বিজ্ঞান, গবেষণা ও শিল্পে বাংলাদেশ অনেক পিছিয়ে আছে। এসব বিষয়ের সঙ্গে অর্থনীতির যোগসূত্র গভীর। ইউরোপ–আমেরিকার ইতিহাস অনুসন্ধানের মধ্য দিয়ে বিজ্ঞান, প্রযুক্তি ও শিল্পের অগগ্রতির গুরুত্ব ও শর্ত নিয়ে লিখেছেন সাইফ ইসলাম
বাংলাদেশের মানুষের সাম্প্রতিক কয়েক দশকের অভিজ্ঞতার সঙ্গে উনিশ শতকের যুক্তরাষ্ট্রের দক্ষিণের অঙ্গরাজ্যগুলোর নিপীড়িত কৃষ্ণাঙ্গদের আর্থসামাজিক জীবনের গভীর মিল রয়েছে। এমন নিপীড়িত ও অধিকারবঞ্চিত সমাজে কি সৃজনশীলতা, উদ্ভাবন এবং আধুনিক শিল্পভিত্তিক অর্থনীতির, উচ্চশিক্ষিত ও মানবিক গুণসম্পন্ন ব্যক্তিত্বের বিকাশ সম্ভব?
২০২০ সালে মেরিল্যান্ড বিশ্ববিদ্যালয় ও ব্রুকিংস ইনস্টিটিউশনের একটি গবেষণার বিষয় ছিল গত দুই শতকে উত্তর ও দক্ষিণের মার্কিন অঙ্গরাজ্যগুলোর কৃষ্ণাঙ্গদের উদ্ভাবন-চালিত যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনীতিতে অবদান। এতে কিছু চমকপ্রদ সত্য উন্মোচিত হয়েছে। সেখানে যাওয়ার আগে যুক্তরাষ্ট্রের সেই দিনগুলোর আর্থসামাজিক ও উদ্ভাবনকেন্দ্রিক ইতিহাসে একটু নজর দিই।
১৯১০ সালের পর থেকে ৫০ কোটি প্রজার ব্রিটিশ সাম্রাজ্য দুই শতকের নিরবচ্ছিন্ন অর্থনৈতিক শ্রেষ্ঠত্ব হারাতে থাকে। এর পেছনে অন্যতম ভূমিকা রেখেছিল যুক্তরাষ্ট্রের ৮ কোটি নাগরিকের আধুনিক ও প্রগতিশীল অর্থনীতি। তবে সামরিক শক্তিতে ব্রিটিশরা আরও কয়েক দশক ধরে বিশ্বের প্রধান পরাশক্তি ছিল।
ব্রিটিশদের অর্থনৈতিক শক্তির মূল ভিত্তি ছিল দ্বিতীয় শিল্পবিপ্লব, বিশ্ববাণিজ্য, ঔপনিবেশিক সম্প্রসারণ ও নৌবাহিনীর আধিপত্য। দ্বিতীয় শিল্পবিপ্লবের মূল স্তম্ভগুলোর মধ্যে পড়ে বিদ্যুৎ, পরিবহন, যোগাযোগ, প্রযুক্তিনির্ভর কৃষি ও শিল্প উৎপাদনে যুগান্তকারী অগ্রগতি। উপনিবেশগুলো বাদ দিয়ে যুক্তরাজ্যকে আলাদা দেশ হিসেবে ধরা হলে যুক্তরাষ্ট্র ১৮৭০ সালের দিকে প্রায় ৮০০ কোটি ডলারের জিডিপি নিয়ে পৃথিবীর শীর্ষ অর্থনৈতিক শক্তি হিসেবে আবির্ভূত হয়।
শিল্পায়নের পাশাপাশি যে শক্তি আজও মার্কিন অর্থনীতিকে বৈশ্বিক নেতৃত্বের শীর্ষে রেখেছে, তা হলো তাদের গভীর উদ্ভাবনকেন্দ্রিক মানসিকতা। পণ্যের নকশা, ব্যবহারিকতা ও মানবসমাজের নতুন চ্যালেঞ্জগুলোর সমাধানে তারা অসাধারণ উদ্ভাবনী সংস্কৃতি কাজে লাগায়। সেই সঙ্গে বিশ্বব্যাপী মেধাবীদের স্বাগত জানানোর নীতি তাদের শক্তির অন্যতম ভিত্তি।
দ্বিতীয় শিল্পবিপ্লবের পরিধি ১৮৭০ থেকে ১৯৪০ সাল পর্যন্ত। এই সময় উদ্ভাবনের স্বর্ণযুগ হিসেবে পরিচিত। সে সময় উদ্ভাবনী ক্ষমতা ও পেটেন্ট–ব্যবস্থার দক্ষ প্রয়োগ যুক্তরাষ্ট্রকে বৈশ্বিক নেতৃত্বের শীর্ষ স্থানে নিয়ে আসে। দেশটির অর্থনৈতিক ও প্রযুক্তিগত আধিপত্য দৃঢ় হয়। পেটেন্ট-ব্যবস্থার ফলে অসংখ্য সম্পদশালী উদ্যোক্তার উত্থান ঘটে আর কোটি কোটি মানুষের কর্মসংস্থান হয়। পেটেন্টের