পাকিস্তানে বিক্ষোভকারীদের কেন বাধা দেওয়া হলো না

ইমরান খানের গ্রেপ্তারের পর পাকিস্তানজুড়ে তাঁর সমর্থকদের বিক্ষোভ ছড়িয়ে পড়ে। পুড়িয়ে দেওয়া পুলিশের একটি গাড়ির সামনে এক বিক্ষোভকারীর বিজয় চিহ্ন প্রদর্শন। ৯ মে, করাচি।
ছবি: রয়টার্স

পাকিস্তানিদের কাছে তাঁদের রাজনৈতিক নেতাদের কাছ থেকে ফাঁকা বুলি শোনাটা একেবারে জলভাত; দেশটির রাজনীতিতে ফাঁকা আওয়াজ তোলাটা হরেদরেই চলে। দেশটির রাজনীতি প্রতিনিয়ত এমনভাবে ওল্টাতে–পাল্টাতে থাকে যে ‘নজিরবিহীন’ কথাটা সেখানে বহুব্যবহৃত হতে হতে একেবারে অর্থহীন অবস্থায় এসে দাঁড়িয়েছে।

এরপরও সেখানে এখন যা ঘটছে, তাকে প্রকৃতপক্ষেই নজিরবিহীন বলা চলে।
ইসলামাবাদ হাইকোর্টে হুইলচেয়ারে চেপে হাজিরা দিতে আসা পাকিস্তানের সাবেক প্রধানমন্ত্রী ও তেহরিক–ই–ইনসাফের (পিটিআই) চেয়ারম্যান ইমরান খানকে আধা সামরিক বাহিনীর একটি বিশাল দল নাটকীয়ভাবে গ্রেপ্তার করার পর গোটা পাকিস্তানে যেন অনেক দিনের পুঞ্জীভূত ক্ষোভ বিস্ফোরিত হয়েছে। বন্যার পানির মতো বিক্ষুব্ধ মানুষ নেমে এসেছে।

পাকিস্তানের মানুষের এই রাগ নতুন কিছু নয়। আমরা দেশটির রাজপথে ইতিপূর্বে বহু সহিংস বিক্ষোভ দেখেছি এবং কোনো সন্দেহ নেই, আগামী দিনে আরও দেখতে হবে। কিন্তু বিক্ষোভের এবারের নিশানা হলো সেই শক্তি, ঐতিহাসিকভাবে যারা চরম ক্রুদ্ধ জনতাকেও দমন করতে কোনো কুণ্ঠা বোধ করে না। সেই শক্তি হলো পাকিস্তানের সর্বোচ্চ ক্ষমতাধর সামরিক গোষ্ঠী।

এবারের বিক্ষোভে দেখা যাচ্ছে, বিক্ষোভকারীরা লাহোরের কোর কমান্ডারের সরকারি বাসভবন তছনছ করেছেন; তাঁর ঘরের আসবাব আঙিনায় ছুড়ে ফেলে আগুন ধরিয়ে দিয়েছেন এবং সেই ছবি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে তাঁরা পোস্টও করেছেন।

তাঁদের অনেককে বীরদর্পে ঘরে ঝোলানো পেইন্টিং থেকে শুরু করে ফ্রিজে রাখা স্ট্রবেরি লুট করে নিয়ে যেতে দেখা গেছে। এমনকি একজন বিক্ষোভকারীকে বাগানে ছেড়ে দেওয়া ময়ূরও ধরে নিয়ে যেতে দেখা গেছে। এরপর পুরো ভবনে আগুন লাগিয়ে দেওয়া হয়। এর চেয়েও তাৎপর্যপূর্ণ বিষয় ছিল, একজন নারীর নেতৃত্বে বিক্ষোভকারীরা রাওয়ালপিন্ডির সামরিক বাহিনীর স্নায়ুকেন্দ্র সদর দপ্তরের ফটক কাঁপিয়ে দিয়েছে।

