পাঠ্যক্রমে পরিবর্তনে শিক্ষা কতটা আধুনিক ও শিল্পবান্ধব হবে

গতানুগতিক পরীক্ষা ও মুখস্থনির্ভর পড়াশোনার পরিবর্তে পারদর্শিতার ওপর গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে নতুন কারিকুলামে
ছবি: প্রথম আলো

প্রচলিত বিদ্যায়তনে যে শিক্ষা দেওয়া হয় তা কতটা বাস্তবভিত্তিক তা নিয়ে দীর্ঘদিনের বিতর্ক আছে। এই বিতর্ক থেকে শিক্ষাকে মুক্তি দিতে শিক্ষাকে মুক্তিযুদ্ধের চেতনাভিত্তিক অসাম্প্রদায়িক; শিল্প ও আধুনিক তথ্য ও প্রযুক্তিবান্ধব, কর্মোপযোগী এবং সর্বোপরি বিনোদনমূলক করার লক্ষ্যে নতুন শিক্ষা কারিকুলাম প্রণয়ন করেছে সরকার যা ২০২৩ সাল থেকে পর্যায়ক্রমে কার্যকর হবে। নতুন কারিকুলামে তৃতীয় শ্রেণি পর্যন্ত কোনো পরীক্ষা থাকবে না। থাকবে না পিইসি-জেএসসি-জেডিসি পরীক্ষাও। নতুন কারিকুলামে প্রাক্-প্রাথমিক থেকে তৃতীয় শ্রেণি পর্যন্ত শ্রেণিকক্ষে শিখনকালীন মূল্যায়ন করা হবে।

চতুর্থ থেকে অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত বাংলা, ইংরেজি, গণিত, সমাজ ও বিজ্ঞান বিষয়ে শ্রেণিকক্ষে মূল্যায়ন করা হবে ৬০ ভাগ। আর বছর শেষে সামষ্টিক মূল্যায়ন বা পরীক্ষা হবে ৪০ ভাগ। ডিজিটাল প্রযুক্তি, স্বাস্থ্য সুরক্ষা, ধর্ম ও শিল্পসংস্কৃতি বিষয়গুলোতেও হবে শ্রেণিকক্ষে ধারাবাহিক মূল্যায়ন। নম্বর বণ্টনে এই হার কিছুটা পরিবর্তন হবে নবম ও দশম শ্রেণিতে। এ ক্ষেত্রে বাংলা, ইংরেজি, বিজ্ঞান, সামাজিক বিজ্ঞান ও গণিতে শিখনকালীন মূল্যায়ন ৫০ ভাগ আর সামষ্টিক বা পরীক্ষার মাধ্যমে মূল্যায়ন হবে ৫০ ভাগ। থাকবে না বিজ্ঞান, মানবিক বা ব্যবসায় শিক্ষার মতো কোনো বিভাগ বিভাজন। আরও একটু পরিবর্তন এসেছে একাদশ ও দ্বাদশ শ্রেণিতে। আবশ্যিক বিষয়গুলোয় শ্রেণিকক্ষে শিখনফলের মাধ্যমে মূল্যায়ন করা হবে ৩০ ভাগ আর চূড়ান্ত পরীক্ষার মাধ্যমে সামষ্টিক মূল্যায়ন করা হবে ৭০ ভাগ। ৭০ ভাগের ওপরই ছাত্রছাত্রীদের পাবলিক পরীক্ষা দিতে হবে। ঐচ্ছিক বিষয়গুলোর সব কটিতেই শ্রেণিকক্ষে শিখনফলের মাধ্যমে মূল্যায়ন করা হবে। প্রতিটি বর্ষের শেষে আলাদা চূড়ান্ত পরীক্ষা নেওয়া হবে। দুই বর্ষের উপরিউক্ত সব কটি পরীক্ষার নম্বর একত্রে করে দেওয়া হবে এইচএসসি ও সমমানের পরীক্ষার ফল।

