কমলা হ্যারিস
কমলা হ্যারিস

এবারের নির্বাচনে ডেমোক্র্যাটরা ‘আত্মহত্যা’ করেছেন

এখন পর্যন্ত ডোনাল্ড ট্রাম্প প্রায় ৭ কোটি ৫১ লাখ ভোট পেয়েছেন। ২০২০ সালে তিনি পেয়েছিলেন ৭ কোটি ৪২ লাখ ভোট। তার মানে, এবারের নির্বাচনে তিনি ২০২০ সালের তুলনায় সামান্য বেশি ভোট পেয়েছেন।

অন্যদিকে, কমলা হ্যারিস পেয়েছেন ৭ কোটি ১৮ লাখ ভোট। এই ভোট জো বাইডেনের ২০২০ সালে পাওয়া ৮ কোটি ১২ লাখ ভোট থেকে বেশ কম। এবারের নির্বাচনে ৪০ লাখ নতুন ভোটার যুক্ত হয়েছে। তারপরও ডেমোক্র্যাটরা আগেরবারের চেয়ে কম ভোট পেয়েছেন। সেদিক থেকে তাঁদের জন্য এটি একটি বড় পতন।

ট্রাম্প তাঁর চার বছরের ‘পরিত্রাণের প্রচারণা’য় প্রায় কোনো নতুন সমর্থনই অর্জন করতে পারেননি। আগেরবারের নির্বাচনে ভোটারের সংখ্যা যত ছিল, এবার যদি সেই সংখ্যা একই থাকত তাহলে বলা যেত, ট্রাম্প শুধু তাঁর ২০২০ সালের সমর্থকদের আবার ভোট দিতে রাজি করিয়েছেন। কিন্তু বাস্তবতা হলো, গত চার বছরে প্রায় ১ কোটি ৩০ লাখ আমেরিকান (যাঁদের বেশির ভাগ ভোট দেওয়ার যোগ্য ছিলেন) মারা গেছেন এবং এই সময়কালে প্রায় ১ কোটি ৭০ লাখ নতুন ভোটার যোগ হয়েছে।

এর মানে হলো, ট্রাম্প তাঁর একজন হারানো সমর্থকের জায়গায় একজন নতুন সমর্থক প্রতিস্থাপন করতে পেরেছেন। অন্যদিকে, গতবারের তুলনায় এবার ভোটদানের হার কমে যাওয়ায় ডেমোক্র্যাটরা প্রায় এক কোটি ভোট হারিয়েছেন। দেখা যাচ্ছে, ডেমোক্রেটিক দল ভোটারদের ভোটকেন্দ্রে উপস্থিত রাখার ক্ষেত্রে ব্যর্থ হয়েছে। অন্যদিকে, ট্রাম্প তাঁর সমর্থন ধরে রাখতে সফল হয়েছেন। এই পরিসংখ্যান স্পষ্ট করেছে, শুধু প্রতিদ্বন্দ্বী দলের অর্থনৈতিক অবস্থা, বিজ্ঞাপন বা ভোটারদের সমর্থন টানা প্রচারণার ওপর নির্ভর করে নির্বাচনের ফল ব্যাখ্যা করা যায় না।

এই নির্বাচনে বিজ্ঞাপন, সভা–সমাবেশ এবং স্থানীয় পর্যায়ের প্রচারণা মূলত গুরুত্বপূর্ণ দোদুল্যমান ভোটার অধ্যুষিত অঙ্গরাজ্য বা সুইং স্টেটগুলোতে কেন্দ্রীভূত ছিল। দেখা গেছে, সেসব অঙ্গরাজ্যের ফলাফল পুরো দেশের সঙ্গে মিলে গেছে। এমনকি যেসব স্থানে ফলাফল আগে থেকেই নিশ্চিত ছিল, সেই ম্যাসাচুসেটস বা টেক্সাসের মতো অঙ্গরাজ্যগুলোতেও একই ব্যাপার দেখা গেছে।

