২৩ অক্টোবর বাংলাদেশ ছাত্রলীগকে নিষিদ্ধ ও সন্ত্রাসী সংগঠন ঘোষণা দিয়ে প্রজ্ঞাপন জারি করেছে অন্তর্বর্তী সরকারের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। ছাত্রলীগ এ দেশে পুরোনো ছাত্রসংগঠনগুলোর একটি। প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল ১৯৪৮ সালের ৪ জানুয়ারি।
ছাত্রলীগের স্লোগান হচ্ছে ‘শিক্ষা, শান্তি ও প্রগতি’। এ স্লোগানকে সংগঠনটি কি আদৌ মর্যাদা দিতে পেরেছে? ১৫ বছরের অধিক সময় ধরে একনাগাড়ে সরকারে থাকা বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের একটি লাঠিয়াল বাহিনীতে পরিণত হয়েছিল সংগঠনটি।
শিক্ষার সঙ্গে না ছিল কোনো সম্পর্ক, না ছিল শান্তি কিংবা প্রগতির সঙ্গে। যদি থাকতই, তাহলে বুয়েটের হলে আবরার ফাহাদের মতো জলজ্যান্ত প্রাণকে কীভাবে পিটিয়ে মেরে ফেলা সম্ভব হয়েছে? এর সঙ্গে শিক্ষা, শান্তি কিংবা প্রগতির কি কোনো সম্পর্ক ছিল?
বিশ্বজিৎ দাসকে শিবির সন্দেহ মেরে ফেলা হয়েছিল প্রকাশ্য দিবালোকে। এসব কি কখনো শান্তির নমুনা হতে পারে? অথচ এই স্লোগানকে সঙ্গী করে সংগঠনটি পরিচালিত হচ্ছিল! স্লোগানের সঙ্গে বাস্তব কাজের কোনো মিল ছিল না।
ছাত্রলীগের খারাপ কাজের যারাই প্রতিবাদ করেছে, তাদের অনেককে উল্টো ছাত্রলীগের রোষানলে পড়তে হয়েছে। ছাত্রলীগ ছিল একটা আতঙ্কের নাম। কোথায় একটা ছাত্রসংগঠন ছাত্রদের অধিকার নিয়ে কথা বলবে, সেখানে সাধারণ ছাত্ররা এই সংগঠনকে এতই ঘৃণা করত যে ২৩ অক্টোবর সংগঠনটিকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করার পর অনেকেই নিজেদের সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে লিখেছে ‘ঈদ মোবারক’।
এমন নয়, অন্য দল কিংবা রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের লোকজনই শুধু এমন লিখেছে। একদম সাধারণ শিক্ষার্থী, যাদের হয়তো কোনো রাজনৈতিক পরিচয় নেই, তারাও একধরনের ‘ঈদ আনন্দ’ পাচ্ছে বলে মনে হলো। কেন ও কীভাবে সংগঠনটি সাধারণ শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে দূরে সরে গেল?
এই বাংলাদেশে ফ্যাসিবাদ যেন আর কোনো দিনও ফিরে আসতে না পারে, এ জন্য যে জায়গায় সবচেয়ে বেশি কাজ করতে হবে, সেটা হচ্ছে অপকর্মকে সব সময় অপকর্ম হিসেবেই দেখতে হবে। কোনো ব্যক্তি কিংবা আদর্শকে পুঁজি করে এই বাংলাদেশে যেন কেউ আর অন্যায়ের পক্ষে সাফাই গাইতে না পারে।
এর উত্তর কিন্তু খুব সোজা। ছাত্রলীগের বিরুদ্ধে নির্যাতন, চাঁদাবাজি, সহিংসতা ও হত্যার অভিযোগ রয়েছে। এ ছাড়া জুলাই-আগস্টের গণ–আন্দোলন ও অভ্যুত্থানের সময় ছাত্রলীগের নৃশংস ভূমিকা কমবেশি সবারই জানা। এমনকি নারী শিক্ষার্থীদের গায়ে হাত তুলতেও দ্বিধা করেনি তারা।
এ জন্যই হয়তো এখন অনেকে, বিশেষ করে বিশ্ববিদ্যালয়পড়ুয়া বর্তমান শিক্ষার্থীরা, যারা সরাসরি এই ছাত্রলীগের দ্বারা নির্যাতনের শিকার হয়ে আসছিল, তারা আনন্দিত হচ্ছে। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, এরপর কী?
ছাত্রলীগকে সন্ত্রাসী সংগঠন হিসেবে নিষিদ্ধ তো করা হয়েছে। এরপর কি তারা আর নিজেদের কার্যক্রম চালাবে না? সে প্রশ্ন নাহয় বিশ্লেষকেরা ভেবে দেখবেন। অতীতের সরকারগুলো অনেক সংগঠনকে নিষিদ্ধ করার চেষ্টা করেছে কিংবা দাবিয়ে রাখার চেষ্টা করেছে। কিন্তু সফল হয়নি। কেন হয়নি?
এর একটা অন্যতম কারণ হচ্ছে, যেসব কারণে নিষিদ্ধ করা হয়, অনেক সময় দেখা যায় শাসকগোষ্ঠীর ওপরই সেই বিষয়গুলোর ভূত চেপে বসে! তারা নিজেরাই এসব করে বেড়ায়! মানুষের মনে কিন্তু এখন প্রশ্ন ঘুরেছে–ফিরছে—হত্যা, চাঁদাবাজি, সহিংসতার জন্য ছাত্রলীগকে তো নিষিদ্ধ করা হয়েছে; কিন্তু দেশ থেকে কি এসব বিলীন হয়ে যাবে?
অভ্যুত্থানের পরপর ‘মব কিলিং’ হয়েছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আবাসিক হলে হত্যাকাণ্ডের মতো ঘটনাও ঘটেছে। নানান জায়গায় সহিংসতা হয়েছে। সেই সঙ্গে চাঁদাবাজিও কিন্তু বন্ধ হয়নি। এসব বন্ধ করতে হবে। যে কারণে ছাত্রলীগকে নিষিদ্ধ করা হয়েছে, সেগুলোর কারণ যেন শাসকগোষ্ঠী নিজেরাই আবার হয়ে না পড়ে! তাহলে এখন যে ‘ঈদ আনন্দ’ দেখা যাচ্ছে, তা দ্রুতই বিলীন হয়ে ধূসর বেদনায় রূপান্তরিত হতে পারে।
শেখ মুজিবুর রহমান ও মুক্তিযুদ্ধকে ব্যবহার করে বাংলাদেশ ছাত্রলীগ যে অপকর্ম করে বেড়িয়েছে, সেই অপকর্মের ফল তাদের একদিন না একদিন ভোগ করতেই হতো।
তবে এসব এখন অতীত। আর অতীত থেকে শিক্ষা নেওয়ার অনেক কিছুই আছে। এই বাংলাদেশে ফ্যাসিবাদ যেন আর কোনো দিনও ফিরে আসতে না পারে, এ জন্য যে জায়গায় সবচেয়ে বেশি কাজ করতে হবে, সেটা হচ্ছে অপকর্মকে সব সময় অপকর্ম হিসেবেই দেখতে হবে। কোনো ব্যক্তি কিংবা আদর্শকে পুঁজি করে এই বাংলাদেশে যেন কেউ আর অন্যায়ের পক্ষে সাফাই গাইতে না পারে।
আমিনুল ইসলাম জ্যেষ্ঠ প্রভাষক, এস্তোনিয়ান এন্ট্রাপ্রেনিউরশিপ ইউনিভার্সিটি
tutul_ruk@yahoo.com