জাতীয় দিবসগুলোয় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলা রাখার নিয়ম রেখে সপ্তাহে দুই দিন ছুটির ব্যবস্থা রেখা হয়েছে। সে হিসাবে মোট ১৮৫ দিন কর্মদিবস। বাস্তবায়নের লক্ষ্যে ষষ্ঠ শ্রেণিতে দেশের ৬২টি স্কুল, কারিগরি ও মাদ্রাসায় পাইলটিং কার্যক্রম এখন চলছে। এই পাইলটিং থেকে ফিডব্যাক নিয়ে চূড়ান্ত ও সঠিক কারিকুলাম প্রণয়ন করা হবে, যা ২০২৩ সাল থেকে কার্যকর হবে। সে লক্ষ্যে প্রাথমিক পর্যায়ে ২০২৩ সাল থেকে প্রথম, দ্বিতীয়, ষষ্ঠ ও সপ্তম শ্রেণিতে, ২০২৪ সালে তৃতীয়, চতুর্থ, অষ্টম ও নবম শ্রেণিতে, ২০২৫ সালে পঞ্চম ও দশম শ্রেণিতে এবং ২০২৬ ও ২০২৭ সালে উচ্চমাধ্যমিকের একাদশ ও দ্বাদশ শ্রেণিতে বাস্তবায়ন করা হবে। ধর্মীয় শিক্ষা সব সময় ছিল, এখনো আছে, ভবিষ্যতেও থাকবে। কোনোকালেই ধর্মীয় শিক্ষা বাদ দেওয়া হয়নি। সর্বোপরি, গতানুগতিক পরীক্ষা ও মুখস্থনির্ভর পড়াশোনার পরিবর্তে পারদর্শিতার ওপর গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে নতুন কারিকুলামে। শিক্ষার্থীরা সমাজ ও শিক্ষকদের প্রশ্ন করার মাধ্যমে নিজেরা হাতেকলমে শিখবে। পাশাপাশি তারা প্রযুক্তি ব্যবহারে দক্ষ ও যোগ্য হবে, মানবিকবোধসম্পন্ন শিক্ষার্থী হয়ে উঠবে এবং জাতীয় লক্ষ্য অর্জন করে শান্তিপূর্ণ সুখী-সমৃদ্ধ দেশ গড়তে উদ্বুদ্ধ হবে।

প্রায় দেড় বছর (৫৭১ দিন) পর শ্রেণিকক্ষে ফিরেছে শিক্ষার্থীরা। করোনাকালে শিক্ষাব্যবস্থাকে সচল রাখার জন্য পরিস্থিতির বিবেচনায় শিক্ষা মন্ত্রণালয় নানা উদ্যোগ নিয়েছিল—অনলাইন, অফলাইন, সপ্তাহে এক দিন-দুই দিন ক্লাস, অ্যাসাইনমেন্ট, সংক্ষিপ্ত সিলেবাসে পরীক্ষা, অটো পাস ইত্যাদি। কিন্তু সবকিছু স্বাভাবিক হওয়ার পর ক্লাস-পরীক্ষা যখন পূর্ণোদ্যমে শুরু হলো, তখনই আবার করোনার নতুন আক্রমণ (চতুর্থ ঢেউ) দেখা দিল। এল বন্যা, পিছিয়ে গেল এসএসসি পরীক্ষা।

দেশে আরও আছে খরা, শীত, গ্রীষ্ম, বর্ষা, ঈদ ও পূজার ছুটি। এ সবকিছুর জন্য প্রথম ধাক্কাটা আসে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে। সম্প্রতি বন্যায় অনেক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ভেসে গেছে, বইপুস্তক নষ্ট হয়েছে। পুরো সিলেটবাসী ভোগান্তির মধ্যে পড়েছে। এখন এসব প্রতিষ্ঠান নতুন করে তৈরি করতে হবে, শিক্ষার্থীদের হাতেও পৌঁছে দিতে হবে নতুন বই। তাই করোনাসহ এতগুলো প্রাকৃতিক দুর্যোগের পর নবপ্রণীত কারিকুলাম নিয়ে আর সময় নষ্ট না করি। যদিও নতুন কারিকুলাম প্রকাশের পর থেকেই শিক্ষক, শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের মধ্যে চলছে নানা আলোচনা-সমালোচনা।

দেশ স্বাধীন হওয়ার পর ১৯৭২ সালে প্রথম কুদরাত-এ-খুদা কমিশন প্রণীত হয়েছিল। সর্বশেষ জাতীয় শিক্ষানীতি ২০১০ সালের আগে ৬টি কমিশন কাজ করেছিল। সব কটি কমিশনই নানা আলোচনা ও সমালোচনার মুখে পড়েছিল। বর্তমান কারিকুলাম নিয়েও আলোচনা-সমালোচনা হবে, এটাই স্বাভাবিক। শিক্ষা কারিকুলাম একটি চলমান প্রক্রিয়া এবং সময়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে পরিবর্তন-পরিমার্জন হবে ভবিষ্যতেও।

