সম্প্রতি অন্তর্বর্তীকালীন সরকার নির্বাচন, পুলিশ প্রশাসন, বিচার বিভাগ, দুর্নীতি দমন কমিশন, জনপ্রশাসন ও সংবিধান সংস্কারে ছয়টি কমিশন গঠন করেছে। এসব কমিশন সরকারকে একটি রূপরেখা দেবে, সে অনুসারে সংস্কারের কাজ এগোবে। প্রশ্ন হচ্ছে, শিক্ষা নিয়েও একটি আলাদা কমিশন গঠন কেন নয়? জাতীয় শিক্ষা কমিশনের প্রয়োজনীয়তা নিয়ে লিখেছেন নাদিম মাহমুদ
দেশের সামগ্রিক টেকসই উন্নয়নের এসব খাতের সংস্কার যেমন জরুরি, তেমনি সে অনুযায়ী কর্মপন্থা প্রণয়নও প্রয়োজন। শিক্ষা কমিশন শুধু সময়ের দাবি নয়, সরকারের হাতে নেওয়া ছয়টি সংস্কারকে বাস্তবিক রূপ দিতে আধুনিক শিক্ষার নীতিমালা প্রণয়ন আবশ্যিক হয়ে উঠেছে। ‘শিক্ষা কমিশন’ ব্যতীত দেশের শিক্ষার সামগ্রিক মান যেমন উন্নতি করা সম্ভব হবে না, তেমনি সংস্কারে গড়া আধুনিক বাংলাদেশকে বিশ্বের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে হলে ‘শিক্ষা’–ব্যবস্থাকে ঢেলে সাজানো ছাড়া কোনো বিকল্প নেই।
আগের শিক্ষানীতিগুলো কেমন ছিল
স্বাধীনতার পূর্ব ও পরবর্তী সময়ে দেশে যেসব শিক্ষা কমিশন হয়েছিল, সেগুলোর উদ্দেশ্য ছিল মূলত শিক্ষাব্যবস্থার সংস্কার, আধুনিকায়ন এবং জাতীয় উন্নয়ন ও চাহিদার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ একটি কার্যকর শিক্ষাকাঠামো গঠন করা।
১৯৪৭ সালে ভারত ও পাকিস্তান সৃষ্টির পর মাওলানা আকরম খাঁ শিক্ষা কমিশন (১৯৪৯) এবং আতাউর রহমান খান শিক্ষা কমিশন (১৯৫৭) শিক্ষাকে একটি জাতীয় কাঠামোর মধ্যে নিয়ে আসতে চেয়েছিল, কিন্তু এ সময়ের শিক্ষাব্যবস্থা প্রচলিত ব্রিটিশ কাঠামোর ওপর নির্ভরশীল ছিল। আতাউর রহমান কমিশন অবৈতনিক প্রাথমিক শিক্ষা এবং প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোকে সরকারি নিয়ন্ত্রণে আনার সুপারিশ করেছিল, যা শিক্ষাকে আরও বেশি সাম্যবাদী করে তুলতে চেয়েছিল। কিন্তু পূর্ব বাংলার জন্য শিক্ষার বরাদ্দ অপ্রতুলতায় কমিশনের সুপারিশ বাস্তবায়নে বড় বাধা হয়ে দাঁড়ায়।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে মুক্তিযুদ্ধের পর স্বাধীন দেশে প্রথম ১৯৭২ সালে যে শিক্ষা কমিশন গঠিত হয়েছিল, তার কারিগর ছিলেন খ্যাতনামা শিক্ষাবিদ ও বিজ্ঞানী কুদরাত-এ-খুদা, যাকে খুদার শিক্ষা কমিশন বলা হতো। এই শিক্ষানীতিতে মূলত মুক্তিযুদ্ধের চেতনা এবং আর্থসামাজিক পরিবর্তনের লক্ষ্যে শিক্ষাকে গুরুত্বপূর্ণ একটি হাতিয়ার হিসেবে মনে করা হতো। কমিশন প্রাথমিক শিক্ষা আট বছর এবং মাধ্যমিক শিক্ষা চার বছর করার সুপারিশ করে, পাশাপাশি বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে চার বছরের ডিগ্রি ও এক বছরের মাস্টার্স কোর্সের প্রস্তাব দেয়। এ ছাড়া মূল্যায়নের জন্য গ্রেডিং পদ্ধতি ও কারিকুলাম উন্নয়নেও গুরুত্ব আরোপ করে। খুদার এই শিক্ষানীতির পূর্ণ বাস্তবায়ন না হলেও এটি ছিল একটি আধুনিক ও একমুখী শিক্ষাব্যবস্থা প্রবর্তনের সোপান।
