আজ আন্তর্জাতিক গুম প্রতিরোধ দিবস। শেখ হাসিনা সরকারের আমলে গুম হয়ে ওঠে রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ ও ভিন্নমতাদর্শীদের দমন–নিপীড়নের অন্যতম এক হাতিয়ার। সেসব গুমের তদন্তে অন্তর্বর্তী সরকার একটি কমিশন গঠন করেছে। গুমের ঘটনা তদন্তে শ্রীলঙ্কা ও আর্জেন্টিনার অভিজ্ঞতা বর্ণনা করে এ কমিশনের প্রতি প্রত্যাশা নিয়ে লিখেছেন কল্লোল মোস্তফা
আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হাতে সংঘটিত গুমের ঘটনা তদন্তে একটি কমিশন গঠন করেছে অন্তর্বর্তী সরকার। ২৭ আগস্ট হাইকোর্টের একজন অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতির নেতৃত্বে গঠিত ৫ সদস্যের এই কমিশনের কার্যপরিধির মধ্যে রয়েছে, ২০১০ সালের জানুয়ারি থেকে ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট পর্যন্ত গুম হওয়া ব্যক্তিদের সন্ধান, তাঁদের শনাক্ত করা এবং কোন পরিস্থিতিতে গুম হয়েছিলেন, সেটা নির্ধারণ করা; জোরপূর্বক গুমের ঘটনাগুলোর বিবরণ সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কাছে দাখিল করা এবং এ ব্যাপারে সুপারিশ প্রদান; গুম হওয়া ব্যক্তিদের সন্ধান পাওয়া গেলে আত্মীয়স্বজনকে অবহিত করা; গুমের ঘটনা সম্পর্কে অন্য কোনো সংস্থা বা প্রতিষ্ঠান কর্তৃক পরিচালিত তদন্তের তথ্য সংগ্রহ করা। এ জন্য কমিশনকে সময় দেওয়া হয়েছে ৪৫ দিন।
গুমের ঘটনা তদন্তে এই কমিশন গঠন খুবই জরুরি একটি কাজ ছিল। শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ সরকার দীর্ঘদিন ধরে বিরোধী দলের আন্দোলন ও ভিন্নমত দমনের জন্য গুমের মতো মানবতাবিরোধী অপরাধে লিপ্ত ছিল।
গত দেড় দশকে বিভিন্ন আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর পরিচয়ে বাসা, অফিস কিংবা রাস্তা থেকে মানুষকে তুলে নিয়ে গিয়ে পরবর্তী সময়ে অস্বীকার করা হয়েছে। এঁদের মধ্যে কেউ ফিরে এসেছেন, কারও লাশ পাওয়া গেছে আবার অনেকে দীর্ঘদিন ধরে নিখোঁজ। স্বজনেরা দিনের পর দিন বিভিন্ন বাহিনীর দ্বারে দ্বারে ঘুরেও তাঁদের কোনো খোঁজ পাননি।
মানবাধিকার সংগঠন এশিয়ান হিউম্যান রাইটস কমিশনের (এএইচআরসি) হিসাবে, ২০০৯ থেকে ২০২২ সাল পর্যন্ত দেশে ৬২৩ ব্যক্তি গুমের শিকার হন। তাঁদের মধ্যে ৮৪ জনের মরদেহ উদ্ধার করা হয়েছে, জীবিত অবস্থায় ফিরে এসেছেন বা পরবর্তী সময়ে গ্রেপ্তার দেখানো হয়েছে ৩৮৩ জনকে। এখনো নিখোঁজ রয়েছেন ১৫৩ ব্যক্তি আর তিনজনের বিষয়ে কোনো তথ্য জানা যায়নি। (এখনো নিখোঁজ ১৫৩ জন, অপেক্ষায় স্বজনেরা, প্রথম আলো, ৩০ আগস্ট ২০২৩)
গণ-অভ্যুত্থানে হাসিনা সরকারের পতনের দুই দিনের মধ্যে গুমের শিকার অন্তত তিনজন ‘আয়নাঘর’ নামে পরিচিত কুখ্যাত বন্দিশালা থেকে ফিরে এলেও এখনো বহু মানুষ নিখোঁজ। অনেকেই জানেন না, তাঁদের স্বজনদের ভাগ্যে কী ঘটেছে। গুমের ঘটনায় কারা কীভাবে জড়িত, সেসব বিষয়েও রয়েছে অনেক প্রশ্ন। এমনকি যারা ফিরে এসেছেন তাদেরকেও কারা কোথায় আটকে রেখেছিলো তা সুস্পষ্ট ভাবে জানা যায়নি।
