মতামত

রাহুল গান্ধী আসলেই কি বিদেশিদের হস্তক্ষেপ চেয়েছেন

রাহুলের বিরুদ্ধে এ অভিযোগ করাটাও অন্যায্য কারণ, তিনি ভারতের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে বিদেশিদের হস্তক্ষেপ চান—এমনটা যাতে না মনে হয়, সে জন্য তিনি তাঁর বক্তব্য দেওয়ার সময় শব্দচয়নে সতর্ক ছিলেন
ছবি : রয়টার্স

ভারতের ক্ষমতাসীন বিজেপি সরকার আবার তেলেবেগুনে জ্বলে উঠেছে। সম্প্রতি যুক্তরাজ্য সফরের সময় কংগ্রেস নেতা রাহুল গান্ধী বলেছেন, ভারতে গণতন্ত্র আক্রান্ত হয়েছে এবং তার প্রভার বাকি বিশ্বেও পড়ছে। তিনি দেশে ফেরার পরই এই মন্তব্য নিয়ে তোলপাড় শুরু হয়।

বিজেপির মুখপাত্র রবিশংকর প্রসাদ অভিযোগ করেন, রাহুল ‘ভারতের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ’ করার জন্য যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপকে আমন্ত্রণ জানিয়েছেন। তিনি কংগ্রেসের সভাপতি মল্লিকার্জুন খাড়গে এবং তাঁর পূর্বসূরি সোনিয়া গান্ধীকে অবিলম্বে রাহুলের বক্তব্যকে ‘বর্জনীয়’ ঘোষণা করতে বলেছেন।

তিনি বলেছেন: ‘বিজেপি অত্যন্ত বেদনার সঙ্গে বলছে, রাহুল গান্ধী তাঁর বক্তব্যের মাধ্যমে ভারতের গণতন্ত্র, রাজনীতি, পার্লামেন্ট, রাজনৈতিক শিষ্টাচার ও বিচারব্যবস্থাকে লজ্জা দিতে চেয়েছেন।’

তথ্য ও সম্প্রচারমন্ত্রী অনুরাগ ঠাকুর আরও কড়া ভাষায় রাহুল গান্ধীকে ভারতের সঙ্গে ‘বিশ্বাসঘাতকতা’ করা থেকে বিরত থাকতে বলেছেন। তিনি রাহুলকে হুঁশিয়ারি দিয়ে বলেছেন, ‘বিদেশের মাটিতে দাঁড়িয়ে ভারতের নামে আপনার করা এসব মিথ্যাচার কেউ বিশ্বাস করবে না।’ তিনি বলেছেন, রাহুল ‘ভারতকে খাটো করার একটা সুযোগও ছাড়তে চান না’ এবং গোটা কংগ্রেস পার্টিই এই কাজ করে; তারা ‘স্থানীয় বিষয়কে জাতিসংঘে নিয়ে’ দেখিয়ে দিয়েছে, তারা ‘এখনো দাসত্বের চিন্তা থেকে বের হতে পারেনি’।

চলমান এই চায়ের কাপের রাজনৈতিক বিতর্কের ঝড় শুধু ক্ষমতাসীন দল এবং বিরোধী দলের (আমি যার সদস্য) কাদা–ছোড়াছুড়িতে আটকে থাকছে না। এটি ভারতের চলমান গণতান্ত্রিক অবস্থার এমন একটি গভীর চিড়কে সামনে এনেছে, যা আসন্ন জাতীয় নির্বাচনকে সামনে রেখে আগামী বছরজুড়ে ক্রমবর্ধমানভাবে দৃশ্যমান হতে থাকবে। সন্দেহ নেই, রাহুলের বিরুদ্ধে আনা বিজেপির অভিযোগটি অত্যন্ত গুরুতর। বিজেপি নেতা রবিশংকর প্রসাদ যে কথাটি বলতে গিয়ে তাঁর মর্মবেদনা প্রকাশ করেছেন, তা হলো কোন দল ক্ষমতায়, সেটি কোনো বিষয় নয়; ভারত সব সময়ই তার অভ্যন্তরীণ বিষয়ে বাইরের হস্তক্ষেপের জোরালো প্রতিবাদ করে থাকে। স্বাধীনতা লাভের পর থেকেই ভারত তার সার্বভৌমত্বের প্রশ্নে ছাড় দেয় না।

নিজেদের রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত নিজেরা নিতে পারার স্বাধীনতা থেকে দুই শ বছর বঞ্চিত থাকার পর ভারতীয়রা তাদের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে বাইরের, বিশেষ করে ভারতের সাবেক ঔপনিবেশিক প্রভু ও তাদের পশ্চিমা মিত্রদের নাক গলানোর বিষয়ে চরম সংবেদনশীল। ঔপনিবেশিক শাসন থেকে ভারতের স্বাধীনতা লাভ তার ‘কৌশলগত স্বাধিকার’–এর সঙ্গে নিবিড়ভাবে জড়িয়ে আছে।

তা ছাড়া রাহুলের বিরুদ্ধে এ অভিযোগ করাটাও অন্যায্য কারণ, তিনি ভারতের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে বিদেশিদের হস্তক্ষেপ চান—এমনটা যাতে না মনে হয়, সে জন্য তিনি তাঁর বক্তব্য দেওয়ার সময় শব্দচয়নে সতর্ক ছিলেন। বস্তুত তাঁর বলার ভঙ্গিমায় এ দ্যোতনা নিহিত ছিল যে ভারতের গণতন্ত্র যে সংকটের মুখে পড়েছে, তা একটি ‘অভ্যন্তরীণ সমস্যা’, তা একটি ‘ভারতীয়দের নিজেদের সমস্যা’ এবং ‘সমাধান ভারতের ভেতর থেকেই আসতে হবে’।

বৈশ্বিক বিষয়ে স্বাধীনভাবে নিজের সিদ্ধান্ত নেওয়ার অধিকার ভারত সংরক্ষণ করে থাকে। শীতল যুদ্ধের সময় কোনো পক্ষকে সমর্থন দিতে অস্বীকার করে ভারত সগৌরবে নিজেকে জোট নিরপেক্ষ দেশ হিসেবে ঘোষণা দিয়ে ভারত সেই অধিকার চর্চা করে আসছে।

অভ্যন্তরীণ বিষয়ে বিদেশিদের উপদেশ সহ্য না করার বিষয়ে সব ভারতীয় এককাট্টা। নানান রাজনৈতিক মত-পথের মধ্যে স্বাধীনতার এই চেতনা সব রাজনৈতিক দলকে এই ইস্যুতে এক করেছে। আমাদের নিজেদের মধ্যে যতই মতানৈক্য থাকুক, আমাদের সার্বভৌমত্বে বাইরের হস্তক্ষেপ আমরা কেউ মেনে নিই না।

সেই দৃষ্টিকোণ থেকে দেখলে, রাহুল গান্ধীর বিরুদ্ধে বিজেপির আনা অভিযোগ কতটা গুরুতর তা বোঝা যায়। কিছু কথা আছে, যা দেশের মাটিতে উচ্চারণ করলে লোকে কদাচিৎ ভুরু কোঁচকায়, কিন্তু সেই একই কথা বিদেশে বললে, বিশেষ করে ব্রিটেনে বললে তা প্রায় দেশদ্রোহের শামিল হয়ে যায়। যাঁরা রাহুল গান্ধীর বিরুদ্ধে জাতীয় ঐকমত্য লঙ্ঘনের অভিযোগ তুলে ক্ষোভ ঝাড়ছেন, তাঁরা একটি সত্যকে এড়িয়ে যাচ্ছেন। সেটি হলো, এই জাতীয় ঐকমত্যের শর্ত লঙ্ঘনের কাজটি প্রথম যিনি করেছেন, তিনি আর কেউ নন, তিনি খোদ প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি।

প্রথম দফায় প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হওয়ার পর ২০১৪ সালে যুক্তরাষ্ট্রে সফর করার পর সেখানে দাঁড়িয়ে তিনি ভারতবাসীকে হতবাক করে দিয়ে বলেছিলেন, গত সাত দশকে ভারতে ভালো কিছুই হয়নি। তিনি বলেছিলেন, কেবল তিনি নির্বাচিত হওয়ার পর থেকেই ভারতীয়রা বিদেশে মাথা তুলে দাঁড়াতে পারছেন।

শুধু মোদির বক্তব্য বিদেশে ভারতের জাতীয় ঐকমত্যকে খর্ব করেনি, বিজেপির কাজেও তা প্রকাশ পেয়েছে। ভারতের সংসদীয় কমিটির ইতিহাসে প্রথম থেকেই পররাষ্ট্রবিষয়ক কমিটির সভাপতি হয়ে থাকেন বিরোধী দলের একজন এমপি। পররাষ্ট্রনীতি প্রশ্নে সরকারি-বিরোধী দলে কোনো ভেদ নেই—বিদেশে এমন বার্তা দিতেই এটি করা হয়ে থাকে। কিন্তু ২০১৯ সালে বিজেপি ওই পদ থেকে কংগ্রেসের এমপিকে (তখন ওই পদে আমি ছিলাম) কোনো ধরনের ব্যাখ্যা ছাড়াই সরিয়ে দিয়ে সেখানে বিজেপির এমপিকে বসানো হয়।

বিজেপির নেতারা যদি তাঁদের নিজেদের দলই জাতীয় ঐকমত্যের নীতি লঙ্ঘন করে চলেছে উল্লেখ করে রাহুলের বিরুদ্ধে অভিযোগটা করতেন, তাহলে তা কিছুটা ধোপে টিকত।

তা ছাড়া রাহুলের বিরুদ্ধে এ অভিযোগ করাটাও অন্যায্য কারণ, তিনি ভারতের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে বিদেশিদের হস্তক্ষেপ চান—এমনটা যাতে না মনে হয়, সে জন্য তিনি তাঁর বক্তব্য দেওয়ার সময় শব্দচয়নে সতর্ক ছিলেন। বস্তুত তাঁর বলার ভঙ্গিমায় এ দ্যোতনা নিহিত ছিল যে ভারতের গণতন্ত্র যে সংকটের মুখে পড়েছে, তা একটি ‘অভ্যন্তরীণ সমস্যা’, তা একটি ‘ভারতীয়দের নিজেদের সমস্যা’ এবং ‘সমাধান ভারতের ভেতর থেকেই আসতে হবে’।

তিনি বিদেশিদের বলেছেন, ভারতের গণতন্ত্র একটি ‘বৈশ্বিক জনসম্পদ’; যদি এটি ধসে পড়ে তাহলে ‘এই গ্রহের গোটা গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা ক্ষতিগ্রস্ত হবে।’ তিনি বলেছেন, ভারতে যা ঘটছে তা শুধু ভারতের মানুষের ব্যাপার নয়, এটি পশ্চিমাদেরও জন্যও গুরুত্ব বহন করে।

স্বত্ব: প্রজেক্ট সিন্ডিকেট, অনুবাদ: সারফুদ্দিন আহমেদ

  • শশী থারুর ভারতের সাবেক পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী ও জাতিসংঘের সাবেক আন্ডার সেক্রেটারি জেনারেল