ডয়চে ভেলের বিশ্লেষণ

বাংলাদেশ কি চীন–রাশিয়ার দিকে ঝুঁকছে

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সম্প্রতি বলেছেন, ‘২০ ঘণ্টা প্লেনে জার্নি করে আটলান্টিক পার হয়ে মানুষ আমেরিকা না গেলে কিচ্ছু আসে-যায় না। পৃথিবীতে আরও অনেক মহাসাগর আছে, অনেক মহাদেশ আছে; সেই মহাদেশে আমরা যাতায়াত করব আর বন্ধুত্ব করব।’

শেখ হাসিনা আরও বলেছেন, ‘যাঁরা আমাদের ভিসা দেবে না, আমরা তাঁদের ওপর নির্ভরশীল থাকব না।’ স্পষ্টতই শেখ হাসিনার এমন মন্তব্য যুক্তরাষ্ট্রের উদ্দেশে।

কারণ, ওয়াশিংটন সম্প্রতি বাংলাদেশের জন্য নতুন ভিসা নীতি ঘোষণা করেছে। এতে বলা হয়েছে, বাংলাদেশের যাঁরা গণতান্ত্রিক নির্বাচনের পথে অন্তরায় হবেন, তাঁদের ভিসা দেবে না যুক্তরাষ্ট্র। বাংলাদেশে ২০২৪ সালের জানুয়ারিতে অনুষ্ঠিত হতে যাওয়া পরবর্তী সাধারণ নির্বাচন সামনে রেখে এই ঘোষণা করেছে জো বাইডেন প্রশাসন।

সর্বশেষ ২০১৮ সালে বাংলাদেশে সাধারণ নির্বাচন হয়েছে। এর আগের নির্বাচন হয়েছে ২০১৪ সালে। এ দুটি নির্বাচনে ব্যাপক কারচুপি, বিরোধী রাজনৈতিক কর্মীদের ভয়ভীতি দেখানোর অভিযোগ রয়েছে। শেখ হাসিনার সরকার অবশ্য বরাবরই এসব অভিযোগ অস্বীকার করে এসেছে।

যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে দূরত্ব বাড়াতে পারবে?

বাংলাদেশে উৎপাদিত পণ্যের সবচেয়ে বড় আমদানিকারক দেশ যুক্তরাষ্ট্র। মার্কিন পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের হিসাবে, শুধু ২০২১ সালে বাংলাদেশ থেকে যুক্তরাষ্ট্র ৮৩০ কোটি ডলার মূল্যমানের পণ্য আমদানি করেছে। শুধু তা–ই নয়, মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ বাংলাদেশে সবচেয়ে বড় বিদেশি বিনিয়োগকারীদের মধ্যে মার্কিন কোম্পানিগুলো রয়েছে।

এ পরিস্থিতিতে রাজনৈতিক বিশ্লেষকেরা মনে করছেন, যুক্তরাষ্ট্র নিয়ে শেখ হাসিনার মন্তব্যে স্পষ্ট ‘প্রতিবাদী অবস্থান’ প্রকাশ পেয়েছে।

শেখ হাসিনার এমন মন্তব্যকে ‘বিভ্রান্তিকর’ বলেছেন মাইকেল কুগেলম্যান। তিনি ওয়াশিংটনভিত্তিক উড্রো উইলসন ইন্টারন্যাশনাল সেন্টার ফর স্কলার্সের পরিচালক। কুগেলম্যান ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘বাংলাদেশের রাজনৈতিক অভিজাতদের অনেকের পরিবারের সদস্যরা যুক্তরাষ্ট্রে বসবাস করেন। শেখ হাসিনার পরিবারের সদস্যও দেশটিতে রয়েছেন। এ পরিস্থিতিতে মার্কিন মুলুকে উড়াল দেওয়ার ক্ষমতা না থাকা বড় ব্যাপার নয়—এমন পরামর্শ দেওয়া বিভ্রান্তিকর হবে।’

