গদ্যকার্টুন

যে শহরে গ্যাসের গন্ধ ছড়িয়ে পড়েছিল

[এটি একটি সায়েন্স ফিকশন হতে পারত]

ধরুন, আপনি থাকেন আমেরিকার কোনো একটা ঘনবসতিপূর্ণ শহরে।

ধরুন, একদিন মধ্যরাতের পর আপনি নাকে একটা বিশেষ রকমের গন্ধ পেতে শুরু করলেন। নাকটা বাঁকা করে, চোখটা ছোট করে বারবার ছোট ছোট শ্বাস টানতে লাগলেন, একবার এদিকে আরেকবার ওদিকে নাক ঘোরানোর চেষ্টা করলেন এবং আপনি আবিষ্কার করলেন, এটা হলো চুলায় ব্যবহার্য গ্যাসের গন্ধ।

আপনার বাড়িতে গ্যাসের গন্ধ পাওয়া যাচ্ছে। আপনি আতঙ্কিত হলেন। তাড়াতাড়ি রান্নাঘরে গেলেন। চুলার সুইচ বন্ধ আছে কি না, পরীক্ষা করলেন। রান্নাঘরের জানালা-দরজা খুলে দিলেন। তারপর আপনার কাছে ফোন এল। আপনার বোন ফোন করে বলছে, তাদের পুরো পাড়ায় বাতাসে গ্যাস ছড়িয়ে পড়েছে। আপনি তাড়াতাড়ি রান্নাঘরের বাইরে গেলেন। বারান্দায় গিয়ে নাক দিয়ে জোরে জোরে, ধীরে ধীরে, লম্বা লম্বা, ছোট ছোট শ্বাস টানতে লাগলেন। বুঝলেন, আপনাদের পাড়াতেও গ্যাসের গন্ধ আকাশে-বাতাসে। আপনি তখন কী করবেন? কী ভাববেন?

আপনি ৯১১ নম্বরে ফোন করবেন। ৯১১ ওয়ালারা ফোন ধরেই বলবে, কীভাবে সাহায্য করতে পারি। আপনি বলতে শুরু করলেন, গ্যাসের গন্ধ পাওয়া যাচ্ছে। ওপাশ থেকে উত্তর এল, আপনার ফোনের জন্য ধন্যবাদ, আমরা এই রকম আরও ১০০টা ফোন কল পেয়েছি, আপনার শহরের অনেক জায়গাতেই গ্যাসের গন্ধ পাওয়া যাচ্ছে। আপনি আপনার নাম-ঠিকানা, ফোন নম্বর বলুন। আমরা অবশ্যই দেখছি কী করা যায়!

এবার আপনার আত্মাপাখি খাঁচাছাড়া হওয়ার উপক্রম। আপনার শহরে অনেক জায়গায় গ্যাসের গন্ধ পাওয়া যাচ্ছে! কী ঘটেছে আসলে? ভোপালের মতো গ্যাস দুর্ঘটনা? সারা শহরে কি গ্যাস ছড়িয়ে পড়েছে?

এখন কী করতে হবে?

এই সময় আপনি ফেসবুকে গেলেন। টেলিভিশন অন করলেন। টেলিভিশনের খবর কি কিছু বলছে?

জানতে পারলেন, মেয়র বলছেন, শহরের বেশ কিছু এলাকায় গ্যাসের গন্ধ পাওয়া যাচ্ছে। চিন্তা করবেন না। দীর্ঘ ছুটিতে শহরের লোকেরা বাইরে যাওয়ায়, শহরের কলকারখানা বন্ধ থাকায় গ্যাসের লাইনের ওপরে চাপ পড়েছে। তাই সামান্য গন্ধ পাওয়া যাচ্ছে!

আপনি আপনার বৃদ্ধ শ্বশুরকে সেই কথা বোঝাতে গেলেন। তিনি বলতে শুরু করলেন, কী বলছ! এসব কী বলছ! শহরে গ্যাসের ব্যবহার কমে যাওয়ায় গ্যাসের গন্ধ পাওয়া যাচ্ছে! তার মানে কী? গ্যাসের লাইনে চাপ বেড়ে গিয়ে গ্যাস লিক করেছে? সারা শহরে গ্যাস ছড়িয়ে পড়েছে? তাহলে উপায়? পুরো শহর বিস্ফোরিত হবে, আর আমরা সবাই পুড়ে যাব?
না বাবা। মেয়র আশ্বস্ত করেছেন। বলেছেন, আতঙ্কিত হবেন না। আমাদের লোকেরা দ্রুত ব্যবস্থা নিচ্ছে। কিছুক্ষণের মধ্যেই সব ঠিক হয়ে যাবে। শুধু এখন কেউ দেশলাইয়ের কাঠি বাক্সে ঘষবেন না, লাইটার জ্বালাবেন না, গ্যাসের চুলার নব ঘোরাবেন না। কেউ যদি আগুন না জ্বালে, তাহলে আর কিছু হবে না।

