মতামত

ভারতীয়রা বিশ্ব জয় করছেন, ভারত জয় করতে পারছেন কি

যুক্তরাজ্যের প্রধানমন্ত্রী ঋষি সুনাক
যুক্তরাজ্যের প্রধানমন্ত্রী ঋষি সুনাক

ঋষি সুনাকের ব্রিটিশ রাজনীতির চূড়ায় আরোহণ ভারতজুড়ে উদ্‌যাপিত হচ্ছে। একজন বাদামি চামড়ার ধর্মনিষ্ঠ হিন্দু ব্যক্তি যুক্তরাজ্যের নেতৃত্ব দিচ্ছেন—এটি অবশ্যই উল্লেখযোগ্য ঘটনা। তবে সুনাকের উত্থান আরও বিস্তৃত ও সুদূরপ্রসারী ঘটনা-পরম্পরার দিকে আমাদের দৃষ্টি নিয়ে যায়। সেটি হলো পশ্চিমা দুনিয়ায় ভারতীয় প্রবাসীদের ক্রমবর্ধমান উত্তরণ।

এই প্রবণতা বেশ কিছুদিন ধরেই স্পষ্ট হচ্ছে। বিশেষ করে বেসরকারি খাতে ভারতীয় বংশোদ্ভূত নির্বাহীদের যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক বহুজাতিক করপোরেশনের নেতৃত্বে আসতে দেখা যাচ্ছে। মাইক্রোসফটের সিইও সত্য নাদেলা, অ্যালফাবেটের সিইও সুন্দর পিচাই এবং পেপসিকোর প্রাক্তন সিইও ইন্দ্রা নুয়ি সম্ভবত সবচেয়ে পরিচিত উদাহরণ।

কিন্তু এমন আরও অনেক আছেন। এস অ্যান্ড পি গ্লোবাল রেটিংস অনুসারে, বিশ্বের প্রথম সারির ৫০০ কোম্পানির মধ্যে কমপক্ষে ৫৮টি কোম্পানি ভারতীয় বংশোদ্ভূত প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) দ্বারা পরিচালিত হয়।

ঋষি সুনাকের প্রধানমন্ত্রী হওয়ার ঘটনাটি ভারতীয় প্রবাসীদের পশ্চিমা দেশগুলোর রাজনীতিতে প্রাধান্য বিস্তারের ধারা সামনে এনেছে। যুক্তরাষ্ট্রের ভাইস প্রেসিডেন্ট কমলা হ্যারিস একজন ভারতীয় মায়ের গর্ভে জন্মগ্রহণ করেছিলেন এবং জাতিসংঘের সাবেক মার্কিন রাষ্ট্রদূত নিকি হ্যালি (যিনি ২০২৪ সালে একজন সম্ভাব্য মার্কিন প্রেসিডেন্ট প্রার্থী) ভারতীয় পাঞ্জাবি শিখ মা–বাবার কন্যা।

২০১৫ সাল থেকে পর্তুগালের প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করে আসা আন্তোনিও কস্তার বাবা অংশত ভারতীয় ছিলেন। আয়ারল্যান্ডের সাবেক প্রধানমন্ত্রী লিও ভারাদকার একজন অর্ধভারতীয়, যিনি একটি পালাবদলের চুক্তির অংশ হিসেবে এই বছরের শেষের দিকে আবার প্রধানমন্ত্রীর পদে আসবেন বলে আশা করা হচ্ছে। ইংল্যান্ড ও আয়ারল্যান্ডের মধ্যে ব্রেক্সিট-পরবর্তী কণ্টকাকীর্ণ আলোচনা শিগগিরই ভারতীয় বংশোদ্ভূত দুই নেতার নেতৃত্বে পরিচালিত হতে পারে।

এই প্রবণতার ব্যাখ্যা কী হতে পারে? কেন ভারতীয় অভিবাসীরা বা তাঁদের সন্তানেরা প্রায়ই পাশ্চাত্যে পশ্চিমা পদ্ধতির শিক্ষায় উন্নতি করেন? একটি সম্ভাব্য ব্যাখ্যা হতে পারে, ভারতবর্ষে দুই শতাব্দীর ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসন থাকার কারণে ইংরেজি ভাষার সঙ্গে ভারতীয়রা পরিচিত। কিন্তু শুধু ভাষা জানাটা সাফল্যের ক্ষেত্রে খুব কমই নিশ্চয়তা দেয়।

