অভিমত

জ্ঞানদায়িনী সরস্বতী

আলো হলো শিক্ষা, জ্ঞান। হৃদয়ে শিক্ষার আলো থাকলে সাবলীল হয় যাপিত জীবন, উদার হয় মন, মানবতা জাগ্রত হয়। তাই শিক্ষাকে মানুষের মেরুদণ্ডের সঙ্গে তুলনা করা হয়েছে। ঘুণে ধরা সমাজব্যবস্থায় মেরুদণ্ডহীন মানুষ কখনোই সফলতার মুখ দেখতে পারেন না। মানুষ তাই শিক্ষার জন্য, জ্ঞানের জন্য নিরন্তর পরিশ্রম করেন। সনাতন ধর্মাবলম্বীদের বিশ্বাস, মা সরস্বতী হলেন এই শিক্ষা, জ্ঞান, ললিতকলার দেবী। তাঁর আশীর্বাদ আর মানুষের নিষ্ঠা ও জানার আগ্রহ তাঁকে পৌঁছে দিতে পারে জ্ঞানের চরম শিখরে। এই বিশ্বাস অন্তরে ধারণ করে দেশ-বিদেশে সনাতন ধর্মাবলম্বীরা আজ সরস্বতী মাকে পূজা দিয়ে তুষ্ট করে আশীর্বাদ প্রার্থনা করছেন।

শুক্লা পঞ্চমীর মাহেন্দ্রক্ষণে সরস্বতীপূজা হয়। এই শুক্লা পঞ্চমী তিথি বসন্ত পঞ্চমী, শ্রীপঞ্চমী, সরস্বতী পঞ্চমী, ঋষি পঞ্চমী নামেও পরিচিত। এই দিনে মা সরস্বতীর জন্ম হয়েছিল বলে বিশ্বাস করা হয়। ঋগ্বেদ অনুসারে, ব্রহ্মা তাঁর নিজের সৃষ্টিতে সন্তুষ্ট ছিলেন না। চারদিকে নিস্তব্ধতা। তারপর তিনি তাঁর কমণ্ডলু থেকে জল ছিটিয়ে দিলেন, যার ফলে এক চতুর্ভুজা নারী তাঁর হাতে বীণা নিয়ে হাজির হলেন। ব্রহ্মার আদেশে দেবী বীণায় সুমধুর সুর তোলেন, যা বিশ্বকে শব্দ ও বাণীতে অভিভূত করে। এরপর ব্রহ্মা দেবীর নাম রাখেন ‘সরস্বতী’। যিনি সারদা ও বাগ্‌দেবী নামেও পরিচিত। কোনো কোনো ক্ষেত্রে দেবীর বাহুর সংখ্যা অধিকতর হলেও সাধারণত তিনি চতুর্ভুজা, পদ্মাসনা, শুক্লাবর্ণা, শুভ্রবর্ণা, বীণা-পুস্তক, জপমালা, সুধাকলসর্ধারিণী, চন্দ্রশেখরা, ত্রিলোচনা। কখনো দেবী দ্বিভুজা। তন্ত্রে সরস্বতী বাগীশ্বরী-বর্ণেশ্বরী সারদা।

বৈদিক জ্যোতিরূপা সরস্বতী ও নদী সরস্বতী সম্মিলিতভাবে জ্ঞানের দেবীরূপে পুরাণতন্ত্র ও সাহিত্যে বিপুল শ্রদ্ধা ও ভক্তির অধিকারিণী হয়েছেন। বেদে সরস্বতী প্রধানত নদীর অধিষ্ঠাত্রী দেবী। পুরাণ অনুযায়ী, শুক্লা পঞ্চমীর তিথিতেই ব্রহ্মার মুখ থেকে বিদ্যা ও বুদ্ধির দেবী সরস্বতীর উৎপত্তি। পুরাণে আরও বলা হয়েছে, দেবী সরস্বতী আদ্যা প্রকৃতির তৃতীয় অংশজাত। তিনি বাক্য, বুদ্ধি, জ্ঞান, বিদ্যা ইত্যাদির অধিষ্ঠাত্রী দেবী। ওই গ্রন্থমতে, সরস্বতীপূজার প্রবর্তক ব্রহ্মা ও শ্রীকৃষ্ণ। তবে পণ্ডিতদের অনেকেই মনে করেন, সরস্বতী প্রথমে ছিলেন নদী, পরে হলেন দেবী। রমেশচন্দ্র দত্ত লিখেছেন ‘আর্যাবর্তে সরস্বতী নামে যে নদী আছে, তা-ই প্রথমে দেবী বলে পূজিত হয়েছিলেন।’

