সরকার কি দায়িত্বশীলতার পরিচয় দিল

তিন বছর আগের নাশকতার মামলায় বৃহস্পতিবার ঢাকা আদালতে হাজিরা দেন মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। পরে দিবাগত রাতে গ্রেপ্তার হন তিনি।
ছবি: প্রথম আলো

একদিকে ফুটবল জ্বর আর ক্রিকেটে বাংলাদেশের সিরিজ জয়, অন্যদিকে স্কুলে শীতকালীন ছুটির সুযোগে সপরিবার বেড়াতে যাওয়ার জন্য উন্মুখ হয়ে থাকা মানুষ, এর মধ্যে আচমকা নেমে এসেছে রাজনৈতিক ঝড়। এর ঝাপটায় স্বাভাবিক নাগরিক জীবন এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে। নয়াপল্টনের প্রধান সড়ক কয়েক ঘণ্টার জন্য হয়ে উঠেছিল কুরুক্ষেত্র। এখন ‘ক্রাইম সিন ডু নট ক্রস’  চিহ্ন লাগিয়ে সিআইডি পুলিশ রাস্তা পরিষ্কার করতে গিয়ে রাস্তার আটকে দিয়েছে। পুলিশ বিএনপি অফিসে ঢুকেছে। চালের বস্তা জব্দ করেছে। বোমা-ককটেলও নাকি পেয়েছে। অনেক নেতা-কর্মী গ্রেপ্তার হয়েছেন। শুক্রবার ভোরে বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম ও দলের স্থায়ী কমিটির সদস্য মির্জা আব্বাসকে বাড়ি থেকে পুলিশ ধরে এনেছে। এরপর আর বাকি থাকে কী?

এ সবই হয়েছে অনেক দিন আগে ঘোষণা দেওয়া ১০ ডিসেম্বরের সমাবেশকে কেন্দ্র করে। পুলিশ বলছে, জনদুর্ভোগ হয় এমন কোনো সমাবেশ তারা করতে দেবে না। তারা সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে সমাবেশ করতে বলেছিল। বিএনপি রাজি হয়নি। রাস্তা আটকে সমাবেশ করা আসলেই একটা ‘পাবলিক নুইসেন্স’। সপ্তাহখানেক আগে, উত্তরায় এ রকম একটি সমাবেশ করেছিল ক্ষমতাসীন দলের লোকেরা। নিকট অতীতে আমরা ঢাকার একটি প্রধান সড়ক দিনের পর দিন আটকে জনতার মঞ্চের মঞ্চায়ন দেখেছি। কয়েক বছর আগে দেখেছি গণজাগরণ মঞ্চ শাহবাগের মোড় আটকে রেখে মানুষকে অনেক যন্ত্রণা দিয়েছে। শাপলা চত্বর জুড়ে হেফাজতে ইসলাম তুলকালাম করেছে। ‘রাজপথ ছাড়ি নাই, ছাড়ব না’—এটা তো একটা জবরদস্ত স্লোগান। তারপরও আমরা দেখেছি, পুলিশের অনুমতি নিয়ে বিএনপি নয়াপল্টনের রাস্তায় অনেকবার সমাবেশ করেছে। এবার আপত্তি কেন উঠল?

পুলিশ তো নিজে নিজে কিছু করে না। তারা সরকারের সিদ্ধান্ত পালন করে। নয়াপল্টনে পুলিশ যা করেছে, তা হলো ক্ষমতাসীন দলের রাজনৈতিক সিদ্ধান্তের বাস্তবায়ন। কেন না, বেশ কয়েক দিন আগে থেকেই আওয়ামী লীগ নেতারা এ নিয়ে নানান কথা বলে আসছিলেন। বলেছিলেন, পুলিশের পাশাপাশি সোনার ছেলেরা ‘সতর্ক পাহারায়’ থাকবে।