ট্রাম্পের সমর্থনে সবচেয়ে বড় পরিবর্তন দেখা গেছে নিউইয়র্ক, নিউ জার্সি, ফ্লোরিডা ও ক্যালিফোর্নিয়ায়।

এটি প্রমাণ করে, ডেমোক্র্যাটরা এসব অঙ্গরাজ্যে তঁাদের প্রচারণায় যে ১০০ কোটি ডলার খরচ করেছেন, তা পানিতে গেছে। চার বছর আগে, জো বাইডেন ঘরে বসেই এসব জায়গায় এর চেয়ে ভালো ফল করেছিলেন।

এবারের ফল ‘আমেরিকান ভোটার’ভিত্তিক বিশ্লেষণকেও দুর্বল করে দিয়েছে। বর্ণবাদ, লিঙ্গবৈষম্য, অর্থনীতি, অভিবাসন বা গর্ভপাতের অধিকার নিয়ে ক্ষোভ (এসব ইস্যু এ বছর ডেমোক্র্যাটদের ভোট পাওয়ার ক্ষেত্রে প্রধান আশা ছিল) নিশ্চয়ই আছে। কিন্তু এসব ইস্যু এবারের নির্বাচনের ফলে আগের বছরের তুলনায় বেশি বা কম প্রভাব ফেলেছে বলে মনে হয় না। এবার যাঁরা ভোট দিতে গিয়েছিলেন, তাঁরা মূলত আগের মতোই ভোট দিয়েছেন।

সাধারণত কিছু ‘দোদুল্যমান ভোটার থাকেন। ভোটের ফলাফলে তাঁরা ভূমিকা রাখতে পারেন। তবে এঁদের সংখ্যা এতই কম যে সাংবাদিকেরা তঁাদের খোঁজে যেভাবে অনুসন্ধান চালিয়েছেন, তা অনেকটা নৃতত্ত্ববিদদের নরখাদক খোঁজার মতো। অর্থাৎ, এসব ভোটারের সংখ্যা অত্যন্ত বিরল।

আদতে এবারের নির্বাচনে, একটি পক্ষ তাদের সর্বোচ্চ শক্তি খাটিয়ে ভোট দিয়েছে, আর অন্য পক্ষ তা পারেনি।

এবার যাঁরা ভোট দিতে যাননি, তাঁদের মতাদর্শিক উদ্দেশ্য কী, তা নিয়ে নির্ভরযোগ্য কোনো তথ্য নেই। তবে এক্সিট পোলের তথ্য অনুযায়ী, ভোটারদের মধ্যে আয়ভিত্তিক তারতম্য ছিল বেশ লক্ষণীয়।

দেখা গেছে, গড়ে বার্ষিক আয় ৫০ হাজার ডলারের নিচে থাকা ভোটারদের মধ্যে বাইডেনের পক্ষে ভোট দেওয়ার অনুপাত কমলা হ্যারিসের পক্ষে ভোট দেওয়ার তুলনায় বেশি ছিল।

হিস্পানিকদের মধ্যে, বিশেষ করে টেক্সাসের সীমান্তবর্তী অঞ্চলের অপেক্ষাকৃত নিম্ন আয়ের ভোটারদের মধ্যে (যদিও এসব কাউন্টি আকারের দিক থেকে ছোট) ট্রাম্পের পক্ষে ভোট দেওয়ায় উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন দেখা গেছে। এর পেছনে অন্তত তিনটি যৌক্তিক ব্যাখ্যা আছে।

