রশ্ন হলো আগুন নেভাতে প্রায় ১২ ঘণ্টা সময় লাগল কেন?

স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা বিভাগের একজন সাবেক জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তার সঙ্গে এ বিষয়ে কথা হয়। তিনি বলেন, সচিবালয়ের মতো গুরুত্বপূর্ণ স্থানের গেট এমনভাবে করা হবে কেন, যেখানে ফায়ার সার্ভিসের গাড়ি ঢুকতে পারে না? দ্বিতীয়ত, বনানীর অগ্নিকাণ্ডের পর ফায়ার সার্ভিসের পক্ষ থেকে ক্রাউড কন্ট্রোল ফোর্স নামে একটি ইউনিট গঠন করা হয়েছিল। পরে সেটি ভেঙে দেওয়া হয়। আগুন নেভানোর সঙ্গে এই ইউনিটের কোনো সম্পর্ক নেই। তাদের কাজ অকুস্থলের চারপাশে যাতে মানুষ ভিড় জমিয়ে আগুন নেভানোর কাজে বিঘ্ন না ঘটাতে পারে, সেটা দেখা।

বুধবার রাতে আগুন নেভানোর পানির পাইপ বহন করতে গিয়ে ফায়ার সার্ভিসের এক কর্মী মারা যান ট্রাকের ধাক্কায়। এ রকম ভয়াবহ আগুন লাগার পর সংলগ্ন সড়কে যান চলাচল বন্ধ করে দেওয়া হলো না কেন? সেটি হলে একজনের ফায়ারম্যানকে এভাবে প্রাণ হারাতে হতো না।

সাবেক ওই কর্মকর্তা আগুন দ্রুত ছড়িয়ে পড়ার জন্য আরও একটি কারণ উল্লেখ করলেন। সচিবালয়সহ সব সরকারি অফিসে প্রচুর আসবাবপত্র কেনা হয়। এগুলো কেনা হয় কমিশন-বাণিজ্যের কারণে। যত বেশি কেনাকাটা হবে, তত বেশি কমিশন পাওয়া যাবে।

তাঁর মতে, সরকারি অফিসগুলোকে ‘ফায়ার খামারে’ পরিণত করে ফেলা হয়েছে। তথ্যপ্রযুক্তির এই যুগে যেখানে বিগত সরকার ডিজিটাল বাংলাদেশের পর স্মার্ট বাংলাদেশ করার ঘোষণা দিয়েছিল, সেখানে এত বেশি আসবাব ও সরঞ্জাম কেনার কী দরকার!

যেকোনো সরকারি অফিসে গেলে তাঁর কথার সত্যতা পাওয়া যাবে। উপসচিবের মিটিং রুমে ৫টি চেয়ার থাকলে যুগ্ম সচিবের রুমে ১০টি চেয়ার থাকবে। এভাবে পদের উন্নতির সঙ্গে চেয়ার, টেবিল ও অন্যান্য সরঞ্জামও বেড়ে যায়। এতে সরকারি কর্মকর্তাদের মর্যাদা বাড়লেও সেবার মান বাড়ে না। তবে ঝুঁকি যে বাড়ে সেটা সচিবালয়ে আগুনের ঘটনাই তার প্রমাণ।

  • সোহরাব হাসান প্রথম আলোর যুগ্ম সম্পাদক ও কবি

sohrabhassan55@gmail.com