বর্তমানে গঙ্গা যেমন সনাতন ধর্মাবলম্বীদের উপাস্য দেবী হিসেবে পূজিত হয়ে থাকেন, তেমনি বিবর্তনের ধারায় সরস্বতী হলেন জ্ঞানের দেবী। সরস্বতীর বাহন হংস। বেদ ও উপনিষদে হংস শব্দের অর্থ সূর্য।

সরস্বতীর প্রকৃত তাৎপর্য নিহিত রয়েছে সূর্যাগ্নির জ্যোতিতে। সূর্যাগ্নির তেজ, তাপ ও চৈতন্যরূপে জীবদেহে বিরাজ করায় চেতনা, জ্ঞানের প্রকৃত কর্ত্রী তো দেবী সরস্বতী। সরস্বতী দেবীর রূপান্তর হয়েছে পৃথিবীতে নদীরূপে এবং সরস্বতীই অগ্নি-ইন্দ্র-মরুৎ অশ্বীদ্বয়ের সংস্পর্শে শত্রুঘাতিনী, ধনদাত্রী এবং বৃহস্পতি-ব্রহ্মাণস্পতির বিদ্যাবত্তার সংযোগে নদী সরস্বতীর সঙ্গে অভিন্নরূপে সরস্বতী তীরে উচ্চারিত বৈদিক মন্ত্রে সংশ্লিষ্ট হয়ে পুরাণে বিদ্যা ও জ্ঞান ভিন্ন অপর জ্ঞানগুলো অন্যত্র স্থাপন করে হলেন বিদ্যাধিষ্ঠাত্রী।

বৃহস্পতি হচ্ছেন জ্ঞানের দেবতা, তিনি বাক্পতিও। ইন্দ্রও বাক্পতি। বৃহস্পতিপত্নী সরস্বতীও জ্ঞানের দেবী। সব জ্ঞানের ভান্ডার তো ব্রহ্মা-বিষ্ণু আর মহেশ্বরের। তাঁদেরই শক্তিতে সরস্বতী জ্ঞানের দেবী। সরস্বতী নদীর তীরে যজ্ঞের আগুন জ্বেলে সেখানেই ঋষিরা লাভ করেছিলেন বেদ, ঋগ্‌মন্ত্র। সুতরাং সরস্বতী জ্ঞানের দেবী হিসেবেই পরিচিত হয়েছিলেন ধরাতে। দিন দিন সরস্বতী তাঁর অন্য বৈশিষ্ট্যগুলো হারিয়ে কেবল বিদ্যাদেবী; অর্থাৎ জ্ঞান ও ললিতকলার দেবীতে পরিণত হলেন।

স্বামী বিবেকানন্দ বলেছিলেন, ‘শিক্ষা হচ্ছে, মানুষের ভিতর যে পূর্ণতা প্রথম হতেই বর্তমান, তারই প্রকাশ।’

আমাদের প্রত্যকের ভেতরে অনন্ত জ্ঞানের ভাণ্ডার রয়েছে। জ্ঞান সততই বর্তমান রয়েছে, মানুষ কেবল সেটা আবিষ্কার করে। এই জ্ঞান আবার মানুষের অন্তর্নিহিত।

  •  তারাপদ আচার্য্য সাধারণ সম্পাদক, সাধুনাগ মহাশয় আশ্রম, দেওভোগ, নারায়ণগঞ্জ