ধারণা প্রথম প্রবর্তিত হয় ১৪৭৪ সালে ইতালির ভেনিস রিপাবলিকে। পরবর্তী সময় ১৬২৪ সালে ইংল্যান্ড ও ১৭৯০ সালে যুক্তরাষ্ট্র এটি গ্রহণ করে। প্রথম মার্কিন প্রেসিডেন্ট জর্জ ওয়াশিংটন একে বিশ্বে উদ্ভাবনকে সুরক্ষা ও উৎসাহ দেওয়ার ক্ষেত্রে একটি মাইলফলক মনে করতেন। সৃজনশীলতা ও উদ্ভাবন আমেরিকায় জন্মলগ্ন থেকে গভীরভাবে প্রোথিত। জর্জ ওয়াশিংটন, থমাস জেফারসন ও জেমস ম্যাডিসনের মতো অনেক রাষ্ট্রপ্রধান একাধিক উদ্ভাবনের পেটেন্ট নিয়েছিলেন।
যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠাতারা দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করতেন, ‘স্বাধীনতা বিজ্ঞান ও শিল্পের প্রসূতি।’ ১৭৯২ সালের মুদ্রায় এই মূলমন্ত্র খোদাই করা হয়েছিল, আর তাঁদের দীর্ঘ আর্থসামাজিক ইতিহাসের প্রতিটি বাঁকে সেই বিশ্বাসকেই তাঁরা প্রতিষ্ঠিত করেছেন। পরিপূর্ণ স্বাধীনতা ও মানবাধিকার ছাড়া বিশ্বের কোথাও প্রযুক্তিনির্ভর ও উদ্ভাবনী অর্থনীতি গড়ে তোলা সম্ভব নয়। বাংলাদেশের জন্যও কথাটি সমান প্রযোজ্য।
তবে উদ্ভাবনী শক্তিতে অগ্রগামী মার্কিন ইতিহাসের একটি গ্লানিকর ও অন্ধকার অধ্যায় আছে। তা হলো দক্ষিণের নিষ্ঠুর ক্রীতদাস প্রথা। জন্মলগ্ন থেকেই এই প্রথা দক্ষিণের অঙ্গরাজ্যগুলোয় নাগরিকদের একাংশকে সৃজনশীলতা ও উদ্ভাবনের সুযোগ থেকে বঞ্চিত করেছে।
স্বাধীনতার চার বছরের মধ্যে, ১৭৮০ সালে উত্তরাঞ্চলের বেশির ভাগ রাজ্য দাসমুক্তি আইন প্রণয়ন করে। এতে পেনসিলভানিয়া, নিউইয়র্কসহ বেশির ভাগ উত্তরাঞ্চলের রাজ্যে কৃষ্ণাঙ্গদের স্বাধীনতা নিশ্চিত হয়। কিন্তু দক্ষিণের টেক্সাস, জর্জিয়া, ফ্লোরিডা ও আলাবামার মতো রাজ্যে কৃষ্ণাঙ্গরা আরও কয়েক যুগ ছিল অধিকারবঞ্চিত। শ্বেতাঙ্গদের হাতে নিত্য অত্যাচার, হত্যা, গুম হওয়ার আতঙ্ক, আর স্থায়ী সন্ত্রাসের শিকার হতে হয়েছে তাদের। অল্প কয়েকজন ভাগ্যবান কৃষ্ণাঙ্গই জীবনের ঝুঁকি নিয়ে উত্তরের রাজ্যগুলোয় পাড়ি জমাতে পেরেছিল।
ওপরে উল্লেখিত গবেষক দল ১৮৭০-১৯৪০ সালের কয়েক লাখ পেটেন্ট বিশ্লেষণ করেছিল। তা থেকে তারা প্রমাণ করেছে, আমেরিকার উত্তরের স্বাধীন ও মানবাধিকারসম্পন্ন অঙ্গরাজ্যগুলোর কৃষ্ণাঙ্গরা সেখানকার শ্বেতাঙ্গদের সমানতালে উদ্ভাবন করেছেন, পেটেন্ট নিয়েছেন। কৃষ্ণাঙ্গ উদ্ভাবকদের অনেকেই নতুন প্রযুক্তিনির্ভর ব্যবসা শুরু করে ধনী হয়েছেন, নাগরিকদের জন্য কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি করেছেন।
উত্তরের অঙ্গরাজ্যের বহু কৃষ্ণাঙ্গ তাদের কর্মদক্ষতা ও উদ্ভাবনী শক্তির জন্য জাতীয়ভাবে সম্মান ও পরিচিতি অর্জন করেছেন। দক্ষিণের দাসত্ব থেকে মুক্তি পাওয়া এক ক্রীতদাসের পুত্র লুইস ল্যাটিমার ছিলেন এডিসনের ঘনিষ্ঠ সহকর্মী এবং অনেক গুরুত্বপূর্ণ প্রযুক্তির উদ্ভাবক। উনিশ শতকের ধনী কৃষ্ণাঙ্গ নারী ম্যাডাম সি জে ওয়াকার কালো নারীদের জন্য সৌন্দর্যপণ্য উদ্ভাবন করে আমেরিকার প্রথম স্বনির্ভর নারী মিলিয়নিয়ারদের অন্যতম হিসেবে ইতিহাসে স্থান করে নেন।