১৯৭৭ সালে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারে শরীফ শিক্ষা কমিশনে বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থা সংস্কার করা এবং শিক্ষার মানোন্নয়নের সুপারিশ করা হয়, যেখানে প্রাথমিক শিক্ষাকে বাধ্যতামূলক, অবৈতনিকসহ মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষায় বেশ কিছু সুপারিশ করা হয়েছিল। পরে এরশাদের সময়ে ১৯৮৮ সালের ফেব্রুয়ারিতে মফিজ উদ্দিন শিক্ষা কমিশনে প্রাক্-প্রাথমিক (৩-৫) বছরের শিশুদের শিক্ষার কথা প্রথম আলোচনা করা হয়, একই সঙ্গে ধর্মীয় শিক্ষার গুরুত্ব তুলে ধরা হয়।
১৯৯৬ সালে শেখ হাসিনা ক্ষমতায় আসার পর পরবর্তী বছর ১৯৯৭ সালে বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থায় গুণগত পরিবর্তন আনার উদ্দেশ্যে শামসুল হক শিক্ষা কমিশন গঠিত হয়। কুদরাত-এ-খুদা শিক্ষা কমিশনের সুপারিশ যথাযথভাবে বাস্তবায়িত না হওয়ায় বর্তমান পরিস্থিতির সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে শিক্ষাব্যবস্থার উন্নয়ন প্রয়োজন হয়। সেই প্রেক্ষাপটে, সরকার অধ্যাপক শামসুল হককে প্রধান করে ৫৬ সদস্যবিশিষ্ট একটি নতুন শিক্ষা কমিশন গঠন করে শিক্ষাকে দেশের জাতীয় চাহিদার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ, প্রগতিশীল, বিজ্ঞানমনস্ক, জ্ঞানের সমসাময়িক উন্নয়নের সঙ্গে শিক্ষাব্যবস্থার সমন্বয় ঘটানোর জন্য এই শিক্ষানীতি প্রণয়ন করে।
আমরা এমন একটি স্থায়ী শিক্ষানীতি/কমিশন দেখতে চাই, যেখানে সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে প্রবেশ করা দুর্নীতি, ক্ষমতার অপব্যবহার, ধর্মীয় ও সামাজিক অসহিষ্ণুতা কমানোর জন্য শিক্ষার্থীদের মধ্যে নৈতিক মূল্যবোধ, মানবিকতা ও সামাজিক দায়বদ্ধতা সৃষ্টির জন্য শিক্ষাকাঠামোর চর্চা থাকবে, যার মধ্য দিয়ে শিক্ষার্থীদের সৃজনশীলতা ও উদ্ভাবনী চিন্তার বিকাশ ঘটবে, দক্ষ মানবসম্পদ গড়ে উঠবে।
২০০১ সালে খালেদা জিয়া ক্ষমতায় আসার পর ২০০২ সালে ড. এম এ বারীকে প্রধান করে একটি বিশেষজ্ঞ কমিটি গঠন করা হয়েছিল, যার মূল উদ্দেশ্য ছিল বাংলাদেশের শিক্ষা খাতে গঠনমূলক পরিবর্তন আনা এবং শিক্ষাব্যবস্থার দ্রুত বাস্তবায়নযোগ্য সুপারিশ প্রদান করা। এই কমিটি শিক্ষা খাতের বিভিন্ন সমস্যা চিহ্নিত করে তা সমাধানের জন্য বেশ কিছু প্রস্তাব প্রদান করে, যা ২০০৩ সালে বাস্তবায়ন শুরু হয়েছিল। সে বছর মোহাম্মদ মনিরুজ্জামান মিঞা শিক্ষা কমিশন নামে একটি কমিশন গঠন করে। এক বছর পর তাদের দেওয়া প্রতিবেদনে শিক্ষার সব সাব-সেক্টরকে তিনটি ভাগে ভাগ করে। এ ছাড়া পাঁচ বছর বয়সীদের স্কুলে বাধ্যতামূলক ভর্তি, শিক্ষার মানোন্নয়নে প্রযুক্তি, টিভি চ্যানেল ও দূরশিক্ষণপদ্ধতি ব্যবহার, বিশ্ববিদ্যালয় ব্যতীত বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে স্বতন্ত্র কমিশনের মাধ্যমে শিক্ষক নিয়োগসহ ৮৮০টি সুপারিশ প্রদান করা হয়েছিল।
সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ২০০৯ সালে দায়িত্ব গ্রহণের চার মাসের মাথায় জাতীয় অধ্যাপক কবীর চৌধুরীকে চেয়ারম্যান করে ‘জাতীয় শিক্ষানীতি প্রণয়ন’–এর জন্য ১৮ সদস্যের একটি কমিটি গঠন করেছিল, যারা পরবর্তী সময়ে ‘জাতীয় শিক্ষানীতি-২০১০’ প্রণয়ন করে। মূলত আগের শিক্ষানীতিগুলোর কাছ থেকে ধার নিয়ে করা এই শিক্ষানীতির আলোকেই শিক্ষাক্রম ও শিক্ষাব্যবস্থা চালু ছিল। তবে জাতীয় শিক্ষাক্রম ২০২১–এর অধীন দেশের শিক্ষাক্রম শেখ হাসিনা সরকার বাস্তবায়নে হাত দিলে শুরু থেকে তা নিয়ে প্রশ্ন ওঠে। অপরিপক্ব এবং বাস্তবতার সঙ্গে সামঞ্জস্যহীন এই শিক্ষাক্রম নিয়ে সমাজের বিভিন্ন স্তরের মানুষ প্রতিবাদ জানালেও তা কর্ণপাত করা হয়নি। অন্তর্বর্তীকালীন সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর সেই শিক্ষাক্রম সংস্কারের কথা জানিয়েছে।
সরকার পরিবর্তিত হলে কেন শিক্ষা কমিশন
অতীতের এসব শিক্ষা কমিশনের সময়কাল ও কমিশনের সুপারিশ দেখলে অনেকটাই অনুমেয় যে যখন যে সরকার আমাদের দেশে ক্ষমতায় এসেছে, তখনই তারা শিক্ষাব্যবস্থার পরিবর্তনে হাত দিয়েছে। পাঠ্যপুস্তক পরিবর্তন থেকে শুরু করে শিক্ষার্থীদের জন্য রাজনৈতিক দলীয় অনুগত শক্তিরই ইতিহাস যেমন জানিয়েছে, তেমনি শিক্ষাব্যবস্থাকে কুক্ষিগত করার প্রয়াস পরিলক্ষিত হয়েছে। কিন্তু প্রশ্ন হলো, আমাদের কেন এত শিক্ষা কমিশন প্রয়োজন? কেন সরকার পরিবর্তিত হলেই শিক্ষারও পরিবর্তন হতে হয়?
দেশে টেকসই শিক্ষাকাঠামোর অভাব স্বাধীনতার পরবর্তী সময় থেকে পরিলক্ষিত হয়েছে। এরপরও কোনো সরকারই আমাদের শিক্ষার্থীদের জন্য আধুনিক, অসাম্প্রদায়িক, অন্তর্ভুক্তিমূলক ও আর্থসামাজিক পরিকাঠামোর শিক্ষাক্রম চালু করতে পারেনি। ফলে রাতবিরেতে পরিবর্তিত হয়েছে পাঠ্যসূচি, পরীক্ষার ধরন। কখনোবা সৃজনশীল, কখনো পিএসসি, জেএসসি চালু বা বন্ধ করে শিক্ষার বারোটা বেজে গেছে। সরকারকে সুবিধা দেওয়া এসব শিক্ষা কমিশন অদ্যাবধি যুগান্তকারী হয়ে ওঠেনি। কুদরাত-এ-খুদা কমিশনের অনেকাংশ আধুনিক হলেও তা সময়ের মারপ্যাঁচে আটকা পড়েছে বারবার। অন্যান্য শিক্ষা কমিশনেও নানা যৌক্তিক সুপারিশ করা হলেও সেসব গুরুত্বহীন থেকে গেছে। ফলে সরকার পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে ‘শিক্ষা’ পরিবর্তনের এ সংস্কৃতি দেশের শিক্ষাব্যবস্থাকে তলানিতে নিয়ে যাওয়ার জন্য অন্যতম কারণ হিসেবে আমি দেখি।
নতুন শিক্ষা কমিশনের প্রয়োজনীয়তা