তবে একটি আধুনিক ও যুগোপযোগী শিক্ষা কারিকুলাম প্রণয়ন করতে সরকার অত্যন্ত আন্তরিক, তা একেবারে নিশ্চিন্তে বলা যায়। কারণ, শিক্ষায় এই সরকারের অনেক অবদান লক্ষণীয়। ১ জানুয়ারি একযোগে বই বিতরণ, শতভাগ শিক্ষার্থীকে উপবৃত্তি প্রদান, সাক্ষরতার হার ৭৫ দশমিক ৬-এ উন্নীত, বিশেষ করে নারীশিক্ষায় ও সক্ষমতায় অসামান্য অগ্রগতি ইত্যাদি। সম্প্রতি সরকার ২ হাজার ৭১৬টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এমপিওভুক্ত করে, ২০১৩ সালেও এই সরকার ২৬ হাজার ১৯৩টি বিদ্যালয় জাতীয়করণ করে।

যুগোপযোগী কারিকুলাম এবং ছাত্র-শিক্ষক-অভিভাবকের সৌহার্দ্যপূর্ণ সম্পর্ক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। শিক্ষক শিক্ষার্থীদের শাসন করবেন, আদেশ-উপদেশ দেবেন, এটাই স্বাভাবিক। প্রযুক্তির অপব্যবহারে আজকাল অনেক শিক্ষার্থী কিশোর গ্যাংয়ের ছত্রচ্ছায়ায় নানা অপরাধমূলক কাজে লিপ্ত হয়ে পড়ছে।

১৯৭৩ সালে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ৬ হাজার ১৬০টি বেসরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় জাতীয়করণ করেছিলেন। প্রযুক্তিভিত্তিক শিক্ষালাভের জন্য বর্তমান সরকার পর্যায়ক্রমে প্রতিটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে স্থাপন করে চলেছে একের পর এক দৃষ্টিনন্দন একাডেমিক ভবন, মাল্টিমিডিয়া ক্লাসরুম, শেখ রাসেল ডিজিটাল ল্যাবরেটরি ইত্যাদি। শিক্ষা উন্নয়নের এই ধারাবাহিকতায় প্রণীত হয়েছে চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের উপযোগী বিশ্বমানের এই শিক্ষা কারিকুলাম, যেখানে ছিলেন দেশের প্রথিতযশা শিক্ষাবিদেরা, সময়ও লেগেছে বেশ। পরীক্ষাধীন এই কারিকুলামেও ভুলত্রুটি, ভালো-মন্দ থাকতে পারে। জেএসসি ও জেডিসি পরীক্ষা বাদ দেওয়ার ফলে প্রাইভেট ও কোচিংয়ের প্রবণতা কমে আসবে।

আবার একাদশ ও দ্বাদশ শ্রেণিতে আলাদা আলাদা পরীক্ষা রাখায় বিষয়গুলো অল্প সময়ে আয়ত্তে আনতে কষ্ট হবে, বিশেষ করে বিজ্ঞানের বিষয়গুলো। গ্রাম-শহরনির্বিশেষে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের অবকাঠামো এবং শিক্ষকসমাজ কতটুকু প্রস্তুত, প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত শিক্ষকের অভাবে (প্রয়োজনীয় শিক্ষকদের প্রশিক্ষণ চলছে) শিক্ষার্থীরা প্রাইভেট ও কোচিংয়ের দিকে ধাবিত হয় কি না, তা দেখার বিষয়। এ জন্য মেধাবীদের শিক্ষকতায় আকৃষ্ট করতে হবে। অন্যথায় নতুন কারিকুলাম সাফল্যের মুখ দেখবে না, প্রয়োজনে শহর থেকে অভিজ্ঞ শিক্ষকদের তিন থেকে ছয় মাসের জন্য গ্রামের প্রতিষ্ঠানে বাধ্যতামূলক চাকরি করার বিধান রাখা যেতে পারে।