জার্মানির বার্লিনের হামবোল্ডট ইউনিভার্সিটির অতিথি প্রভাষক ও দক্ষিণ এশিয়াবিষয়ক বিশ্লেষক জেসমিন লর্চ একই মত দিয়েছেন। তিনি ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘বাংলাদেশে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের সদস্যদের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের দৃঢ় সম্পর্ক রয়েছে।’

জেসমিন লর্চ আরও বলেন, ‘শেখ হাসিনা একের পর এক যুক্তরাষ্ট্রবিরোধী বক্তব্য দিচ্ছেন। কিন্তু একই সময়ে তাঁর দল আওয়ামী লীগের অনেক উচ্চপদস্থ নেতা ও দলটির প্রতি সহানুভূতিশীল ব্যক্তিরা ছুটি কাটাতে যুক্তরাষ্ট্র ভ্রমণ করছেন। তাঁদের সন্তানেরা যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়–কলেজে পড়াশোনা করছেন।

ব্রিকসে যোগদানে ‘উপকার’ হবে

আগামী আগস্টে ব্রিকসে যোগ দেওয়ার পরিকল্পনা রয়েছে বাংলাদেশের। পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আব্দুল মোমেন গত বুধবার এক সংবাদ সম্মেলনে এ সিদ্ধান্তের কথা জানিয়েছেন। জেনেভায় দক্ষিণ আফ্রিকার প্রেসিডেন্ট সিরিল রামাফোসার সঙ্গে বৈঠক করেন শেখ হাসিনা। এই বৈঠকের পর ব্রিকসে যোগদানের বিষয়ে নিজেদের অবস্থানের কথা জানান পররাষ্ট্রমন্ত্রী।

বিশ্বের দ্রুতবর্ধনশীল অর্থনীতির দেশগুলোর জোট ব্রিকস। ব্রাজিল, রাশিয়া, ভারত, চীন ও দক্ষিণ আফ্রিকা এ জোটের সদস্য। প্রতিষ্ঠার সময় থেকে দ্রুত অর্থনৈতিক বিকাশের আশার কথা শুনিয়েছিল এ জোট। তবে এখন ব্রিকসের সদস্যরা পশ্চিমা–নিয়ন্ত্রিত বৈশ্বিক আর্থিক প্রতিষ্ঠানের বাইরে একটি পৃথক কূটনৈতিক ফোরাম ও উন্নয়ন অর্থায়ন নিয়ে ভাবছে।

বাংলাদেশ এমন একসময়ে এসে ব্রিকসে যোগদানের পরিকল্পনার কথা জানাল, যখন দেশটি কয়লা এবং অন্যান্য জ্বালানি পণ্য আমদানির খরচ মেটাতে মার্কিন ডলারের চরম ঘাটতির মধ্যে রয়েছে।

দেখার বিষয়, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বর্তমান সরকার ক্রমবর্ধমান পশ্চিমা চাপ কীভাবে অগ্রাহ্য করতে পারে, সামাল দিতে পারে। যদিও রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের অনেকে মনে করছেন, গণতান্ত্রিক ধারা অব্যাহত রাখতে বর্তমানে বাংলাদেশে একটি অবাধ, সুষ্ঠু এবং অন্তর্ভুক্তি ও অংশগ্রহণমূলক সাধারণ নির্বাচন আয়োজন করা প্রয়োজন।

মাইকেল কুগেলম্যান বলেন, ‘ব্রিকসে যোগদানের পরের পরিস্থিতি কার্যকরভাবে সামাল দেওয়া গেলে এ উদ্যোগের ফলে বাংলাদেশ উপকৃত হতে পারে।’

এই বিশ্লেষক আরও বলেন, ‘যদি ঢাকা সঠিকভাবে কার্ড খেলতে পারে, তবে পশ্চিমের দেশগুলোর সঙ্গে বাণিজ্য ও কূটনৈতিক সম্পর্ক বৃদ্ধি অব্যাহত রেখেও ব্রিকসে অংশগ্রহণের মাধ্যমে বাংলাদেশ নিজের লাভ তুলে আনতে পারবে।’