শিল্প-বাণিজ্যের বাইরে ফ্রেডরিক ডগলাসের মতো অনেক বিশ্বমানের কৃষ্ণাঙ্গ লেখক, নেতা, শিল্পী ও চিন্তাবিদ উত্তরের রাজ্যগুলোকে আলোকিত করেছেন। অথচ দক্ষিণের অঙ্গরাজ্যগুলোর প্রায় সব কৃষ্ণাঙ্গ জনগোষ্ঠী দাসত্বের সংস্কৃতি আর জিম ক্রোর বর্ণবাদী আইনে পুরোপুরি নিষ্পেষিত ছিল। গবেষণাটি দেখিয়েছে যে যুক্তরাষ্ট্রের স্বর্ণযুগে উদ্ভাবনের চাকা আর অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির অংশ হওয়ার সুযোগ থেকে তারা পুরোপুরি বঞ্চিত ছিল। ২০১৯ সালে জোনাথন রথওয়েল তার ‘আ রিপাবলিক অব ইকুয়ালস বইতেও এর বিশদ বিবরণ দিয়েছেন।
দক্ষিণের শ্বেতাঙ্গরা বিশ্বের অন্যতম উদ্ভাবনী দেশের নাগরিক হিসেবে কি উত্তরের স্বাধীন নাগরিকদের মতোই সৃজনশীল ছিল? উত্তরটি হলো ‘না’। নিপীড়নমূলক সংস্কৃতির কারণে দক্ষিণের শ্বেতাঙ্গরা উত্তরাঞ্চলের মুক্ত ও মানবাধিকারসম্পন্ন নাগরিকদের তুলনায় তিন গুণ কম সৃজনশীলতা দেখিয়েছে। উদ্ভাবনী চিন্তাভাবনায় আগ্রহী অনেক শ্বেতাঙ্গ দক্ষিণের দাসত্বপূর্ণ এলাকা ছেড়ে উত্তরের স্বাধীন চিন্তা ও অধিকারের রাজ্যগুলোয় স্থায়ীভাবে চলে গিয়েছিল। সেখানে তারা নিজেদের সৃজনশীলতাকে আরও বেশি বিকশিত করতে পেরেছে।
নিকট অতীতে বাংলাদেশে দমন আর নির্যাতনমূলক পরিবেশ সত্ত্বেও পরিশ্রমী শ্রমিকেরা পোশাকশিল্পকে বিশ্বের প্রথম কাতারে তুলে এনেছেন, যেভাবে উদ্ভাবনের স্বর্ণযুগে নিপীড়নে নিমজ্জিত যুক্তরাষ্ট্রের দক্ষিণাঞ্চল তুলা ও তামাক উৎপাদনে বিশ্বে শীর্ষে উঠেছিল। অথচ একই সময়ে যুক্তরাষ্ট্রের উত্তরের স্বাধীন ও মানবাধিকারসম্পন্ন অঙ্গরাজ্যগুলো শিল্পবিপ্লবের নেতৃত্ব দিচ্ছিল সারা বিশ্বে। উদ্ভাবনের স্বর্ণযুগে যুক্তরাষ্ট্রের উত্তরের অঙ্গরাজ্যগুলোয় যেমন ছিল, বাংলাদেশের তরুণ প্রজন্মও তার মতোই স্বাধীনতা, মানবাধিকার ও বিশ্বমানের শিক্ষা ও দক্ষতার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ কর্মসংস্থান চায়।
যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠাতারা দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করতেন, ‘স্বাধীনতা বিজ্ঞান ও শিল্পের প্রসূতি।’ ১৭৯২ সালের মুদ্রায় এই মূলমন্ত্র খোদাই করা হয়েছিল, আর তাঁদের দীর্ঘ আর্থসামাজিক ইতিহাসের প্রতিটি বাঁকে সেই বিশ্বাসকেই তাঁরা প্রতিষ্ঠিত করেছেন। পরিপূর্ণ স্বাধীনতা ও মানবাধিকার ছাড়া বিশ্বের কোথাও প্রযুক্তিনির্ভর ও উদ্ভাবনী অর্থনীতি গড়ে তোলা সম্ভব নয়। বাংলাদেশের জন্যও কথাটি সমান প্রযোজ্য।
সাইফ ইসলাম ইউনিভার্সিটি অব ক্যালিফোর্নিয়া ডেভিসের তড়িৎ আর কম্পিউটার ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের অধ্যাপক