আগেই বলেছি, স্বাধীনতার পরবর্তী এই সময়ে আমরা কার্যকর শিক্ষাব্যবস্থার রূপকল্প তৈরি করতে পারিনি। আমাদের শিক্ষাকাঠামোয় ক্ষমতাসীনদের একধরনের স্বেচ্ছাচারিতা দেখা গেছে, যার কারণে শিক্ষার মান উন্নয়ন করা সম্ভবপর হয়নি। সাধারণ শিক্ষা, বাইরের কারিকুলামের ইংরেজি মাধ্যমে শিক্ষা, মাদ্রাসাভিত্তিক শিক্ষা, কারিগরি ও বৃত্তিমূলক শিক্ষাসহ নানা শ্রেণিতে বিভক্ত শিক্ষাব্যবস্থা আমাদের চিন্তাচেতনাকে এক কাতারে আনতে যেমন পারছে না, তেমনি দেশে দক্ষ মানবসম্পদ গড়তেও সক্ষম হচ্ছে না। প্রাথমিক, মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক এবং উচ্চশিক্ষার পরিকাঠামোগত উন্নয়ন করা না গেলে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার এই যুগে চতুর্থ শিল্পবিপ্লবকে সামাল দেওয়া কেবল দুরূহ নয়, আমাদের মতো দেশগুলোর জন্য বড় ধরনের হুমকি বটে।
১৯৮৮ সালের ফেব্রুয়ারিতে মফিজ উদ্দিন শিক্ষা কমিশনে সমকালীন বাস্তবতা অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, দেশে রাজনৈতিক দলগুলো কর্তৃক ছাত্রসংগঠনগুলোকে অঙ্গ হিসেবে স্বীকৃতি এবং নির্বাচনকে কেন্দ্র করে শিক্ষকদের দলীয় মনোভাব শিক্ষার পরিবেশকে ভয়াবহ করে তুলেছে। আর এ কারণে এ কমিশনের প্রধান সুপারিশটিই ছিল, রাজনৈতিক কারণে উদ্ভূত সমস্যাগুলো রাজনৈতিকভাবে সমাধান হওয়া উচিত। রাজনৈতিক সমস্যা কেবল রাজনীতিবিদেরা করতে পারেন আর এ জন্য প্রয়োজন রাজনৈতিক নেতাদের সদিচ্ছা, সংকল্প ও দৃঢ়তা।
মফিজ শিক্ষা কমিশনের সেই সুপারিশ বাস্তবে রূপ দেখেনি। ফলে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে দলীয় রাজনৈতিক দুর্বৃত্তপরায়ণতা প্রকটভাবে প্রকাশ পেয়েছে। শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের সরাসরি দলীয় রাজনীতিতে জড়িয়ে যাওয়ার খেসারতস্বরূপ অসুস্থ বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চা আমরা দেখেছি। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে অস্ত্রের ঝনঝনানিতে প্রাণসংহার যেমন হয়েছে, তেমনি প্রভাব খাটিয়ে শিক্ষক নিয়োগ, পদোন্নতি, ফলাফল পরিবর্তনের মতো অনৈতিক চর্চাগুলো অনেকটাই সংস্কৃতিতে রূপ নিয়েছে।
সাংবিধানিকভাবে রাষ্ট্রের প্রত্যেক নাগরিকের জন্য রাজনৈতিক মতকে প্রাধান্য দেওয়ার বুলিতে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে শিক্ষা ও গবেষণার পরিবর্তে ক্ষমতাসীন, বিরোধী শিবিরে রাজনৈতিক চর্চা আমাদের শিক্ষাব্যবস্থাকে পিছিয়ে নিয়ে গেছে। আমরা এসব নোংরামি বন্ধের জন্য শক্তিশালী শিক্ষানীতি চাই, যেখানে কোনো রাজনৈতিক দল ছাত্রসংগঠন চালানোর সাহস বা সুযোগ না পায়।
যা যা করতে হবে
আগামী ৫০ বছরের লক্ষ্যমাত্রা সামনে রেখে আমাদের একটি টেকসই শিক্ষাকাঠামোর পরিপত্র তৈরি করা প্রয়োজন। স্থায়ী শিক্ষা কমিশন গঠন করতে হবে, যেখানে রাজনৈতিক দলগুলো থেকে শুরু করে সমাজের বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষের অংশগ্রহণ থাকবে। এমন একটি শিক্ষাক্রম থাকবে, যা কেউই পরিবর্তনের সাহস করবে না। শুধু পরিবর্তনশীল বিজ্ঞান ও আর্থসামাজিক সংযুক্তিগুলোর আবর্তন করা যাবে। এর বাইরে মৌলিক ও নৈতিক শিক্ষার রূপরেখা অভিন্ন