যাবতীয় একাডেমিক কার্যক্রমের আকর্ষণীয় ওয়েবসাইট (বাংলা ও ইংরেজিতে সাউন্ডসহ) যেখানে বেতন দেওয়া, বৃত্তির টাকা উত্তোলন, উপস্থিতির হিসাব, নির্দিষ্ট তারিখের মধ্যে ক্লাস-পরীক্ষা শেষ করে চূড়ান্ত ফলাফল প্রস্তুত করে মুঠোফোনসহ অনলাইনে প্রকাশ করা এবং শিখনকালীন ও চূড়ান্ত পরীক্ষা মূল্যায়নের সফটওয়্যার প্রস্তুত থাকতে হবে।

যুগোপযোগী কারিকুলাম এবং ছাত্র-শিক্ষক-অভিভাবকের সৌহার্দ্যপূর্ণ সম্পর্ক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। শিক্ষক শিক্ষার্থীদের শাসন করবেন, আদেশ-উপদেশ দেবেন, এটাই স্বাভাবিক। প্রযুক্তির অপব্যবহারে আজকাল অনেক শিক্ষার্থী কিশোর গ্যাংয়ের ছত্রচ্ছায়ায় নানা অপরাধমূলক কাজে লিপ্ত হয়ে পড়ছে। এসব নিয়ে সাম্প্রতিক সময়ে শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের মধ্যে কিছু অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনাকে কেন্দ্র করে হামলা-মামলা-জেল-জরিমানা ঘটেছে, যা কোনোভাবেই কাম্য নয়। শিক্ষার্থীদের শাসন করার ঘটনা বা কথোপকথন শিক্ষার্থী মুঠোফোনে ধারণ ও ভাইরাল করে ছাত্র-শিক্ষকের মধুর সম্পর্ককে কলঙ্কিত করেছে। তাই কোনোভাবেই শিক্ষকদের কোনো আলোচনা বা সিদ্ধান্ত যেন ছাত্র-শিক্ষককে সাংঘর্ষিক অবস্থায় না নেয়, সেদিকে সজাগ দৃষ্টি রাখতে হবে।

এখানে পরিচালনা কমিটির দায়িত্ব অপরিসীম এবং কমিটিতে থাকতে হবে উচ্চশিক্ষিত শিক্ষানুরাগী ব্যক্তিদের, কারণ আজকাল প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকও কমপক্ষে স্নাতক পাস হয়ে থাকেন। উচ্চ বিদ্যালয় ও কলেজে স্নাতকোত্তর ডিগ্রিধারীর নিচে এখন কোনো শিক্ষক নেই। তাহলে কমিটির সদস্য কিংবা সভাপতি ওই প্রতিষ্ঠানের একজন শিক্ষকের চেয়ে কম শিক্ষিত হলে কি চলে? কিন্তু বাস্তবে তা-ই হচ্ছে। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই এসএসসি-এসএসসি পাস করা (কিংবা আরও কম) ম্যানেজিং কমিটির সভাপতি তাঁর স্কুলের উচ্চশিক্ষিত শিক্ষকদের কথায় কথায় চড়থাপ্পড় মারেন, চাকরি থেকে বহিষ্কার ও নানাভাবে হয়রানি করেন। যদিও বর্তমান আইনে প্রতিষ্ঠানের সভাপতি হন স্থানীয় সংসদ সদস্য, কিন্তু তিনি একা এত প্রতিষ্ঠানের প্রতিনিধিত্ব করতে পারেন না বিধায় তাঁর মনোনীত কেউ থাকেন। তিনি রাজনৈতিকভাবে অভিজ্ঞ হলেও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে একজন শিক্ষকের কাছে কতটুকু বিবেচ্য, তা ভাবা দরকার। দলীয় বিবেচনায় হলেও তিনি যেন উচ্চশিক্ষিত ও শিক্ষানুরাগী হন, সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে। এ সবকিছু বিবেচনায় প্রণীত নতুন কারিকুলামটি বাস্তবায়ন করা হলে নতুন প্রজন্ম মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ গড়ার স্বপ্ন দেখবে, হবে সে সংস্কৃতিমনা, সাহসী, আত্মবিশ্বাসী, দেশপ্রেমিক ও বিশ্বমানের নাগরিক।

ড. এম মেসবাহউদ্দিন সরকার: অধ্যাপক, আইআইটি, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়