২৮ নভেম্বর, ইসরায়েলি সৈন্যরা অধিকৃত পশ্চিম তীরের জাবা চেকপয়েন্টে আমার গাড়ি থামিয়ে আমাকে অপহরণ করে। আমি ২৫৩ দিন বন্দী অবস্থায় কাটিয়েছি কোনো অভিযোগ ছাড়াই। আমি একটা পরীক্ষা দিয়ে বাড়ি ফিরছিলাম। স্ত্রীকে ফোন করে জানালাম যে খাবার নিয়ে আসছি। ফোনে তখন আমার ছেলের কান্নার শব্দ শুনতে পাচ্ছিলাম। তার কান্না আমার মাথায় ছিল পরের আট মাস।
চেকপয়েন্টে ইসরায়েলি সৈন্যরা আমাকে গাড়ি থেকে বের করে হাতকড়া পরিয়ে ও চোখ বেঁধে একটি সামরিক ক্যাম্পের ভেতরে পাঁচ ঘণ্টা হাঁটু গেড়ে বসিয়ে রাখে। হেবরনের অবৈধ ইহুদি বসতিতে এক আটক কেন্দ্রে পাকাপাকি স্থানান্তর করা না পর্যন্ত আমাকে ক্যাম্প থেকে ক্যাম্পে স্থানান্তর করা হয়েছিল।
বারবার বলা সত্ত্বেও আইনজীবী বা পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগের অনুমতি দেওয়া হয়নি। দুই মাস আটক থাকার পর অবশেষে একজন আইনজীবীর সঙ্গে কথা বলতে পেরেছিলাম। উকিলের কাছে জানতে পেরেছিলাম যে আমার বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগ নেই। আমি প্রশাসনিক বন্দী! ইসরায়েলি দখলদার বাহিনী এই নতুন আইন ব্যবহার করে ফিলিস্তিনিদের ইচ্ছেমতো আটকে রাখতে পারে। ৭ অক্টোবর ২০১৩ থেকে এই আইনে এখন পর্যন্ত তিন হাজার তিন শর বেশি ফিলিস্তিনিকে বিচার বা অভিযোগ ছাড়াই ইসরায়েলি কারাগারে বন্দী রাখা হয়েছে।
আট মাসের বেশি সময় ধরে আমি ইসরায়েলি বাহিনীর হাতে ক্ষুধার্ত আর অপমানিত হয়ে মার খেয়েছি। একটি ছোট কংক্রিটের সেলে আরও ১১ বন্দীর সঙ্গে রাখা হয়েছিল আমাকে। এতটা ছোট সেই সেল যে মনে হচ্ছিল, আমাদের গণকবরে রাখা হয়েছে। পৃথিবীতে নরক ভোগ করেছি আমরা।
রক্ষীরা ভারী প্রতিরক্ষামূলক গিয়ার নিয়ে ঘুরে বেড়াত। নিয়মিত লাঠি দিয়ে হাত ও পায়ে মারত আমাদের। আতঙ্কিত করার জন্য বড় পুলিশ কুকুরগুলোকে ছেড়ে দিত আমাদের ওপর। ধাতব লাঠি দিয়ে সেলের গায়ে ক্রমাগত আঘাত করত, যেন একমুহূর্ত আমরা শান্তিতে থাকতে না পারি। প্রতিদিন মৌখিক অপমান, আমাদের মা, স্ত্রী ও কন্যাদের নিয়ে যাচ্ছেতাই বলা, এসব তো ছিল প্রতিমুহূর্তের ব্যাপার। ফিলিস্তিনি নেতাদের, আমাদের পতাকা নিয়ে কুৎসিত কথা চলত অবিরাম।
শৌচাগার ব্যবহারের সময় ছাড়া আমাদের কোনো গোপনীয়তা ছিল না। প্রথম ছয় মাস দেওয়া হয়নি শেভ করার অনুমতি। যে খাবার দেওয়া হতো, তা দিয়ে প্রাপ্তবয়স্ক মানুষের বেঁচে থাকা কঠিন। আটক থাকার সময় আমি ২০ কেজির বেশি ওজন হারিয়েছি। প্রতিনিয়ত আসতে থাকা নতুন বন্দীরাই ছিল বাইরের দুনিয়ার খবরের একমাত্র উৎস।
আমি নিজেকেই দেখে চিনতে পারতাম না। ভাবতাম, যদি বের যেতে পারি কোনো দিন, তাহলে আমার ছেলেকে চিনতে পারব তো? আমি শুধু চোখ বুজে কল্পনা করতাম, আমার ছেলে বড় হচ্ছে। ভাবার চেষ্টা করতাম, সে দেখতে কেমন হচ্ছে। আমার অসুস্থ বৃদ্ধ বাবার জন্য চিন্তা হতো। বাবা বেঁচে আছেন তো? অসুস্থতা বেড়ে গেলে কে বাবাকে হাসপাতালে নিয়ে যায়?
