এবারের বাজেটের ভালো–মন্দ দিক

আগামী ২০২৩-২৪ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেট নির্বাচনের বছরের বাজেটই শুধু নয়, মূল্যস্ফীতির চাপ কমানো আর সামষ্টিক অর্থনীতির স্থিতিশীলতা বজায় রাখার দ্বিমুখী চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করারও বাজেট। এর পাশাপাশি আন্তর্জাতিক অর্থ তহবিলের ঋণের শর্ত পূরণের জন্য বাজেটে প্রয়োজনীয় সংস্কারের চাপ তো আছেই। তবে সামষ্টিক অর্থনীতির বিবেচনায় কিছুটা সংকোচনমূলক বাজেট হবে বলে মনে করা হলেও প্রকৃত অর্থে সেটি হয়নি, বরং এটি কিছুটা সম্প্রসারণমূলকই বটে।

রাজস্ব খাতের পরিপ্রেক্ষিতে একদিকে যেমন করমুক্ত আয়সীমা পঞ্চাশ হাজার টাকা বাড়িয়ে মূল্যস্ফীতির এই কঠিন সময়ে মধ্যবিত্তকে কিছুটা স্বস্তি দেওয়ার প্রয়াস রয়েছে, তেমনি ট্যাক্স রিটার্ন সনদ গ্রহণের ক্ষেত্রে ন্যূনতম কর প্রদান বাধ্যতামূলক করার মাধ্যমে নিম্ন আয়ের মানুষের ওপর কর আরোপের বিষয়টিও কিন্তু দেখা গেছে। শেষোক্ত প্রস্তাবনার বিষয়টির ক্ষেত্রে টিনধারী ব্যক্তি যদি ৩৮টি সেবা নিতে চান, তাহলে তাঁর আয় করযোগ্য সীমার নিচে থাকলেও তাঁকে দুই হাজার টাকা কর পরিশোধ করে সনদ পেতে হবে—নির্বাচনের বছরে এ ধরনের ব্যবস্থা কতটা যৌক্তিক হলো, তা অনুমেয় নয়। এর পাশাপাশি এ ধরনের সিদ্ধান্ত সাধারণ মানুষকে সার্বিকভাবে টিন গ্রহণ ও কর প্রদানে অনুৎসাহী করতে পারে। প্রগতিশীল করব্যবস্থার সঙ্গেও এ ধরনের সিদ্ধান্ত সংগতিপূর্ণ নয়। তবে করমুক্ত আয়সীমা বাড়ানোর বিষয়টি কিছু নিশ্চিত রাজস্ব আহরণের পথ বন্ধ করে দিলেও মূল্যস্ফীতির চাপ বিবেচনায় এ সিদ্ধান্ত ইতিবাচক ও জনবান্ধব।

অপর দিকে রাজস্ব আদায়ের ক্ষেত্রে ন্যূনতম সারচার্জযোগ্য সম্পদসীমা তিন কোটি থেকে বাড়িয়ে চার কোটি করার বিষয়টি মূল্যস্ফীতির বিবেচনায় যদি করা হয়েও থাকে, তাহলেও প্রগতিশীল করব্যবস্থার সঙ্গে এটি অসংতিপূর্ণ। তবে এর পাশাপাশি জমি-ফ্ল্যাট নিবন্ধনের খরচ বাড়ানোর প্রস্তাবনাও রয়েছে, যার মাধ্যমে রাজস্ব আহরণের পাশাপাশি উচ্চবিত্তদের ওপর কিছুটা কর বাড়ানোর সুযোগ রয়েছে। মূসকের ক্ষেত্রে নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের ওপর নতুন করে করের বোঝা তেমন করে পড়েনি, সেটি যেমন সত্য, তেমনি মূল্যস্ফীতির ক্রমবর্ধমান চাপ থেকে স্বস্তি দিতে বড় ধরনের কোনো উদ্যোগও কিন্তু দেখা যাচ্ছে না।

