মতামত

সরকারি হাসপাতালে আয়া–ওয়ার্ড বয়–গার্ডের এমন নিয়োগ কতটা যৌক্তিক?

হাসপাতালে পরিচ্ছন্নতাকর্মী, আয়া, ওয়ার্ড বয়, নিরাপত্তা প্রহরীসহ সহায়ক জনবলের প্রয়োজনীয়তা অপরিসীম। এসব জনবলের ঘাটতি থাকলে হাসপাতালের সেবা ও সেবার মান প্রচণ্ডভাবে ব্যাহত হয়। দীর্ঘকাল ধরে নিয়মিতভাবে নিয়োগের অভাবে হাসপাতালে এসব জনবলের তীব্র ঘাটতি মোকাবিলার অংশ হিসেবে ২০১৮ সালে আউটসোর্সিং পদ্ধতির মাধ্যমে এসব জনবল নিয়োগের ধারা চালু হয়।

বর্তমানে সরকারি হাসপাতালে ২০তম গ্রেড বা চতুর্থ শ্রেণির ছয়টি (যথা পরিচ্ছন্নতাকর্মী, আয়া, ওয়ার্ড বয়, নিরাপত্তা প্রহরী, মালি, বাবুর্চি ও কুক/ মশালচি) পদে স্থায়ী নিয়োগের পরিবর্তে আউটসোর্সিং পদ্ধতির মাধ্যমে নিয়োগ দেওয়া হচ্ছে।

প্রতিটি জেলায় সিভিল সার্জন অফিসের মাধ্যমে উন্মুক্ত দরপত্রের ভিত্তিতে কোনো আউটসোর্সিং ফার্মকে এক বছরের জন্য দায়িত্ব দেওয়া হচ্ছে সংশ্লিষ্ট জেলার উপজেলা হেলথ কমপ্লেক্সগুলোয় এবং জেলা হাসপাতালে এসব পদে আউটসোর্সিং ভিত্তিতে নিয়োগ দেওয়ার। এসব পদে নিয়োগ পাওয়া ব্যক্তিদের সরকার কর্তৃক নির্ধারিত মাসিক বেতনের পাশাপাশি আউটসোর্সিং ফার্মের জন্য নির্ধারিত কমিশন বা সার্ভিস ফি নির্ধারণ করা আছে।

ক্লিনিং বা সমজাতীয় কাজের ক্ষেত্রে উন্নত বিশ্বে আউটসোর্সিং পদ্ধতিতে নিয়োগদান একটি কার্যকরী পদ্ধতি হিসেবে স্বীকৃত। সৌদি আরব, মালয়েশিয়াসহ বিভিন্ন দেশে আমাদের প্রবাসী শ্রমিকদের একটি বড় অংশ আউটসোর্সিং পদ্ধতিতে নিয়োজিত। বাংলাদেশও ফ্ল্যাট বাড়ি এবং অফিসের নিরাপত্তা প্রহরী আউটসোর্সিং পদ্ধতিতে নিয়োগ হচ্ছে। এয়ারপোর্টে টয়লেট ক্লিনিং এবং অন্যান্য পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার ক্ষেত্রেও আউটসোর্সিং পদ্ধতিতে নিয়োগ হচ্ছে।

কিন্তু স্বাস্থ্য খাতে, বিশেষ করে হাসপাতালে পরিচ্ছন্নতাকর্মী, আয়া, ওয়ার্ড বয়, নিরাপত্তা প্রহরী, মালি, বাবুর্চি ও কুক/ মশালচি পদে আউটসোর্সিং পদ্ধতিতে নিয়োগদান কতটুকু যুক্তিসংগত, তা বিশ্লেষণের দাবি রাখে।

আউটসোর্সিং ব্যবস্থায় দ্রুত শূন্য পদে জনবল নিয়োগ এবং মঞ্জুরিকৃত পদের থেকে বেশি জনবল নিয়োগ করার সুযোগসহ বেশ কিছু সুবিধা থাকলেও অসুবিধার পাল্লাই বেশি ভারী। বাংলাদেশে স্বাস্থ্য খাতে আউটসোর্সিং ব্যবস্থার অর্থায়ন পরিচালন বাজেটের আওতায়।

ফলে প্রতিবছর নতুনভাবে আউটসোর্সিং প্রতিষ্ঠান বাছাই করতে হয়। আর এ প্রক্রিয়া সম্পন্ন করতে অর্থবছরের প্রায় অর্ধেক লেগে যায়। এ সময় আউটসোর্সিং স্টাফরা বেতন পান না। আবার সংশ্লিষ্ট আউটসোর্সিং প্রতিষ্ঠান পুনর্বার চুক্তিভুক্ত হতে না পারলে আউটসোর্সিং স্টাফদের কাজ হারানোর ঝুঁকিও থাকে।