ইসরায়েলি কারাগারে কাটানোর সময়ে একটা ব্যাপার আমার কাছে স্পষ্ট হয়ে গেছে। ইসরায়েলিরা আমাদের বন্দী করে অত্যাচার করে মনোবল ভেঙে গুঁড়িয়ে দেওয়ার চেষ্টা করে। আর তা করতে চায় এমনভাবে, যেন মুক্তি পাওয়ার পর অপমান–অত্যাচারে আমরা ভুলে যাই যে আমরা কারা। আমরা ভেঙে পড়লে তা হবে ফিলিস্তিনি জনগণের কাছে ইসরায়েলিদের বার্তা।
কিন্তু ইসরায়েলিদের এই অশুভ কৌশল প্রতিরোধের মুখোমুখি হচ্ছে। আমাদের আটকে রাখা সেলের কংক্রিট আমাদের কোষে কোষে এসে ঠাঁই নিয়েছে। আমরা তাদের চেষ্টা দেখে হাসি। ইসরায়েলি রক্ষীদের বর্বরতার বিরুদ্ধে হাসি আমাদের অস্ত্র। আশা আমাদের ঢাল।
একদিন আমাকে ছেড়ে দেওয়া হলো। আমি আমার স্ত্রীকে ফোন করলাম। ভিডিও কল। ফোনের ক্যামেরা ঘোরানো হলো আমার ছেলের দিকে। এত দিন পর আর আমি নিজেকে সামলে রাখতে পারলাম না। আমার চোখের জল পড়তে লাগল। আমি বারবার শুধু একটা কথাই বলতে লাগলাম, ‘আমি তোমার বাবা, আমি তোমার বাবা।’
ইসরায়েল আমাকে ভেঙে ফেলতে চেয়েছে। আমার আত্মাকে ধ্বংস করার চেষ্টা করেছে; কিন্তু আমি এই কঠিন সময় পার হয়ে আরও কঠিন, আরও শক্তিশালী হয়ে উঠেছি। আমার কারাবাসের ক্ষত মিলিয়ে যাবে না। আমি তাঁকে মিলিয়ে যেতে দেব না।
আটক হওয়ার আগে আমি পাঁচ বছর এইডা যুবকেন্দ্রের নির্বাহী পরিচালক হিসেবে কাজ করেছি। ছাড়া পেয়ে এখন আমি কেন্দ্রে ফিরে এসেছি। একজন পিতা হিসেবে, একজন ফিলিস্তিনি হিসেবে আমি জানি, আমাকে কাজ করতে হবে ফিলিস্তিনি শিশুদের জন্য, যুবকদের জন্য। তাদের উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ গড়ে তোলার জন্য আমি এখন আরও বেশি দৃঢ়প্রতিজ্ঞ।
মো. আনাস আবু সরর আইডা যুবকেন্দ্রের নির্বাহী পরিচালক
আল–জাজিরা থেকে নেওয়া, ইংরেজি থেকে অনুবাদ জাভেদ হুসেন