ব্যয়ের দিক বিবেচনায় ভৌত অবকাঠামো বরাবরের মতোই প্রাধান্য পেয়েছে। যোগাযোগ ও পরিবহন খাতে বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচির সর্বোচ্চ ২৮ দশমিক ৯ শতাংশ এবং বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতে ১১ দশমিক ৪ শতাংশ বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে এ বাজেটে। তবে শিক্ষা খাতে ১১ দশমিক ৭ শতাংশ বরাদ্দ প্রয়োজনের তুলনায় যথেষ্ট না হলেও, এটি ইতিবাচক সিদ্ধান্ত। প্রস্তাবিত বাজেটে সামাজিক নিরাপত্তা খাতে সুবিধাভোগীর সংখ্যা ও মাথাপিছু বরাদ্দ (সামান্য) বাড়ানো হলেও বর্তমান মূল্যস্ফীতির বিবেচনায় এই বরাদ্দ অপ্রতুল। এ ছাড়া সুবিধাভোগীদের তালিকা তৈরির ক্ষেত্রে বহু বছর ধরেই পুরোনো হিসাব ব্যবহার করা (বেনিফিশিয়ারি ক্রাইটেরিয়ন), বিভিন্ন ধরনের ত্রুটি (ইনক্লুশন অ্যান্ড এক্সক্লুশন এরর) ইত্যাদির কারণে সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচি থেকে প্রত্যাশিত সুবিধা অনেকাংশেই আশানুরূপ নয়; তাই জাতীয় সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির দ্রুত বাস্তবায়ন ও বাজেটে সংশ্লিষ্ট বরাদ্দ নিশ্চিত করা জরুরি ছিল। তবে ব্যয়ের পরিপ্রেক্ষিতে বরাবরের মতো বিশাল আকারের পরিচলন ব্যয় (৪ হাজার ৮৪২ দশমিক ৩ বিলিয়ন টাকা) বাজেট ঘাটতিকে বাড়িয়ে তুলেছে।

মনে রাখা প্রয়োজন, প্রতিবছরের মতো চলতি বাজেটেও বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি বাস্তবায়নের শ্লথগতি (এপ্রিল ২০২৩ পর্যন্ত বাস্তবায়নের হার ছিল মাত্র ৫০ দশমিক ৩৩ শতাংশ) যদি বিদ্যমান থাকে, তাহলে প্রস্তাবিত বাজেট থেকে কাঙ্ক্ষিত সুবিধা পাওয়া কঠিন হবে। এর সঙ্গে সঙ্গে শিল্পায়ন, ব্যক্তি খাতে বিনিয়োগ ও কর্মসংস্থানের বিষয়গুলোয় চলতি বাজেটের প্রস্তাবনাগুলোরই ধারাবাহিকতা বজায় রাখা হয়েছে। নির্বাচনকে সামনে রেখে ব্যক্তি খাতে বড় ধরনের বিনিয়োগ কিংবা কর্মসংস্থানের সম্ভাবনা তাই কম।

এই বাজেটের একটি ইতিবাচক দিক হচ্ছে, কিছু কিছু স্থানীয় শিল্পকে সুরক্ষা দেওয়ার জন্য আমদানি শুল্কের ক্ষেত্রে সমন্বয়ের কিছু উদ্যোগ ও পূর্বের উদ্যোগের ধারাবাহিকতা, যা দেশীয় শিল্পের প্রসার ঘটাতে সহায়তা করবে। তবে মনে রাখতে হবে যে শিল্পায়নের যেকোনো উদ্যোগের ক্ষেত্রে প্রত্যাশিত বিনিয়োগের মাধ্যমে সুফল আসতে বেশ কিছুটা সময় লাগে। তাই এ ধরনের নীতির সরাসরি ফলাফল হয়তো আগামী অর্থবছরে না–ও পাওয়া যেতে পারে। প্রস্তাবিত বাজেটের আরেকটি ইতিবাচক দিক হচ্ছে, সর্বজনীন পেনশনব্যবস্থার বিষয়ে বিশদ বিবরণ। তবে এ ধরনের ব্যবস্থা কার্যকর করতে এক বছর হয়তো পর্যাপ্ত নয়, তাই পুরো প্রক্রিয়াটি কার্যকর হওয়ার জন্য আমাদের হয়তো আরও কিছুদিন অপেক্ষা করতে হবে।

তবে সামষ্টিক অর্থনীতির বিবেচনায় প্রস্তাবিত বাজেটে আগামী অর্থবছরের জন্য প্রবৃদ্ধি, মূল্যস্ফীতি, এমনকি ব্যক্তি খাতের বিনিয়োগের যেসব লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে, তা সার্বিক বাজেটের সঙ্গে সংগতিপূর্ণ নয়। যেমন মূল্যস্ফীতির ক্ষেত্রে যখন এপ্রিল ২০২৩–এ মূল্যস্ফীতি ৯ শতাংশের ওপর, তখন আগামী অর্থবছরের জন্য প্রাক্কলিত ৬ শতাংশ মূল্যস্ফীতি কীভাবে অর্জিত হবে, তা সুস্পষ্ট নয়। বিশেষ করে বাজেটে যে ধরনের করকাঠামোর প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে, তার সঙ্গে এই লক্ষ্য সংগতিপূর্ণ নয়।