পুলিশের আচরণ অনেক সময় বাড়াবাড়ির পর্যায়ে চলে যায়। ১৯৫২ সাল থেকেই এটা দেখা যাচ্ছে। সরকার আসে যায়, পুলিশের স্ক্রিপ্ট বদলায় না—‘উত্তেজিত জনতাকে ছত্রভঙ্গ করতে পুলিশ প্রথমে মৃদু লাঠিপেটা, তারপর কাঁদানে গ্যাস ও শেষে আত্মরক্ষার্থে গুলি ছুড়তে বাধ্য হয়।’ নয়াপল্টনে এটাই হয়েছে গত বুধবার।

বিএনপির শত শত নেতা-কর্মীর নামে আগে থেকেই মামলা ছিল। নতুন করে আরও মামলা দেওয়া হয়েছে। শুক্রবার প্রথম আলোয় প্রকাশিত সংবাদ অনুযায়ী, পল্টন, রমনা, মতিঝিল ও শাহজাহানপুর থানায় পুলিশ বিএনপির ৭২৫ জনের নাম উল্লেখ করে এবং আরও দেড় শ জন অজ্ঞাতনামার বিরুদ্ধে চারটি মামলা দিয়েছে। ‘অজ্ঞাতনামা’ মানেই গ্রেপ্তার ও জামিন বাণিজ্য, এটা কে না জানে।

এই সংঘাত ছিল অনভিপ্রেত। এর জন্য কে দায়ী, তা নিয়ে পাল্টাপাল্টি অভিযোগ তুলেছে আওয়ামী লীগ ও বিএনপি। পুলিশি কাণ্ডের সমর্থনে আওয়ামী লীগের কোনো শরিক এখন পর্যন্ত মুখ খোলেনি। কিন্তু বিএনপির সমর্থনে বেশ কয়েকটি ছোট দল বিবৃতি দিয়েছে।

ক্ষমতাসীন দলের আচরণ দেখে মনে হয়, নানান প্রতিবন্ধকতা ও উসকানি সত্ত্বেও বিএনপির সাম্প্রতিক সমাবেশগুলো সফল হওয়ায় তারা বেশ চিন্তিত ও আতঙ্কিত। তাদের মনে হয়েছে, এত দিনের অগোছালো দলটি শীর্ষ নেতৃত্বের অনুপস্থিতিতেও নিজেদের দৃশ্যমান করে তুলতে ও সক্ষমতা দেখাতে পারছে। দলের কান্ডারি এখন মহাসচিব মির্জা ফখরুল। তাঁকে সবাই জানেন একজন ভদ্রলোক হিসেবে। তাঁকে গ্রেপ্তার করে সরকার সুবিবেচনার পরিচয় দেয়নি।

এর আগে বিএনপি অনেকগুলো বিভাগীয় সমাবেশ করেছে। কোথাও বিএনপির লোকেরা মারতে গেছে বা বাস পুড়িয়েছে বলে জানা যায়নি। বরং তারা আশ্বস্ত করতে চেয়েছে, তারা শান্তিপূর্ণ সমাবেশ করবে। তারা কথা রেখেছে। বিভাগীয় সমাবেশগুলোর সময় গণপরিবহন বন্ধ হয়ে যাওয়ার অভিজ্ঞতা রয়েছে তাদের। ১০ ডিসেম্বরের আগে এ রকম আশঙ্কা থাকায় তারা অনেকেই বাইরে থেকে নয়াপল্টনে আসতে শুরু করে। তো তারা থাকবে কোথায়, খাবে কী? তো তাদের হটাতে পুলিশের এই অভিযান, চাল জব্দ এবং গ্রেপ্তার।

এখানে পক্ষ তিনটি—আওয়ামী লীগ, বিএনপি ও পুলিশ। আওয়ামী লীগ আর পুলিশ ‘জনস্বার্থে’ ঐক্যবদ্ধ হয়েছে। কয়েকজন পুলিশ সদস্যও আহত হয়েছেন। এক বিএনপি কর্মী মারা গেছেন। তার স্ত্রী বলেছেন,  তিনি মামলা করবেন না। কারণ তিনি বিচার পাবেন না। তিনি যে বিচার পাবেন না, এ কথা তো উড়িয়ে দেওয়া যায় না। আমরা জানি, শহীদ মিলনের মা একাধিকবার বলেছেন, তিনি বিচার পাননি।