এ ক্ষেত্রে স্থানীয় রাজনৈতিক এবং পেশিশক্তির প্রভাবে নিয়োগপ্রক্রিয়া বিঘ্নিত হতে পারে এবং হাসপাতাল প্রশাসনের সঙ্গে স্থানীয় প্রভাবশালী ব্যক্তির মধ্যে দ্বন্দ্ব তৈরি হতে পারে। উল্লেখ্য, বার্ষিক চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ এবং পারফরম্যান্সের ভিত্তিতে চুক্তি নবায়ন বিশ্বে বহুল প্রচলিত একটি পদ্ধতি। স্বল্প মেয়াদে এটিই উত্তম পদ্ধতি। তাই সরকার আপাতত এ পদ্ধতি গ্রহণ করতে পারে।

তা ছাড়া আউটসোর্সিং স্টাফদের কাজ দেওয়ার ক্ষেত্রে আউটসোর্সিং প্রতিষ্ঠান কর্তৃক মোটা অঙ্কের ঘুষ গ্রহণ এবং প্রতি মাসের বেতন থেকে একটি বড় অংশ প্রদানে বাধ্য করার অভিযোগ সবারই জানা, যা সাম্প্রতিক কালে জাতীয় সংসদেও আলোচনা হয়েছে।

ঠিকঠাক কাজ না করলে বা নিয়মিতভাবে কাজে না এলে হাসপাতাল প্রশাসনের শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণের সুযোগ নেই। এসব কারণে আউটসোর্সিং স্টাফদের সংশ্লিষ্ট দায়িত্ব ও কর্তব্য পালনে গাফিলতিসহ নানা অনিয়মে জড়িত থাকার আশঙ্কা তৈরি হয়। একজনের কাজ অন্যজনকে দিয়েও করানোর প্রবণতাও দেখা যায়।

ফলে রোগী, রোগীর স্বজন, নারী চিকিৎসক ও নার্সদের মধ্যে নিরাপত্তাহীনতা দেখা দিতে পারে। হাসপাতালের বিভিন্ন সম্পদ চুরি বা ক্ষতির আশঙ্কা তো আছেই। আবার সংঘটিত ক্রাইম ঘটানোর আশঙ্কাও সৃষ্টি হতে পারে।

তাই আউটসোর্সিং পদ্ধতির বিকল্প ভাবতে হবে। একটি বিকল্প হলো, আগের মতো স্থায়ী নিয়োগে ফিরে যাওয়া। তবে এ ক্ষেত্রে প্রতি দুই থেকে তিন বছর পরপর জেলা কিংবা বিভাগের মধ্যে বদলির বিধান রাখতে হবে এবং তা জোরালোভাবে কার্যকর করতে হবে। রোগী ও হাসপাতালের সামগ্রিক নিরাপত্তার স্বার্থে এটিই সবচেয়ে উত্তম পদ্ধতি। তবে এ ক্ষেত্রে নিয়মিত নিয়োগপ্রক্রিয়া চালু রাখতে হবে। উল্লেখ্য, তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণির সরকারি কর্মচারীদের ক্ষেত্রে বর্তমানে বদলি পদ্ধতি চালু নেই।

অন্য বিকল্প হলো, সিভিল সার্জন অফিস বা সংশ্লিষ্ট হাসপাতাল প্রশাসনের মাধ্যমে বার্ষিক পারফরম্যান্সের ভিত্তিতে নবায়নের বিধান রেখে সরাসরি চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ। এ প্রক্রিয়ায় প্রতিবছর নিয়োগের প্রয়োজন না থাকায় চুক্তিভিত্তিক নিয়োগপ্রাপ্ত স্টাফদের নিয়মিত বেতন-ভাতা প্রাপ্তিতে কোনো বিঘ্ন ঘটবে না।

অন্যদিকে পারফরম্যান্সের ভিত্তিতে নবায়নের বিধান থাকায় এসব স্টাফের দায়িত্ব ও কর্তব্য পালনে গাফিলতি এবং অনিয়মে জড়িত হওয়ার আশঙ্কা অনেক কমে যাবে।

তবে এ ক্ষেত্রে স্থানীয় রাজনৈতিক এবং পেশিশক্তির প্রভাবে নিয়োগপ্রক্রিয়া বিঘ্নিত হতে পারে এবং হাসপাতাল প্রশাসনের সঙ্গে স্থানীয় প্রভাবশালী ব্যক্তির মধ্যে দ্বন্দ্ব তৈরি হতে পারে। উল্লেখ্য, বার্ষিক চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ এবং পারফরম্যান্সের ভিত্তিতে চুক্তি নবায়ন বিশ্বে বহুল প্রচলিত একটি পদ্ধতি। স্বল্প মেয়াদে এটিই উত্তম পদ্ধতি। তাই সরকার আপাতত এ পদ্ধতি গ্রহণ করতে পারে।

  • সৈয়দ আবদুল হামিদ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বাস্থ্য অর্থনীতি ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক