মতামত

প্রাচ্যের অক্সফোর্ডের শিক্ষকের প্রস্তাব প্রণিধানযোগ্য

অনেকেরই চোখে পড়েছে, আবার অনেকেরই হয়তো চোখ এড়িয়ে গেছে। তাই শুরুতেই কিছুটা বিরক্তিকর কিন্তু প্রয়োজনীয় দৃষ্টি আকর্ষণমূলক তথ্য দিয়ে নিই। ২৩ মের প্রথম আলোর চার নম্বর পৃষ্ঠার একটা খবরের শিরোনাম ছিল ‘মানববন্ধনে ঢাবি শিক্ষক জামাল উদ্দীন: নির্বাচন ছাড়াই সংসদ ও সরকারের মেয়াদ পাঁচ বছর বৃদ্ধির প্রস্তাব’। ভদ্রলোক সমাজবিজ্ঞানের অধ্যাপক। পত্রিকার খবর অনুযায়ী, ছাত্রজীবন থেকেই আওয়ামী রাজনীতির সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত।

মানববন্ধনটির গুরুত্ব বিরাট। মানববন্ধনে উপস্থিতির তালিকা অতি সংক্ষিপ্ত করলেও উপাচার্য মো. আখতারুজ্জামান, ঢাবি শিক্ষক সমিতির সভাপতি নিজামুল হক ভূঁইয়া, সাধারণ সম্পাদক জিনাত হুদা, উভয় সহ-উপাচার্য, সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের সাবেক ও বর্তমান ডিনসহ হোমরাচোমরা ব্যক্তিদের তালিকাটা দীর্ঘ। অর্থাৎ, মানববন্ধন থেকে উঠে আসা মূল কথাটা অবশ্যই প্রণিধানযোগ্য।

অধ্যাপক জামাল উদ্দীনের বক্তব্যের মূলকথা ছিল, নিকট ভবিষ্যতে জাতীয় নির্বাচন আয়োজন নিষ্প্রয়োজন। তাহলে এই সরকারের মেয়াদ শেষ হয়ে যাওয়ার পর সরকার গঠন কে করবে, সে প্রশ্নটা উঠতেই পারে। এ প্রশ্নের জবাব অধ্যাপক জামাল উদ্দীন খুবই স্পষ্ট ও প্রাঞ্জল ভাষায় উপস্থাপন করেছেন। তিনি বলেছেন, নিকট ভবিষ্যতে নির্বাচন না করে বর্তমান সংসদের মেয়াদ আরও পাঁচ বছরের জন্য বাড়িয়ে দেওয়া যায়। তাঁর কথামতে, অন্তত দুই বছর বাড়ানো কোনো ব্যাপারই নয়।

প্রধানমন্ত্রীর প্রাণনাশের প্রকাশ্যে হুমকি এসেছে। করোনার মহামারি থেকে আমরা মুক্ত হয়েছি, কিন্তু সব রোগবালাই থেকে এখনো রেহাই পাইনি। ডেঙ্গুকাল হয়তো জোরেশোরে শুরু হচ্ছে, করোনাও উঁকিঝুঁকি মারছে, হাসপাতালসহ অনেক স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্রে জনবল ও প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতির আকাল চলছে, রাশিয়া-ইউক্রেনের যুদ্ধে সারা পৃথিবী টালমাটাল; আর তার চেয়েও বেশি টালমাটাল আমাদের পেট্রোলিয়াম, গ্যাস, সারের বাজার।

প্রধানমন্ত্রী ও তাঁর সার্বিক নেতৃত্বাধীন সরকার এত সব সমস্যা সমাধান করেই চলেছে। মাঝেমধ্যে দু-একবার হোঁচট খেতেই পারে, সামলে নিয়েছে। পদ্মা সেতু হয়েছে এবং গাড়ি চলছে হাজারে হাজার, রেল চলবে সেপ্টেম্বর মাস নাগাদ। মেট্রোরেল চলছে এবং আগামী কয়েক বছরে মেট্রোরেল ও উড়ালসড়কে সারা ঢাকা ছেয়ে যাবে।

২. 

ওপরের কথাগুলো বেশির ভাগ পাঠক নিঃসন্দেহে জানেন এবং বোঝেন। কিন্তু এই সাফল্যগাথা থেকে অধ্যাপক জামাল উদ্দীনের উপসংহার, তথা আমাদের করণীয়টা জানতে পেরে আনন্দিতই হয়েছি।

নির্বাচন ঘিরে ঝুটঝামেলা লেগেই আছে কয়েক মাস ধরে। এত দিন দূরে দূরে ছিল। কিন্তু ২৩ মে পাল্টাপাল্টি ধাওয়া, মৃদু লাঠিপেটা, বাসের জানালা ভেঙে ফেলা ইত্যাদি ঘটে গেছে অধমের বাসগৃহের আধা কিলোমিটারের মধ্যেই। 

পত্রপত্রিকায় নেতাদের বক্তব্য শুনে প্রায় ৫০ বছর আগে ‘কোড অব হাম্মুরাবি’র দু-একটা ছিটেফোঁটা অংশ মনে পড়ে যায়। কৈফিয়তটা আবারও দিচ্ছি, যাতে কোনো ভুল-বোঝাবুঝির সৃষ্টি না হয়। প্রায় ৫০ বছর আগে ফার্স্ট ইয়ারের আইনের ক্লাসে পণ্ডিত শিক্ষক বুঝিয়েছিলেন, কমবেশি ২৮২টি ধারাসংবলিত প্রায় পৌনে চার হাজার বছরের পুরোনো প্রাচীনতম লিখিত ও সংরক্ষিত আইনটির নাম ‘কোড অব হাম্মুরাবি’। ব্যাবিলন সাম্রাজ্যের সম্রাট হাম্মুরাবি আইনের বিধানগুলো খোদাই করিয়েছিলেন একটা কমবেশি ৮ ফুট লম্বা পাথরে, যেটা ১৯০১ সালে প্রত্নতত্ত্ববিদেরা খুঁজে পেয়েছিলেন।

সেই হাম্মুরাবির আইনের একটা ধারা ছিল ‘চোখের বদলে চোখ, দাঁতের বদলে দাঁত’। অর্থাৎ, আমাদের বর্তমান রাজনীতির ভাষায়—যেই হাত দিয়ে আগুন জ্বালাবে, সেই হাত ভেঙে ফেলা হবে। ছোটবেলায় যখন পাঠান মুল্লুকসহ আমরা ছিলাম পাকিস্তানের অংশ, তখন গল্পে রূপকথায় পাঠানদের ঐতিহ্য বলে যা জেনেছিলাম, তা ছিল-‘খুন কা বাদলা খুন’। এ-সংক্রান্ত কিচ্ছা আছে সৈয়দ মুজতবা আলীর দেশে বিদেশের উপাখ্যানে, আবদুর রহমানের বয়ানে।

নির্বাচন যত ঘনিয়ে আসবে, ততই হানাহানি বৃদ্ধির আশঙ্কা অমূলক হবে না। বলা নিষ্প্রয়োজন, আমরা কেউই বিন্দুমাত্রও হানাহানি চাই না। হানাহানির ভাষায় কথাবার্তা হোক, সেটাও চাই না। সবাই শান্তিতে ভোট দিতে চায় এবং ভোটের সুষ্ঠু গণনা হলেই আমরা সবাই খুশি। কিন্তু এত চাওয়া-পাওয়ার কোনোটাই সম্ভবত মিলবে না। অতএব চাওয়া আর পাওয়ার মিলনের মোক্ষম ফর্মুলা দিয়েছেন অধ্যাপক জামাল উদ্দীন।

গত ৫০ বছরে কত দেশে কতবার নির্বাচন পেছানো হয়েছে, তার সঠিক হিসাব বের করতে গুগল চাচার সঙ্গে অনেক দিন গল্পগুজবে ব্যস্ত থাকতে হবে। সেটা না করে সহজেই বলা যায় যে নির্বাচন পেছানো কোনো ব্যাপারই না। অতএব, অধ্যাপক জামাল উদ্দীনকে তাঁর এই নতুন সমাধানের জন্য ধন্যবাদ এবং এই জাতির এক নগণ্য সদস্য হিসেবে প্রকাশ করছি অশেষ কৃতজ্ঞতা। আর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য থেকে শুরু করে অন্য সব অতি গুরুত্বপূর্ণ পণ্ডিত ও জ্ঞানী মানুষেরা যেহেতু অধ্যাপক জামাল উদ্দীনের সঙ্গে ছিলেন, তাই তাঁদেরও জানাচ্ছি ধন্যবাদ।

৩.

অধ্যাপক জামাল উদ্দীনের প্রস্তাবের পেছনে প্রায় অর্ধশতাব্দী পুরোনো একটা ইতিহাস আছে। সংবিধানের চতুর্থ সংশোধনী আইনে ১৯৭৫ সালে ৩৩ ধারা হুবহু তুলে ধরলাম:

‘৩৩। প্রথম সংসদের মেয়াদ বৃদ্ধি।—সংবিধানে যাহা বলা হইয়াছে, তাহা সত্ত্বেও এই আইন প্রবর্তনের অব্যবহিত পূর্বে দায়িত্ব পালনরত সংসদ, রাষ্ট্রপতি পূর্বে ভাঙ্গিয়া না দিয়া থাকিলে, এই আইন প্রবর্তন হইতে পাঁচ বৎসর অতিবাহিত হইলে ভাঙ্গিয়া যাইবে।’

১৯৭২ সালের ১৬ ডিসেম্বর কার্যকর হওয়া আমাদের সংবিধানের অধীন প্রথম সংসদের নির্বাচন হয় ৭ মার্চ ১৯৭৩ সালে। সেই প্রথম সংসদের ৫০তম বার্ষিকী উদ্‌যাপিত হলো মাত্র মাস দেড়েক আগে। প্রথম সংসদের প্রথম অধিবেশন শুরু হয়েছিল ১৯৭৩ সালের ৭ এপ্রিল। তাই ৭ এপ্রিল ২০২৩ সালে প্রথম জাতীয় সংসদের প্রথম অধিবেশনের ৫০ বছর পূর্ণ হলো।