বছরখানেক পরে নির্বাচন হবে বলে অনেকেই আশা করছেন। বিএনপি জানে, নির্বাচন ছাড়া সরকার পরিবর্তনের কোনো পথ নেই। তারা এ-ও জানে, ক্ষমতাসীন দলের অধীনে নির্বাচন হলে তাদের কপালে দুঃখ আছে। আওয়ামী লীগ ধরেই নিয়েছে, আগের মতো তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন হলে তাদের জেতার সম্ভাবনা নেই। তা না হলে সুপ্রিম কোর্টের পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশিত হওয়ার আগেই তড়িঘড়ি করে তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থা তারা বাতিল করত না। তাদের চেষ্টা থাকবে বিএনপি যেন নির্বাচনে না আসে, যেমনটি তারা করেছিল ১৯৮৬ ও ২০১৪ সালে।

যেহেতু দুটি দলই মরিয়া, সংঘাত ছিল অনিবার্য। কিন্তু সেটি তৈরি হলো আপাত তুচ্ছ একটি বিষয়কে কেন্দ্র করে, যা সহজেই এড়ানো যেত। নয়াপল্টনে সমাবেশ করার ব্যাপারে বিএনপির অনড় অবস্থান এবং এ নিয়ে সরকার ও ক্ষমতাসীন দলের নেতা-মন্ত্রীদের হুমকি-ধমকি পরিস্থিতি উত্তপ্ত করেছে, পরিস্থিতির অবনতি ঘটিয়েছে। সরকার দায়িত্বশীলতার পরিচয় দেয়নি।

পুলিশ একটি পেশাদার রাষ্ট্রীয় বাহিনী। তাদের বেতন-ভাতা জোগায় জনগণ। ক্ষমতাসীন দল আর পুলিশের ভাষা ও আচরণ যখন এক হয়ে যায়, তখন সুশাসন বলে আর কিছু থাকে না। অতীতেও আমরা এর নজির দেখেছি। ১৯৭৩-৭৫  সময়ে একজন পুলিশ সুপারের দোর্দণ্ড প্রতাপ ছিল দৃষ্টিকটু। পুলিশের উর্দিতে তাঁকে অতি উৎসাহী দলীয় ক্যাডার মনে হতো। বিএনপির শাসনামলে আমরা কোহিনূর নামের একজনকে দলীয় লাঠিয়াল হিসেবে দেখেছি। পুলিশের হাতে কখনো মতিয়া, নাসিম, মায়ারা মার খেয়েছেন, কখনো পিটুনি খেয়ে রক্তাক্ত হয়েছেন খোকা, লাঞ্ছিত হয়েছেন সেলিম। আমরা এসবের ছবি দেখেছি। সরকার পরিবর্তন হলেও পুলিশের আচরণ বদলায় না। তাদেরকে সরকারের হুকুম পালন করতে হয়। কিন্তু ধরে আনতে বললে বেঁধে আনা আর রিমান্ডে নিয়ে অত্যাচার, এটা হচ্ছে তাদের প্রেরোগেটিভ। এটা তারা না করলেও পারেন।

ক্ষমতাসীন দলের আচরণ দেখে মনে হয়, নানান প্রতিবন্ধকতা ও উসকানি সত্ত্বেও বিএনপির সাম্প্রতিক সমাবেশগুলো সফল হওয়ায় তারা বেশ চিন্তিত ও আতঙ্কিত। তাদের মনে হয়েছে, এত দিনের অগোছালো দলটি শীর্ষ নেতৃত্বের অনুপস্থিতিতেও নিজেদের দৃশ্যমান করে তুলতে ও সক্ষমতা দেখাতে পারছে। দলের কান্ডারি এখন মহাসচিব মির্জা ফখরুল। তাঁকে সবাই জানেন একজন ভদ্রলোক হিসেবে। তাঁকে গ্রেপ্তার করে সরকার সুবিবেচনার পরিচয় দেয়নি।

  • মহিউদ্দিন আহমেদ লেখক ও গবেষক