গাধা! আমি না হয় আগুন জ্বালালাম না, কেউই জ্বালাবে না, এটা আমি কীভাবে গ্যারান্টি দেব। যে এখন এই মধ্যরাতে ঘুমিয়ে আছে, ঘুমের মধ্যে কাত হয়ে সিগারেটের প্যাকেটটা হাতে নিয়ে সে যে লাইটারে টিপ দেবে না, এটা আমার পক্ষে নিশ্চিত করা কি সম্ভব?
আপনি কেন নিশ্চিত করবেন? এটা করবেন মেয়র।

মেয়র কীভাবে করবে? সে কি প্রত্যেকের মনের মধ্যে ঢুকে বলবে, আগুন জ্বালাবেন না।
মেয়ররা সবকিছু পারে।

সবকিছু পারে? কীভাবে পারে? তারা কি ভূত? তারা একই সঙ্গে সবার মনে ঢুকতে পারে?
দেখেন বাবা, মেয়র বলেছেন, কেউ যেন আতঙ্কিত না হন। কেউ যেন আতঙ্ক না ছড়ান। আপনি কিন্তু তাঁর কথা শুনছেন না। এটা আইন মান্যকারী নাগরিক হিসেবে আপনার অন্যায়। আপনাকে মেয়রের কথা শুনতে হবে।

কী আশ্চর্য কথা। কোনো একটা গাধা দেশলাইয়ের কাঠি ধরালেই পুরো শহর ব্লাস্ট করতে যাচ্ছে, আর আমাকে বলবে—আতঙ্কিত হবেন না, আর আমি সেটা শুনব। এই ধরনের কথা কেউ বলতে পারে?

অবশ্যই পারে। মেয়ররা সব পারে। আপনি মেয়র হলে আপনি কী করতেন?

আমি বলতাম, ভাইসব, আপনারা গাড়ি বের করুন। বাড়ি ছেড়ে পালান। শহর ছেড়ে পালান।

সেই জন্যই আপনি মেয়র হননি।

এদিকে ফেসবুকে কেউ কেউ লিখল, আসল ঘটনা তা নয়। শহরে পরপর বেশ কয়েকটা ভবনে গ্যাস-লিকজনিত অগ্নিকাণ্ড ও বিস্ফোরণ ঘটার পর গ্যাস কর্তৃপক্ষ বৈঠকে বসেছিল। তারা কারণ বের করল: আগে গ্যাসে গন্ধ মেশানো হতো। ফলে গ্যাস-লিক হলে নাগরিকেরা ধরে ফেলতে পারত যে লিক হয়েছে। মধ্যখানে বেশ কিছুদিন সিটির টাকা বাঁচাতে সেই গন্ধ আর মেশানো হয়নি। বিস্ফোরণ বন্ধ করতে হলে আবার গ্যাসে গন্ধ মেশাতে হবে। তারা গন্ধ মিশিয়েছে। ফলে নগরবাসী গ্যাসের গন্ধ পেতে শুরু করেছে।

আসলে লিক আগেও ছিল, এখনো আছে। আগে গ্যাসে গন্ধ ছিল না। এখন আছে। ফলে নগরবাসী আতঙ্কিত হয়েছে। আসলে আতঙ্কিত হওয়ার কিছু নেই। এ লিক থাকা সত্ত্বেও এত দিন কোথাও যখন আগুন লাগেনি, আজ রাতেও লাগবে না। ভয় পাবেন না। ঘুমুতে যান। বরং গ্যাস কর্তৃপক্ষ যেসব জায়গায় লিক আছে, তা সারাতে শুরু করেছে।

এরপর নগর কর্তৃপক্ষ তদন্ত কমিটি করল। সেই তদন্তে বেরিয়ে এল, আসলে সমস্যা গ্যাসে নয়, পানিতে। শহরের পানির ট্যাংকে একটা কেমিক্যাল মেশানো হয়েছিল, যা নাক পরিষ্কার করে। এতে নগরবাসী আর নাক ডাকবে না, আরাম করে শ্বাস নিতে পারবে। নাক হবে ক্লিয়ার।

এই পানি নাকে টানার পরই নগরবাসী গন্ধ পেতে শুরু করে। আসলে গন্ধ আগেও ছিল। শুধু নগরবাসীর নাসারন্ধ্র ক্রিয়াশীল ছিল না। এ সমস্যার সমাধান হচ্ছে: শহরের পানির রিজারভারে এমন কেমিক্যাল দিতে হবে যাতে নগরবাসীর নাক আবার বন্ধ হয়ে যায়। তারা গন্ধ না পায়।

তা-ই করা হলো। আর কেউ নাকে গন্ধ পায় না। নগরবাসী ভুলে গেল, তাদের শহরে দাহ্য গ্যাসের লাইনে কোনো লিক ছিল।

  • আনিসুল হক প্রথম আলোর ব্যবস্থাপনা সম্পাদক ও সাহিত্যিক