সংবিধান অনুযায়ী, জাতীয় সংসদ নির্বাচনের ৩০ দিনের মধ্যে প্রথম অধিবেশন বসতে হবে। আর সেই প্রথম অধিবেশনের প্রথম দিন থেকে সংসদের মেয়াদ হবে পাঁচ বছর। অর্থাৎ, হিসাব অনুযায়ী, আমাদের প্রথম সংসদের মেয়াদ ছিল ৬ এপ্রিল ১৯৭৮ সাল পর্যন্ত। সংসদের মেয়াদ-সংক্রান্ত এই বিধান পরিবর্তন করে চতুর্থ সংশোধনী আইনের ৩৩ ধারায় বলা হয়েছিল এই আইন প্রবর্তনের দিন থেকে, অর্থাৎ ২৫ জানুয়ারি ১৯৭৫ থেকে মেয়াদ আরও পাঁচ বছর পর্যন্ত হতে পারত। অর্থাৎ, মেয়াদ হতে পারত ২৪ জানুয়ারি ১৯৮০ সাল পর্যন্ত।

সংসদের মেয়াদ বৃদ্ধি-সংক্রান্ত অধ্যাপক জামাল উদ্দীনের প্রস্তাব বাস্তবায়নের জন্য আইনমন্ত্রীকে চুল ছিঁড়তে হবে না; আইন মন্ত্রণালয়ের বাঘা বাঘা কর্মকর্তার ঘুম হারাম করারও দরকার নেই। শুধু দরকার ওপরের ৩৩ ধারার দিন-তারিখটা পাল্টে দেওয়া।

যেমন ধরুন, সংসদের আগামী বাজেট অধিবেশন সম্ভবত শেষ হবে জুলাই মাসের মাঝামাঝি কোনো এক তারিখে। কল্পনা করছি, তারিখটা ১৮ জুলাই। ১৮ জুলাইয়ে একটা মাত্র ধারাসংবলিত ‘সংবিধান (অষ্টাদশ সংশোধনী) আইন, ২০২৩’ পাস করা যেতে পারে এবং বলা যেতে পারে যে ‘ওই ১৮ জুলাই ২০২৩ থেকে বর্তমানে বিদ্যমান, অর্থাৎ একাদশ সংসদের মেয়াদ আরও তিন বছর বলবৎ থাকিবে।’ 

অধ্যাপক জামাল উদ্দীন পাঁচ বছরের মেয়াদ বৃদ্ধির কথা বলেছেন, অবশ্য কমপক্ষে দুই বছরের কথাও বলেছেন। এই অধম তিন বছরের কথা বলছে। পাঁচ, তিন না দুই বছর—তর্কবিতর্ক শেষে আমরা সবাই নিশ্চয়ই ঐকমত্যে পৌঁছাতে পারব। মোদ্দাকথা, সরকারের কোনো ঠেকা পড়েনি যে লালগালিচা বিছিয়ে বিএনপিকে আগামী নির্বাচনে আনতে হবে। আমাদের কারও ঠেকা পড়েনি পথে-ঘাটে, অলিগলিতে ক্ষমতাসীন দলের নেতা-কর্মীদের অথবা পুলিশের হাতে লাঠিপেটা খাওয়ার।

শেষ কথা 

গত ৫০ বছরে কত দেশে কতবার নির্বাচন পেছানো হয়েছে, তার সঠিক হিসাব বের করতে গুগল চাচার সঙ্গে অনেক দিন গল্পগুজবে ব্যস্ত থাকতে হবে। সেটা না করে সহজেই বলা যায় যে নির্বাচন পেছানো কোনো ব্যাপারই না। অতএব, অধ্যাপক জামাল উদ্দীনকে তাঁর এই নতুন সমাধানের জন্য ধন্যবাদ এবং এই জাতির এক নগণ্য সদস্য হিসেবে প্রকাশ করছি অশেষ কৃতজ্ঞতা। আর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য থেকে শুরু করে অন্য সব অতি গুরুত্বপূর্ণ পণ্ডিত ও জ্ঞানী মানুষেরা যেহেতু অধ্যাপক জামাল উদ্দীনের সঙ্গে ছিলেন, তাই তাঁদেরও জানাচ্ছি ধন্যবাদ। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় আমাদের বহু সংকটে জাতিকে দিয়েছে দিকনির্দেশনা। এই দিকনির্দেশনা নিকট অতীতের অনেক দিকনির্দেশনা থেকে বহুগুণ বেশি গুরুত্বপূর্ণ। আশা করি সবাই এটা আমলে নেবেন। 

পুনশ্চ: যুক্তরাষ্ট্রের নতুন ভিসা নীতি ঘোষণার পর এই লেখা নির্বাচনবিরোধী হিসেবে বিবেচিত হবে কি না, সেটাই ভাবছি। 

ড. শাহদীন মালিক বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী এবং গণ বিশ্ববিদ্যালয়ের আইনের শিক্ষক