কুগেলম্যানের মতে, পশ্চিমকে অবজ্ঞা করার কৌশল হিসেবে ব্রিকসে যোগ দিলে ভুল করবে বাংলাদেশ। কিন্তু এটা বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতির স্বার্থ অর্জন এগিয়ে নেওয়ার পথে সহায়তা করতে পারে।

বাংলাদেশের সার্বভৌমত্ব রক্ষায় চীনা অঙ্গীকার

বাংলাদেশের সার্বভৌমত্ব, স্বাধীনতা ও ভৌগোলিক অখণ্ডতা রক্ষায় পাশে থাকার ঘোষণা দিয়েছে বেইজিং। মূলত এর পরই বাংলাদেশের পক্ষ থেকে ব্রিকসে যোগ দেওয়ার সিদ্ধান্তের বিষয়টি জানানো হয়েছে।

গত বুধবার চীনের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র ওয়াং ওয়েনবিন বলেন, ‘সব ধরনের আধিপত্যবাদ এবং ক্ষমতার রাজনীতির বিরোধিতা করতে বাংলাদেশ ও অন্যান্য দেশের সঙ্গে একযোগে কাজ করতে প্রস্তুত রয়েছে চীন।’

এ বিষয়ে জেসমিন লর্চ বলেন, কয়েক বছর ধরেই বাংলাদেশ সরকার যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের (ইইউ) কাছ থেকে ক্রমশ নিজেকে সরিয়ে আনছে। এর বিপরীতে চীন ও রাশিয়ার কাছাকাছি আসছে।

জেসমিন লর্চ আরও বলেন, ‘বাংলাদেশের সঙ্গে চীন ও রাশিয়া অর্থনৈতিক সহযোগিতার সম্পর্ক জোরদার করেছে। এ জন্য দেশ দুটি বাংলাদেশের বর্তমান সরকারের ক্রম কর্তৃত্ববাদী শাসনের সমালোচনা করা থেকে বিরত রয়েছে। এই পরিস্থিতিতে যুক্তরাষ্ট্র ও ইইউ শর্তযুক্ত অর্থনৈতিক সহযোগিতা দিলেও বাংলাদেশের অবকাঠামো খাতে বিনিয়োগে চীন মানবাধিকার, সুশাসন ও গণতন্ত্র নিয়ে কোনো শর্ত আরোপ করছে না।’

এ পরিস্থিতি দেশ দুটি আওয়ামী লীগকে ‘তথাকথিত পশ্চিমা দাতাদের’ ওপর থেকে নির্ভরতা উল্লেখযোগ্য পরিমাণে কমানোর ব্যাপারে ভূমিকা রাখতে উৎসাহ জোগাচ্ছে বলে মনে করছেন বিশ্লেষক জেসমিন লর্চ। তিনি বলেন, ‘তবে কর্তৃত্ববাদী দেশগুলোর প্রতি ক্রমবর্ধমান নির্ভরতা বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক ভবিষ্যতের ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে।’

এখন দেখার বিষয়, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বর্তমান সরকার ক্রমবর্ধমান পশ্চিমা চাপ কীভাবে অগ্রাহ্য করতে পারে, সামাল দিতে পারে। যদিও রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের অনেকে মনে করছেন, গণতান্ত্রিক ধারা অব্যাহত রাখতে বর্তমানে বাংলাদেশে একটি অবাধ, সুষ্ঠু এবং অন্তর্ভুক্তি ও অংশগ্রহণমূলক সাধারণ নির্বাচন আয়োজন করা প্রয়োজন।

ইংরেজি থেকে অনুবাদ

  • আরাফাতুল ইসলাম ডয়চে ভেলের সাংবাদিক