সব মিলিয়ে গুমবিষয়ক কমিশনের কাছে নিখোঁজদের স্বজন ও মানবাধিকারকর্মীদের প্রত্যাশা অনেক। এ ক্ষেত্রে বিশ্বের অন্যান্য দেশে গুমবিষয়ক বিভিন্ন তদন্ত রিপোর্টে কী কী বিষয় উন্মোচিত হয়েছে, সেগুলো খতিয়ে দেখা যেতে পারে।
মাহিন্দা রাজাপক্ষে শ্রীলঙ্কার প্রেসিডেন্ট থাকা অবস্থায় ২০০৮ থেকে ২০১৪ সালে শ্রীলঙ্কা নেভির স্পেশাল ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের মাধ্যমে ‘গান সাইট’ নামে পরিচিত মাটির নিচের গোপন নির্যাতনকেন্দ্রে গুম, খুন ও নির্যাতনের ঘটনা ঘটানো হতো।
এ বিষয়ে দক্ষিণ আফ্রিকাভিত্তিক সংস্থা ইন্টারন্যাশনাল ট্রুথ অ্যান্ড জাস্টিস প্রজেক্ট ২০১৮ সালে ‘দ্য শ্রীলঙ্কান নেভি: টার্নিং আ কালেকটিভ ব্লাইন্ড আই’ নামে একটি তদন্ত রিপোর্ট প্রকাশ করে। এই রিপোর্টে যেসব বিষয় কাভার করা হয় তার মধ্যে রয়েছে, গুম ও নির্যাতনের শিকার ব্যক্তিদের পরিচয় ও সংখ্যা, অপহরণের প্রক্রিয়া, ত্রিংকোমালির নিপীড়নকেন্দ্রসহ বিভিন্ন নিপীড়ন কেন্দ্রের বর্ণনা, যে পরিস্থিতিতে আটক রাখা হতো, তার বর্ণনা, নির্যাতনের বর্ণনা, দায়ী সন্দেহভাজনদের পরিচয়, উচ্চপর্যায়ের কর্মকর্তাদের সংশ্লিষ্টতাবিষয়ক আলোচনা ইত্যাদি।
গুমবিষয়ক তদন্ত কমিশনের রিপোর্ট কেমন হতে পারে, তার একটা উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত ১৯৭০-এর দশকে আর্জেন্টিনার সামরিক জান্তার চালানো গুমবিষয়ক তদন্ত কমিটির রিপোর্ট, যার নাম ‘নুনকা মাস’ বা নেভার এগেইন (কখনোই না)। রিপোর্টটি বই আকারে প্রকাশের সময় রোনাল্ড ডর্কিন এর ভূমিকায় এই রিপোর্টকে ‘নরকের রিপোর্ট’ বলে অভিহিত করেছিলেন।
এই রিপোর্টে যেসব বিষয় তুলে ধরা হয়েছে সেগুলো হলো, অপহরণের বিভিন্ন পদ্ধতি, অপহরণের পর নির্যাতনের বিস্তারিত বর্ণনা, গোপন বন্দিশালাগুলোর অবস্থান, বর্ণনা ও তার পরিচালনা পদ্ধতি, হত্যা ও লাশ গুম করার বিভিন্ন পদ্ধতির বর্ণনা, গুমের সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিদের সাংগঠনিক কাঠামো ও পরিচয়, বিচার বিভাগ ও আইনজীবীদের ভূমিকা, ভিকটিমের বর্ণনা, গুমের পেছনের রাজনৈতিক মতাদর্শের বিবরণ ইত্যাদি।
এই কাজগুলো করা সহজ ছিল না। আর্জেন্টিনার এই গুমবিষয়ক তদন্ত কমিশন যখন গঠিত হয়েছে, ততদিনে সমস্ত তথ্য প্রমাণ ও নথিপত্র নষ্ট করে ফেলার চেষ্টা করা হয়েছে। ফলে কমিশনকে অনেক ক্ষেত্রে গুম হওয়া ব্যক্তির স্বজন, বন্দিত্ব থেকে মুক্তি পাওয়া ব্যক্তি এমনকি গুমের কাজে সহযোগিতা করে পরবর্তীতে অনুতপ্ত ব্যক্তিদের বক্তব্য ও স্বাক্ষাৎকারের ভিত্তিতে তথ্য উদঘাটন করতে হয়েছে।