ডলারের বিপরীতে টাকার মানের দরপতনের পরিপ্রেক্ষিতে আমদানি করা পণ্যের দামের প্রভাবে যে মূল্যস্ফীতি হচ্ছে, তা নিয়ন্ত্রণ করতে হলে আমদানি শুল্ক ও নিয়ন্ত্রক শুল্কে ব্যাপক ছাড় দিতে হতো, তবে তা আবার রাজস্ব আহরণের জন্য নেতিবাচক হতো। এ ছাড়া এই বাজেটে ব্যাংক খাত থেকে ১ লাখ ৩২ হাজার ৩৯৫ কোটি টাকার যে বিশাল আকারের ঋণ নেওয়ার পরিকল্পনা রয়েছে, তা মূল্যস্ফীতিকে আরও উসকে দিতে পারে। বিশেষত এই অর্থবছরের মতো বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর বিদ্যমান তারল্য বিবেচনা করে যদি কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে ঋণ নিতে হয়, তাহলে এর প্রভাব বাজারে পড়বে আগামী অর্থবছরেও। তবে মনে রাখা প্রয়োজন, মূল্যস্ফীতির লক্ষ্য অর্জনের জন্য রাজস্বনীতির পাশাপাশি মুদ্রানীতিরও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে।

এ প্রসঙ্গে আগামী জুলাই-ডিসেম্বরের মুদ্রানীতিতে কী ধরনের পদক্ষেপ নেওয়া হবে, সেটি এখন দেখার বিষয়। এর পাশাপাশি সামষ্টিক অর্থনীতির বিদ্যমান চ্যালেঞ্জ ও তা থেকে উত্তরণের জন্য বাজেট বা সংশ্লিষ্ট রাজস্বনীতিতে সুস্পষ্ট কোনো দিকনির্দেশনা নেই। মূল্যস্ফীতি ছাড়া আগামী অর্থবছরের জন্য ব্যক্তি খাতেও বিনিয়োগের লক্ষ্যমাত্রা (জিডিপির শতাংশ হিসেবে) ধরা হয়েছে ২৭ দশমিক ৪৩ শতাংশ, যা চলতি বছরে ছিল মাত্র ২১ দশমিক ৮৫ শতাংশ। অর্থনীতির সামগ্রিক প্রেক্ষাপটের বিবেচনায় ব্যক্তি খাতে বিনিয়োগে এ ধরনের উল্লম্ফনের যৌক্তিক ভিত্তি সম্পর্কে বাজেটে কোনো নির্দেশনা নেই। এ ছাড়া সরকার যদি ব্যাংকিং ব্যবস্থা থেকে ঋণ নেয়, তবে তা ব্যক্তি খাতে ঋণের প্রবাহ কমিয়ে দেবে। সে পরিস্থিতিতে ব্যক্তি খাতে বিনিয়োগ উল্টো বাধাগ্রস্ত হতে পারে। সর্বোপরি প্রবৃদ্ধির ৭ দশমিক ৫ শতাংশের প্রাক্কলিত লক্ষ্যমাত্রা অর্থনৈতিক সম্প্রসারণের নির্দেশক, যা আবার প্রাক্কলিত মূল্যস্ফীতির সঙ্গে সংগতিপূর্ণ নয়।

সামগ্রিক বিচারে প্রস্তাবিত বাজেটের কিছু উদ্যোগ ইতিবাচক হলেও দেশের সার্বিক আর্থসামাজিক প্রেক্ষাপটের বিচারে এ বাজেটকে ঘিরে যে প্রত্যাশা ছিল, তার অনেকটাই হয়তো ১ জুনের বাজেট প্রস্তাবে মেটেনি। আশা থাকবে, বাজেট পাসের আগে কিছু কিছু সিদ্ধান্তের পরিবর্তন ও পরিমার্জনা করা হবে এবং এর মাধ্যমে এ বাজেট অর্থনীতির বিদ্যমান চ্যালেঞ্জগুলো মোকাবিলায় সহায়ক ভূমিকা পালন করবে।

  • ড. সায়মা হক বিদিশা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগ অধ্যাপক