পুতিনের নতুন রুশ সাম্রাজ্য গড়ে তোলার স্বপ্ন সফল হবে কি?
পুতিনের নতুন রুশ সাম্রাজ্য গড়ে তোলার স্বপ্ন সফল হবে কি?

মতামত

২০২৪ সাল কি নতুন ১৯৩৩ হতে যাচ্ছে

১৯৩৩ সালের ৩০ জানুয়ারি। ওই দিন অ্যাডলফ হিটলার জার্মানির চ্যান্সেলর হন। হিটলারের সমর্থকদের কাছে এটি ছিল ‘জাতীয় বিপ্লব’ এবং ‘পুনর্জন্মের’ দিন।

হিটলারের সমর্থকদের বিশ্বাস ছিল, জার্মানির ১৪ বছরের উদার গণতান্ত্রিক ভাইমার (ভাইমার জার্মানির একটি শহর। শহরটি জার্মানির মানবতাবাদী আন্দোলনের সূতিকাগার। জার্মানিতে ১৯১৯ থেকে ১৯৩৩ সালের মধ্যবর্তী সময়ের মানবতাবাদী আদর্শভিত্তিক সরকারব্যবস্থাকে ‘ভাইমার রিপাবলিক’ বলা হয়ে থাকে) ‘সিস্টেমের’ পর সেখানে হিটলারের মতো একজন কর্তৃত্ববাদী শক্তিশালী ব্যক্তির দরকার ছিল।

হিটলার যেদিন চ্যান্সেলর হন, সেই রাতে বাদামি শার্টি পরা হিটলারের অনুগামীরা একটি নতুন যুগের সূচনা করার জন্য মধ্য বার্লিনের বুক চিরে শোভাযাত্রা বের করেছিলেন।

এটি জনতুষ্টিবাদী প্রতারণার ইতিহাসের একটি জয়ের মুহূর্ত ছিল। ভাইমার প্রজাতন্ত্রের প্রথম দিন থেকেই ভাইমার বিরোধিতাকারীরা ভাইমারপন্থীদের রাজনীতিকে মিথ্যা তথ্যের ভিত্তিতে আক্রমণ করে আসছিলেন। তাঁরা প্রচার করছিলেন, ভাইমার গণতন্ত্র হলো ইহুদি ও সমাজতন্ত্রীদের একটি গুপ্ত সংগঠনের মিশন। ভাইমারবিরোধীরা প্রথম থেকেই বলে আসছিলেন, ভাইমাররা প্রথম বিশ্বযুদ্ধে জার্মানির পরাজয় নিশ্চিত করতে ‘জার্মানির পিঠে ছুরি মেরেছিল’।

আজ বিশ্বে খুব কম লোকই পাওয়া যাবে, যাঁরা এ কথা অস্বীকার করবেন যে হিটলারের আবির্ভাব বিশ্বের ইতিহাসের মোড় ঘুরিয়ে দিয়েছিল এবং দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ ও হলোকাস্টের রাজনৈতিক প্রক্রিয়ার শুরুটা তাঁর হাত ধরেই হয়েছিল। অবশ্য নাৎসিদের দাবি ছিল , হিটলার ‘ক্ষমতা দখল করেননি’ বরং (হিটলারের জীবনীকার ইয়ান কারশের ব্যাখ্যামতে) তিনি প্রভাবশালী লোকদের একটি ছোট গ্রুপের দ্বারা উদ্দীপ্ত হয়ে ক্ষমতার কেন্দ্রে এসেছিলেন।

এই গ্রুপের মধ্যে ফ্রাঞ্জ ফন পাপেন নামের একজন ছিলেন, যিনি ১৯৩২ সালে জার্মানির চ্যান্সেলর হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছিলেন। তিনি ভেবেছিলেন, ১৯৩২ সালের রাইখস্ট্যাগ নির্বাচনের পর সবচেয়ে বড় শক্তি হলো হিটলার এবং নাৎসি পার্টি। তিনি মনে করেছিলেন, এই দুই শক্তিকে একটি রক্ষণশীল অ্যাজেন্ডা এগিয়ে নিতে ব্যবহার করা যেতে পারে।

২০২৪ সালের সম্ভাব্য ঘটনাগুলো এতটাই অন্ধকারাচ্ছন্ন যে অনেকেই সেসব নিয়ে চিন্তাও করতে চান না। ১৯৩৩ সালে উদারপন্থীরা যেভাবে শুভ ইচ্ছা বা উইশ ফুল থিঙ্কিং ব্যক্ত করে বলতেন, হিটলার অচিরেই পড়ে যাবেন, ঠিক সেভাবেই কেবল উইশ ফুল থিঙ্কিং আমাদের বিচারবোধকে আচ্ছন্ন করে রাখছে।

একইভাবে জার্মানির প্রেসিডেন্ট সাবেক ফিল্ড মার্শাল পল ভন হিন্ডেনবার্গ রাজতন্ত্র পুনরুদ্ধার করতে হিটলারকে ব্যবহার করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু হিটলারের নির্মম নেতৃত্ব, নাৎসি সহিংসতা এবং সরকারযন্ত্রে হুড়োহুড়ি করে জার্মান জনসাধারণের যোগদানের কারণে এই রক্ষণশীলদের পরিকল্পনা ভেস্তে যায়।