তদন্ত কমিশনকে গুমের জন্য দায়ী ব্যক্তি গোষ্ঠীর হুমকির মধ্যে কাজ করতে হয়েছে যেহেতু দায়ী ব্যক্তিদের অনেকেই তখনো ক্ষমতাবান ছিলেন। তাঁদের বিরুদ্ধে অভিযোগ করা হয়েছে যে তাঁরা অতীত নিয়ে বেশি ঘাঁটাঘাঁটি করে ঘৃণা বিদ্বেষ উস্কে দিচ্ছেন, জাতীয় নিরাপত্তা ও জাতীয় সংহতি বিনষ্ট করছেন। এইসব বাধা বিপত্তি অতিক্রম করে যে বিস্তারিত রিপোর্টটি তারা তৈরি করেছিলেন, তা পরবর্তীতে আর্জেন্টিনায় গুমের জন্য দায়ী ব্যক্তিদের বিচারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে, সেই সাথে সারা দুনিয়ায় গুম ও নির্যাতনের বিরুদ্ধে লড়াই করা মানবাধিকারকর্মীদের জন্য একটি রেফারেন্স হিসেবে কাজ করেছে।
এসব বিবেচনা করে বাংলাদেশের গুমবিষয়ক কমিশনের রিপোর্টে যেসব প্রশ্নের উত্তর থাকা প্রয়োজন বলে মনে করছি সেগুলো এখানে উল্লেখ্য করা হলো:
গুমের সিদ্ধান্ত কীভাবে নেওয়া হতো? আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা নিজেরা সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতেন, নাকি স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বা প্রধানমন্ত্রী পর্যায়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হতো? প্রতিটি গুমের সিদ্ধান্ত আলাদা আলাদাভাবে গ্রহণ করা হতো, নাকি সরকারের উচ্চপর্যায় থেকে হাই লেভেলে অনুমোদন দেবোয়া হতো আর বাহিনীগুলো নিজস্ব ম্যাকানিজমের মাধ্যমে প্রতিটি গুমের ঘটনা ঘটাত? কখনো গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিকে গুম করা হয়েছে আবার কখনো সাধারণ রাজনৈতিক কর্মীকেও গুম করা হয়েছে। এই দুই ধরনের গুমের সিদ্ধান্ত গ্রহণ ও বাস্তবায়ন প্রক্রিয়ার মধ্যে কি কোনো পার্থক্য ছিল?
ঠিক কতসংখ্যক মানুষকে গুম করা হয়েছে এবং তাঁদের কার ভাগ্যে কী ঘটেছে? কাদেরকে গুম করা হবে, সেটা কীভাবে কোন বৈশিষ্ট্য ধরে নির্ধারিত হতো? কোন কোন রাষ্ট্রীয় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী গুমের কাজে অংশ গ্রহণ করেছে?
গুমের সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন কে বা কারা করবেন, সেটা কীভাবে নির্ধারিত হতো? যাঁরা গুমের কাজে অংশগ্রহণ করতেন, তাঁদের মোটিভেশন কী ছিল? তাঁরা কি পদোন্নতি বা অন্য কোনো সুবিধার বিনিময়ে গুমের কাজে অংশগ্রহণ করতেন, নাকি তাঁদের বাধ্য করা হতো?
গুমের সিদ্ধান্ত গ্রহণ থেকে শুরু করে বাস্তবায়ন পর্যন্ত পুরো প্রক্রিয়াটি মৌখিক নির্দেশে বাস্তবায়িত হতো, নাকি কোনো লিখিত অনুমোদন প্রক্রিয়া ছিল? এ-সংক্রান্ত কোনো সরকারি নথি পাওয়া যায় কি না, অনুসন্ধান করতে হবে।
বিভিন্ন ধরনের মানুষ গুমের শিকার হয়েছেন, যাঁদের মধ্যে বিরোধী রাজনৈতিক কর্মী থেকে শুরু করে জঙ্গি-সন্ত্রাসী হিসেবে অভিযুক্ত ব্যক্তি ছিলেন। এঁদের সবার ক্ষেত্রে সিদ্ধান্ত গ্রহণ ও বাস্তবায়নের প্রক্রিয়া কি এক রকম ছিল, নাকি বিভিন্ন ক্ষেত্রে বিভিন্ন প্রক্রিয়া ও বিভিন্ন ব্যক্তি/প্রতিষ্ঠান যুক্ত ছিল?