আর যদি সেটিকেও বিবেচনায় নিই, তাহলে সে যুক্তি ইংরেজি চালু নেই এমন নন-অ্যাংলোফোন ইউরোপীয় দেশগুলোতে ভারতীয়দের কৃতিত্ব অর্জনের বিষয়টিকে ব্যাখ্যা করে না। উদাহরণস্বরূপ, জার্মানিতে ৫৮ শতাংশ ভারতীয় বংশোদ্ভূত কর্মী যে চাকরি করেন, তা পেতে গেলে সেখানকার বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিগ্রি বা সমতুল্য বিশেষজ্ঞ দক্ষতা থাকার দরকার হয়।

ভারতীয়রা তাঁদের প্রবাসীদের সাফল্যের প্রশংসা করার সময় যে বৈশিষ্ট্যগুলোকে মহান হিসেবে উল্লেখ করেন, সেই বৈশিষ্ট্য ও মূল্যবোধগুলোকে ভারতের ক্ষমতাসীন ভারতীয় জনতা পার্টি (বিজেপি) দমন করতে চাইছে। বিজেপি-শাসিত ভারতে উচ্ছৃঙ্খল হিন্দুত্ববাদী উগ্র জাতীয়তাবাদ বৈচিত্র্যকে হুমকির মুখে ফেলেছে। এটা খুবই দুঃখজনক যে বিশ্বজুড়ে ভারতীয়দের মধ্যে যে গুণাবলির প্রশংসা করা হচ্ছে, তা শিগগিরই প্রবাসীদের মধ্যে তাঁদের পৈতৃক দেশের তুলনায় আরও স্পষ্ট হতে পারে।

আরেকটি ব্যাখ্যা হতে পারে, ভারতীয় অভিবাসীরা সাধারণত অধিকতর অনুপ্রাণিত (মোটিভেটেড) স্বভাবের হয়ে থাকেন। কিন্তু তঁারা অন্যান্য অভিবাসী সম্প্রদায়কে ছাড়িয়ে গেছে বলে মনে হয়। যুক্তরাষ্ট্রে নানা ধরনের জাতীয়তা এবং জাতিসত্তার মানুষের মধ্যে ভারতীয় বংশোদ্ভূত নাগরিকদের দীর্ঘকাল ধরে সর্বোচ্চ মাথাপিছু আয় করার এবং সেই ধারা ধরে রাখার রেকর্ড রয়েছে।

সীমিত সম্পদ, বিভিন্ন ধরনের কড়া সরকারি বিধিনিষেধ এবং আমলাতান্ত্রিক জটিলতার মতো প্রতিকূলতা ঠেলে প্রথম প্রজন্মের ভারতীয় অভিবাসীরা পশ্চিমা দেশগুলোতে অস্তিত্ব রক্ষার সংগ্রাম করেছিলেন। তাঁদের বেশির ভাগকেই হয় বঞ্চনার অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে যেতে হয়েছে, নয়তো সেই বঞ্চনা এড়াতে গিয়ে কঠোর কঠিন পথ পাড়ি দিতে হয়েছে।

অন্যদিকে ভারতের ইতিহাস এবং বহুত্ববাদ ভারতীয়দের পশ্চিমা বিশ্বের বিভিন্ন ভাষা, ধর্ম ও সংস্কৃতির মানুষের কাছে নতুনভাবে উন্মোচিত করেছে। ‘অন্যদের’ সঙ্গে মানিয়ে নেওয়াটা দীর্ঘদিনের গভীর ও অন্তর্নিহিত অনুশীলনের ফসল। এই অনুশীলনের মধ্যে থাকার কারণে ভারতীয় অভিবাসীরা বহুজাতিক সংস্থাগুলোতে কাজ করতে খুব স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করে থাকেন।