প্রথমটি ভোট দেওয়ার শর্তাবলির সঙ্গে সম্পর্কিত। ২০২০ সালে মহামারির কারণে ভোট দেওয়া আগের যেকোনো সময়ের চেয়ে সহজ ছিল। সে বছর লাখ লাখ মানুষ আগাম ভোট দিয়েছেন। ডাকযোগে ভোট দিয়েছেন। সে সময় ভ্রাম্যমাণ গাড়ি থেকে ভোট সংগ্রহ করা হয়েছে; এবং সে সময় ২৪ ঘণ্টা ভোট দেওয়ার সুযোগ রাখা হয়েছিল। এর ফলে ভোটদানের পরিমাণ ছিল বেশি। কিন্তু ২০২৪ সালে এই সুবিধাগুলোর বেশির ভাগই ছিল না।

দ্বিতীয় ব্যাখ্যাটি হলো ভোটার নিবন্ধন। শিক্ষার্থী এবং নিম্ন আয়ের সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের নাগরিকেরা প্রায়ই স্থান পরিবর্তন করেন এবং প্রতিবার ঠিকানা পরিবর্তনের পর তঁাদের আবার নিবন্ধন করতে হয়। এই ঝামেলা ডেমোক্র্যাটদের ওপর বেশি প্রভাব ফেলে।

তৃতীয় ব্যাখ্যাটি ডেমোক্রেটিক পার্টির দীর্ঘদিনের বিভাজন নিয়ে। এই দলের ৭০ থেকে ৮০ শতাংশ সদস্য মধ্যপন্থী এবং ২০ থেকে ৩০ শতাংশ বামধারার। অর্থাৎ পুরো দলটি এখন মধ্যপন্থী সংখ্যাগরিষ্ঠদের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত।

ক্লিনটন ও ওবামা বর্তমানে এই মধ্যপন্থী গোষ্ঠীর কার্যত নেতা এবং বাইডেন ও হ্যারিস তাঁদেরই নিয়োগ করা প্রার্থী।

বার্নি স্যান্ডার্স ২০১৬ এবং ২০২০ সালে বামধারার সমর্থকদের হয়ে ভোটে দাঁড়াতে চেয়েছিলেন, কিন্তু নীতি নিয়ে কিছু ছাড় পাওয়ার শর্তে তিনি শেষ পর্যন্ত বাইডেনের পক্ষে সমর্থন দেন। ২০২৪ সালে ডেমোক্রেটিক পার্টিতে বামধারার শক্তি সক্রিয় ছিল না। কারণ, এবার দলীয় প্রার্থী ঠিক করার ক্ষেত্রে কোনো প্রতিদ্বন্দ্বিতাই হয়নি; স্রেফ গোপনে প্রার্থী বদলানো হয়েছে।

রবার্ট এফ কেনেডি জুনিয়র (যাঁকে ডেমোক্রেটিক প্রাইমারি ভোটে অংশগ্রহণ করতে দেওয়া হয়নি) এবং তুলসী গ্যাবার্ডের মতো বামধারার কিছু নেতা ডেমোক্রেটিক শিবির থেকে ট্রাম্পের শিবিরে চলে গিয়েছিলেন।

২০২৪ সালের নির্বাচন ডেমোক্র্যাটদের জন্য ছিল একধরনের আত্মহত্যা। এই নির্বাচনে দলটির নেতৃত্বের সর্বোচ্চ পর্যায়ও ভোটাধিকার কমে যাওয়ার বিষয়ে উদাসীন ছিল, ২০২০ সালে নতুন ভোটারদের ধরে রাখার বিষয়ে তাঁদের গাফিলতি ছিল এবং দলের বামপন্থী অংশের কিছু বহু ভোটারকে ভোট না দিতে সক্রিয় ছিল।

তারা এসব সমস্যা আড়াল করতে সেলিব্রিটি সমর্থন এবং গ্ল্যামারধর্মী রাজনীতির ব্যবহার করেছে। কিন্তু তা কাজ করেনি।

  • জেমস কে গ্যালব্রেইথ টেক্সাস বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক

    স্বত্ব: প্রজেক্ট সিন্ডিকেট, অনুবাদ: সারফুদ্দিন আহমেদ