অবাক করা বিষয় হলো এই বিক্ষোভকারীদের শুরুতে তেমন কোনো বাধা দেওয়া হয়নি এবং সে কারণেই অনেকের মনে ধারণা জন্মেছে, ইমরানের সমর্থকদের ওপর ব্যাপক ধরপাকড় করার অভিযানের একটি জোরাল অজুহাত সৃষ্টির জন্যই বিক্ষোভকারীদের ভাঙচুর করতে দেওয়া হয়েছে। অথচ এই কিছুদিন আগেও সামরিক শক্তির সঙ্গে ইমরান খানের দহরমমহরম ছিল এবং তাঁকে ক্ষমতায় বসতে সেনাবাহিনী সহায়তাও করেছিল। সেনাগোষ্ঠী এখন চরমভাবে ইমরানবিরোধী হয়ে পড়েছে।

মনে হচ্ছে, পিটিআইয়ের অনেক নেতা সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে যাওয়ার পরিণতি কী হতে পারে, তা বুঝতে পারছেন এবং দলকে সহিংসতা থেকে দূরে রাখার জন্য চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। দলের অন্যরা সম্ভবত মনে করছেন, ইমরান ইস্যুতে সেনাবাহিনীর মধ্যে বিভক্তি সৃষ্টি হয়েছে বলে বিক্ষোভকারীদের তেমনভাবে বাধা দেওয়া হয়নি, যদিও সেই ধারণার পক্ষে তেমন কোনো প্রমাণ নেই।

ইমরান খান নিজেও সামরিক গোষ্ঠীর পৃষ্ঠপোষকতাপুষ্ট হয়ে তাঁর রাজনৈতিক প্রতিপক্ষদের জেলে ঢুকিয়েছেন এবং বিরোধীদের দমনে কড়া নির্দেশ দিয়েছেন। এখন সেনাগোষ্ঠীর ছত্রচ্ছায়া থেকে ছিটকে গিয়ে তিনি ন্যায়বিচারের পক্ষে ও সেনাগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়েছেন।

আর একটি ব্যাখ্যা হলো, কর্তৃপক্ষ হয়তো রক্তপাত এড়ানোর চেষ্টা করেছিল; কিন্তু পাকিস্তানের ক্ষমতার রাজনীতির সুবিশাল ‘বাইজান্টাইন বিশ্বে’ কোনটি যে ছায়া আর কোনটি যে কায়া, তা নিশ্চিত করে বলা প্রায়শই অসম্ভব।

পাকিস্তানের অন্যান্য এলাকায় সরকারি ভবন, বাস ও টোল বুথে আগুন ধরিয়ে দেওয়া হয়েছে এবং কমপক্ষে একটি স্কুলভবন জ্বালিয়ে ছাই করে দেওয়া হয়েছে।

অনেক জায়গায় বিক্ষোভকারী ও নিরাপত্তাকর্মীদের মধ্যে সংঘাত হয়েছে। এতে উভয় পক্ষের কয়েকজন নিহত হয়েছেন। ইমরানের দলের বেশ কয়েকজন নেতাকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।

মাত্র দুই বছর আগে ইমরানের পিটিআই ও সামরিক গোষ্ঠীর মধ্যে জোরাল মৈত্রী ছিল। সে সময়ে ইমরান তাদের বিরুদ্ধে ধরপাকড় চালিয়েছিলেন, যাঁরা এখন ক্ষমতা পেয়ে সেই একই কাজ ইমরানের বিরুদ্ধে করছেন।

ইমরানের বিরুদ্ধে পার্লামেন্টে অনাস্থা ভোট আয়োজন করার সময়ই স্পষ্ট হয়েছিল, তাঁর মাথা থেকে সামরিক গোষ্ঠীর আশীর্বাদের ছায়া সরে গেছে। এই বিষয়টি স্পষ্ট হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে পিটিআইয়ের প্রধান প্রধান জোট শরিক সরে যায়; এমনকি পিটিআইয়ের কয়েকজন নেতাও দল থেকে বেরিয়ে যান।

কৌশলী ইমরান খান তাঁকে উৎখাত করার জন্য দ্রুতই যুক্তরাষ্ট্রের ‘চক্রান্তকে’ দায়ী করেন এবং তারপরই তিনি সেনাপ্রধান জেনারেল কামার জাভেদ বাজওয়ার দিকে তাঁর অভিযোগের তির নিশানা করেন।