জার্মানদের মধ্যে জাতীয় জাগরণের চেতনা জেগে ওঠে।

হিটলারের বিরোধিতা করা উদারপন্থী সোশ্যাল ডেমোক্র্যাটরা হয় সহিংসতার শিকার হয়েছিলেন, নয়তো নিজেদের গুটিয়ে নিয়েছিলেন। পরিস্থিতি যত খারাপ হচ্ছিল, তত তাঁরা নিজেদের এই বলে আশ্বস্ত করছিলেন যে হিটলারের শাসন শেষ পর্যন্ত ভেঙে পড়বে। নাৎসিদের অন্তঃকলহ অবশ্যই নতুন সরকারের অবসান ঘটাবে।

উদারপন্থী এবং সমাজতন্ত্রীদের বাইরে জার্মান সমাজের একটি বৃহত্তর অংশ অনুমান করেছিল, হিন্ডেনবার্গ (যিনি দলমত-নির্বিশেষে সব জার্মান নাগরিকের প্রেসিডেন্ট হবেন বলে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন) হিটলারের রাশ টেনে ধরবেন। অন্যরা আশা করেছিলেন, অন্তত সেনাবাহিনী তাঁকে লাগামছাড়া হতে দেবে না।

কিন্তু ভাইমার রিপাবলিকের শেষ বছরগুলোতে হিটলার সবাইকে একেবারে বোকা বানিয়ে দিলেন। ইতিহাসবিদ পিটার ফ্রিটশে দেখিয়েছেন, হিটলার চ্যান্সেলর হওয়ার ১০০ দিনের মধ্যেই ক্ষমতা পাকাপোক্তকরণের জন্য নাৎসিদের নৃশংস অভিপ্রায় স্পষ্ট হয়ে ওঠে।

১৯৩৩ সালের গ্রীষ্মের শেষ নাগাদ জার্মান সমাজ হিটলারের রাজনৈতিক লাইনে চলে এল। স্বাধীন রাজনৈতিক দল, ট্রেড ইউনিয়ন অথবা সাংস্কৃতিক সংগঠন বলে তখন আর কিছুই অবশিষ্ট থাকল না।

শুধু খ্রিষ্টান গির্জাগুলোই তখন কিছুটা স্বাধীনতা ভোগ করতে পারছিল। এক বছর পর, ১৯৩৪ সালের দৃশ্যে হিটলার নিজ দলের প্রতিদ্বন্দ্বীদের হত্যা করার আদেশ দেন এবং ২ আগস্ট হিন্ডেনবার্গের মৃত্যুর পর তিনি নিজেকে জার্মান ফুয়েরার হিসেবে ঘোষণা করেন। এর মধ্য দিয়ে হিটলারের একনায়কত্ব সম্পন্ন হয়।

তত দিনে হিটলারের প্রথম কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্পগুলো চালু হয়ে গিয়েছিল এবং জার্মান অর্থনীতিকে যুদ্ধের পথে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল।

ইতিহাসের এই সময় আজও খুব প্রাসঙ্গিক রয়ে গেছে।

এ বছর যুক্তরাষ্ট্রে কয়েক কোটি মানুষ ভোট দিতে যাচ্ছেন; যদিও সেই ভোটে অনেকে গণতন্ত্রের হুমকিতে পড়ার অশনিসংকেত দেখা যাচ্ছে। অনেক বিশ্লেষক বেশ উচ্চকিতভাবে বলছেন, এই নির্বাচনের মধ্য দিয়ে ১৯৩৩ সাল ২০২৪ সালেই ফিরে আসবে।

এবার ঠিক এক বছর পরের সময়টা কল্পনা করুন, যখন সমগ্র বিশ্বে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা তার সংখ্যাগরিষ্ঠতা হারাবে।

কল্পনা করুন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ইউক্রেনের ওপর থেকে যুক্তরাষ্ট্রের সমর্থন প্রত্যাহার করে নিয়েছেন। সমগ্র পূর্ব ইউরোপে একটি নতুন রুশ সাম্রাজ্য গড়ে তোলার যে স্বপ্ন ভ্লাদিমির পুতিন লালন করছেন, তাতে ন্যাটো আর কোনো প্রতিবন্ধকতা হিসেবে কাজ করছে না। পুতিনের আগ্রাসী অভিযান ঠেকিয়ে দিতে ইউরোপের ঐক্যবদ্ধ প্রতিক্রিয়ার পথে ইউরোপীয় পার্লামেন্টের কট্টর দক্ষিণপন্থী দলগুলো বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে। পোল্যান্ড, এস্তোনিয়া, লিথুয়ানিয়া ও লাটভিয়া নিজের মতো করে অগ্রসর হচ্ছে। গাজা যুদ্ধ আঞ্চলিক সংঘাতে পরিণত হয়েছে এবং পুতিন তাঁর দূরপাল্লার ক্ষেপণাস্ত্রের আরেক দফা পরীক্ষা চালিয়েছেন।

এই মহা বিশৃঙ্খলার মধ্যে চীন তাইওয়ান দখলের সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলল।

২০২৪ সালের সম্ভাব্য ঘটনাগুলো এতটাই অন্ধকারাচ্ছন্ন যে অনেকেই সেসব নিয়ে চিন্তাও করতে চান না। ১৯৩৩ সালে উদারপন্থীরা যেভাবে শুভ ইচ্ছা বা উইশ ফুল থিঙ্কিং ব্যক্ত করে বলতেন, হিটলার অচিরেই পড়ে যাবেন, ঠিক সেভাবেই কেবল উইশ ফুল থিঙ্কিং আমাদের বিচারবোধকে আচ্ছন্ন করে রাখছে।

স্বত্ব: প্রজেক্ট সিন্ডিকেট, ইংরেজি থেকে সংক্ষিপ্ত আকারে অনূদিত

  • মার্ক জোনস ইউনিভার্সিটি কলেজ ডাবলিনের ইতিহাসের সহকারী অধ্যাপক