গুম করে কাউকে হত্যা করা হয়েছে, কাউকে কিছুদিন আটকে রেখে ছেড়ে দেওয়া হয়েছে আবার কাউকে দীর্ঘদিন আটকে রাখা হয়েছে—এ রকম ভিন্ন ভিন্ন আচরণের কারণ ও ব্যাখ্যা কী? কাকে হত্যা করা হবে আর কাকে আটকে রাখা হবে আর কাকে ছেড়ে দেওয়া হবে, এটা কীভাবে নির্ধারিত হতো? কমান্ড স্ট্রাকচার কেমন ছিল?
গুমের পর কী ধরনের শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন করা হতো? এগুলোর কোনো নির্দিষ্ট ধরন ছিল কি না? এসব নির্যাতনে কারা অংশগ্রহণ করতেন?
গুম করার আইডিয়াটা কার বা কাদের মাথায় প্রথম আসে এবং কীভাবে এটা সরকারের কাছে গ্রহণযোগ্য একটা প্রক্রিয়া হয়ে ওঠে? গুমের পেছনের মতাদর্শগত দিকটি কী ছিল?
কোন কোন বাহিনী গুমের সঙ্গে জড়িত ছিল এবং এদের মধ্যে কোন বাহিনীর বন্দিশালা কোথায়, কতগুলো ছিল? আয়নাঘর নামে পরিচিত এই বন্দিশালাগুলোর অবকাঠামো ও লেআউট কেমন ছিল? এগুলোর গোপনীয়তা কীভাবে বজায় রাখা হতো?
আয়নাঘর নামে পরিচিতি পাওয়া এই বন্দিশালাগুলো কীভাবে ম্যানেজ করা হতো? এগুলো কি আগে থেকেই ছিল, নাকি আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসবার পর এগুলো তৈরি করা হয়েছে? এগুলো কি সরকারের নিজস্ব স্থাপনা, নাকি ভাড়া নেওয়া? এগুলো পরিচালনা করার লোকবল ও বাজেট কোন খাত থেকে আসত? অফিশিয়ালি এই খরচকে কোন খাতের খরচ হিসেবে দেখানো হতো?
যাঁদের গুম করার পর হত্যা করা হয়েছে, তাঁদের কোথায় কীভাবে হত্যা করা হয়েছে? কারা হত্যা করেছে? লাশ কীভাবে গুম করা হয়েছে? এগুলোর কি কোনো নির্দিষ্ট প্যাটার্ন বা ধরন ছিল, নাকি একেক বাহিনী এগুলো যার যার মতো বাস্তবায়ন করত?
কোনো ব্যবস্থাকে চিরতরে উচ্ছেদ করতে হলে ব্যবস্থাটি কীভাবে কাজ করে, এ সম্পর্কে সম্যক ধারণা অর্জন প্রয়োজন। বাংলাদেশে গুমের রাজনীতি যেন ফিরে আসতে না পারে, সে জন্য গুম সম্পর্কে এই সব প্রশ্নের উত্তর যথাযথভাবে জানা প্রয়োজন। শুধু গুমের সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিকে শনাক্ত করাই যথেষ্ট নয়, গুমের ভাবাদর্শগত ও প্রক্রিয়াগত দিক সম্পর্ক বিস্তারিত জানা গেলেই ভবিষ্যতে গুম প্রতিরোধে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করা যাবে। আশা করি সদ্য গঠিত গুম কমিশন স্বচ্ছতা ও জবাবদিহির সঙ্গে এই কাজগুলো যথাযথভাবে সম্পন্ন করতে পারবে এবং তদন্ত রিপোর্ট সবার জন্য জন্য উন্মুক্ত করা হবে।
কল্লোল মোস্তফা লেখক ও গবেষক