থাকবে। বিশ্বের বিভিন্ন দেশ তাদের শিক্ষাকে এমনভাবে সাজিয়ে রাখে, যাতে করে তারা পরিবর্তনশীল এই পৃথিবীর সঙ্গে তাল মেলাতে পারে। বিশ্বের সঙ্গে তাল মিলিয়ে প্রাথমিক ও নিম্নমাধ্যমিক মিলে আট বছরের বাধ্যতামূলক শিক্ষা যেমন করা যেতে পারে, তেমনি নবম থেকে দ্বাদশ শ্রেণি পর্যন্ত মাধ্যমিক শিক্ষাকাঠামো করা সময়ের দাবি। চার বছরের স্নাতক ও দুই বছরের স্নাতকোত্তরের সুপারিশ আসবে নতুন কমিশন থেকে।
ভবিষ্যতের শিক্ষা কমিশনের রূপরেখা এমন হতে পারে, যা সমসাময়িক সময়ের চাহিদা, প্রযুক্তিগত অগ্রগতি এবং সামাজিক উন্নয়নের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে দেশের শিক্ষাব্যবস্থাকে কার্যকর ও অন্তর্ভুক্তিমূলক করতে সক্ষম হবে। ভবিষ্যৎ শিক্ষা কমিশনকে শিক্ষার ক্ষেত্রে সামাজিক, অর্থনৈতিক ও লিঙ্গভিত্তিক বৈষম্য কমানোর জন্য বিশেষ উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে। ধনী ও গরিবের বাচ্চাদের শিক্ষাব্যবস্থার বৈষম্য আমাদের একটি বৈষম্যময় সমাজ উপহার দিয়ে আসছে। এ জন্য শিক্ষার মানোন্নয়নের জন্য গুণগত শিক্ষক নিয়োগ এবং তাঁদের যুগোপযোগী বেতনকাঠামোর আওতায় সমাজের সব স্তরের মানুষের জন্য একই মানের শিক্ষার সুযোগ নিশ্চিত করা। উচ্চবিত্ত ও নিম্নবিত্ত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের মধ্যে যে বৈষম্য রয়েছে, তা যেমন কমাতে হবে, তেমনি শিক্ষাব্যবস্থায় প্রযুক্তির ব্যবহার, বিশেষ করে ডিজিটাল শিক্ষা প্ল্যাটফর্ম তৈরি এবং অনলাইন শিক্ষার সহজলভ্যতা বাড়ানোর দিকে নজর রাখতে হবে।
এ ছাড়া বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে গবেষণার সুযোগ বাড়ানো, শিক্ষক-শিক্ষার্থী অনুপাত কমানো এবং শিক্ষকদের প্রশিক্ষণ উন্নত করার ওপর জোর দিতে হবে। উচ্চশিক্ষায় গবেষণার জন্য আরও বেশি বেশি বরাদ্দ নিশ্চিত করা না গেলে চতুর্থ শিল্পবিপ্লবে শক্তিশালী মানবসম্পদ গড়া সম্ভব হবে না। কর্মমুখী শিক্ষা এবং কারিগরি দক্ষতা অর্জনের ওপর জোর দিতে হবে, যাতে শিক্ষার্থীরা শুধু একাডেমিক শিক্ষার ওপর নির্ভর না করে কর্মজীবনে প্রবেশের জন্য প্রস্তুত থাকে। আর এ জন্য শিল্পপ্রতিষ্ঠান ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের মধ্যে সমন্বয় তৈরি করা প্রয়োজন।
আমরা এমন একটি স্থায়ী শিক্ষানীতি/কমিশন দেখতে চাই, যেখানে সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে প্রবেশ করা দুর্নীতি, ক্ষমতার অপব্যবহার, ধর্মীয় ও সামাজিক অসহিষ্ণুতা কমানোর জন্য শিক্ষার্থীদের মধ্যে নৈতিক মূল্যবোধ, মানবিকতা ও সামাজিক দায়বদ্ধতা সৃষ্টির জন্য শিক্ষাকাঠামোর চর্চা থাকবে, যার মধ্য দিয়ে শিক্ষার্থীদের সৃজনশীলতা ও উদ্ভাবনী চিন্তার বিকাশ ঘটবে, দক্ষ মানবসম্পদ গড়ে উঠবে।
ড. নাদিম মাহমুদ গবেষক, ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়। ই–মেইল: nadim.ru@gmail.com