গণতান্ত্রিক দেশগুলোতে বেড়ে ওঠা ভারতীয় বংশোদ্ভূত কর্মীদের স্বতন্ত্র উদ্যোগ, সমালোচনামূলক চিন্তাভাবনা এবং স্বাধীনভাবে মতপ্রকাশের মতো মূল্যবোধ উন্নত মানব হিসেবে গড়ে তোলে, যা সাধারণত বৈষয়িক জগতে ‘সম্পদ’ হিসেবে বিবেচিত হয়ে থাকে। একই সঙ্গে ‘হায়ারার্কি’ বা শ্রেণিভিত্তিক অনুক্রমের প্রতি ভারতীয়রা শ্রদ্ধাশীল থাকায় পশ্চিমা সমাজে তাঁরা কখনোই হুমকি বা ‘বিপ্লবী’ হিসেবে চিহ্নিত হননি। এই ভাবমূর্তি তাঁদের পশ্চিমা সমাজে সৃজনশীল কিন্তু ‘নিরাপদ’ হিসেবে দেখাতে সক্ষম করেছে। এতে নতুন সমাজে তঁাদের গ্রহণযোগ্যতা বেড়েছে এবং প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে তঁাদের উত্তরণকে সহজ করেছে।

একইভাবে বৈচিত্র্যের ব্যাপারে ভারতের উৎসাহ দেওয়া এবং বাড়াবাড়ির বিষয়ে নিরুৎসাহিত করা ভারতীয়দের প্রতিযোগিতামূলক পরিবেশের সঙ্গে খাপ খাইয়ে নেওয়াকে সহজ করে দেয়। লেখাপড়া শেখা এবং অন্যান্য কর্মমুখী শিক্ষার ওপর ভারতীয়দের জোর দেওয়া ও পারিবারিক বন্ধনের প্রতি গুরুত্বারোপ ভারতীয়দের বিদেশের মাটিতে সুসংহত করতে সহায়তা করেছে।

যদিও প্রথম প্রজন্মের অভিবাসীদের মধ্যে এ ধরনের বৈশিষ্ট্যগুলো প্রায়ই লক্ষ করা যায়; তবে সুনাক, ভারাদকার ও হ্যারিসের সাফল্য থেকে বোঝা যায়, ভারতীয়রা সফলভাবে তাঁদের সন্তানদের মধ্যে এই বৈশিষ্ট্যগুলো সঞ্চারিত করতে পেরেছেন। বিশেষ করে, সুনাককে অনেক ভারতীয় তাঁদের আকাঙ্ক্ষা এবং মূল্যবোধের মূর্ত রূপ বলে মনে করেন। তাঁরা তাঁকে ‘নতুন ভারত’-এর ‘পোস্টার বয়’ হিসেবে উল্লেখ করে তাঁর সাফল্যকে উদ্‌যাপন করেছেন।

কূটাভাস হলো এই, ভারতীয়রা তাঁদের প্রবাসীদের সাফল্যের প্রশংসা করার সময় যে বৈশিষ্ট্যগুলোকে মহান হিসেবে উল্লেখ করেন, সেই বৈশিষ্ট্য ও মূল্যবোধগুলোকে ভারতের ক্ষমতাসীন ভারতীয় জনতা পার্টি (বিজেপি) দমন করতে চাইছে। বিজেপি-শাসিত ভারতে উচ্ছৃঙ্খল হিন্দুত্ববাদী উগ্র জাতীয়তাবাদ বৈচিত্র্যকে হুমকির মুখে ফেলেছে। এটা খুবই দুঃখজনক যে বিশ্বজুড়ে ভারতীয়দের মধ্যে যে গুণাবলির প্রশংসা করা হচ্ছে, তা শিগগিরই প্রবাসীদের মধ্যে তাঁদের পৈতৃক দেশের তুলনায় আরও স্পষ্ট হতে পারে।

স্বত্ব: প্রজেক্ট সিন্ডিকেট, অনুবাদ: সারফুদ্দিন আহমেদ

  • শশী থারুর ভারতের সাবেক পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী ও জাতিসংঘের সাবেক আন্ডার সেক্রেটারি জেনারেল। বর্তমানে তিনি ভারতের কংগ্রেস পার্টির একজন এমপি