একসময় বাজওয়াকে ইমরান খান প্রশংসা করলেও পরে তাঁকে তিনি বিশ্বাসঘাতক আখ্যায়িত করেন এবং সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম থেকে জনসভা—সর্বত্র তাঁর তীব্র সমালোচনা করেন। শুধু তা–ই নয়। ইমরান খান সামরিক গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে সর্বস্তরের জনগণকে রুখে দাঁড়ানোর আহ্বান জানান।

আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সঙ্গে ইমরান খানের দল তেহরিক-ই-ইনসাফের কর্মী–সমর্থকদের ব্যাপক সংঘর্ষ। রাজধানী ইসলামাবাদে।

ইমরানের এই অবস্থান প্রশংসনীয় হতো, যদি তাতে ভণ্ডামি না থাকত। এর কারণ হলো এই সদ্য বিপ্লবীদের মধ্যে অনেকেই কিছুদিন আগেও সামরিক বাহিনী সম্পর্কে অনেক বেশি নমনীয় ছিলেন। সেনাবাহিনীর সমালোচনাকে রাষ্ট্রদ্রোহ হিসেবে চিহ্নিত করা হতে পারে ভেবে তাঁরা অনেক বেশি সতর্ক ছিলেন। ইমরানের সরকারের সমালোচনা করা সাংবাদিকদের ওপর যখন হামলা হচ্ছিল, তাঁদের অপহরণ করা হচ্ছিল, এমনকি যখন গুলি করা হচ্ছিল, তখন তাঁরা আনন্দ প্রকাশ করেছেন।

ইমরান খান নিজেও সামরিক গোষ্ঠীর পৃষ্ঠপোষকতাপুষ্ট হয়ে তাঁর রাজনৈতিক প্রতিপক্ষদের জেলে ঢুকিয়েছেন এবং বিরোধীদের দমনে কড়া নির্দেশ দিয়েছেন।

এখন সেনাগোষ্ঠীর ছত্রচ্ছায়া থেকে ছিটকে গিয়ে তিনি ন্যায়বিচারের পক্ষে ও সেনাগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়েছেন।

এখন ইমরানের বিরুদ্ধে করা মামলার মেরিট থাকা না থাকা নিয়ে যতই মত–দ্বিমত থাকুক, এ বিষয়ে খুব কমই সন্দেহ আছে যে সেনাগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে আন্দোলনের ডাক দেওয়ার পরিণতি হিসেবেই তাঁকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। বিশেষ করে তাঁকে হত্যাচেষ্টার পর তিনি এই হত্যা পরিকল্পনার জন্য একজন চাকরিরত সেনা কর্মকর্তাকে প্রধান পরিকল্পনাকারী হিসেবে উল্লেখ করার পর সেনাগোষ্ঠী তাঁর ওপর ভয়ানক রুষ্ট হয়েছে।

কূটাভাস হলো এই, পাকিস্তানের বেসামরিক রাজনৈতিক দলগুলো প্রায়শই অপেক্ষা করতে থাকে কখন সেনাগোষ্ঠীর সুদৃষ্টি তাদের ওপর পড়বে এবং তাঁরা ক্ষমতার স্বাদ নিতে পারবে। একই সঙ্গে তারা সেনাগোষ্ঠী প্রতিপক্ষকে কখন শায়েস্তা করবে, তার জন্য অপেক্ষা করে। ফলে সামরিক গোষ্ঠীর খপ্পর থেকে তাদের পক্ষে আর বের হওয়া সম্ভব হয় না। এ কারণেই দেশটির জন্মের পর থেকে সেই একই চিত্রনাট্য সেখানে মঞ্চস্থ হয়ে যাচ্ছে।

আল–জাজিরা থেকে নেওয়া, ইংরেজি থেকে অনূদিত

  • জারার খুহরো পাকিস্তানি সাংবাদিক, কলাম লেখক ও টক শো সঞ্চালক