পশ্চিমা মিডিয়া এবং ইউক্রেনে সত্যের বিরুদ্ধে যুদ্ধ

কিয়েভে রুশ হামলায় বিধ্বস্ত একটি মার্কেট
ছবি: রয়টার্স

ইউক্রেনের যুদ্ধে কে কতটা জিতেছে সেটি নির্ভর করছে কে কতটা কথা বলতে পারছে তার ওপর। যেমনটা ধারণা করা হয়েছিল, ঠিক তেমনভাবেই রাশিয়া বলে যাচ্ছে, তারা তাদের ছক অনুযায়ীই জিতে যাচ্ছে। অন্যদিকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বলে চলেছে, ইউক্রেন তার অবিচল প্রতিরোধ এবং পশ্চিমা সমর্থনের বদৌলতে একটি আশ্চর্যজনক জয় পেয়েছে।

উদারপন্থী পশ্চিমারা বৃহত্তর বিশ্বাসযোগ্যতাকে অনুপ্রাণিত করে এবং তারা সংবাদের সত্যতা যাচাইয়ে একটি মুক্ত এবং স্বাধীন তদন্তের অনুমতি দেয়। কর্তৃত্ববাদী রাশিয়ায় এই সুযোগ নেই। ফলে সত্যভাষণের বিষয়ে রাশিয়াকে খুব বেশি বিশ্বাস করার সুযোগ কম।

তবে বাস্তবতা হলো, যুদ্ধে সরলতার কোনো সুযোগ নেই। চীনা সামরিক কৌশলবিদ সান জ্যু যেমনটা বলেছিলেন, ‘সব যুদ্ধই প্রতারণার ওপর ভিত্তি করে চলে।’ যুদ্ধের মধ্যে কোনো পক্ষই তাদের গোমর ফাঁস করে না; রহস্যময়তা উন্মোচন করে না। ফলে কোনো পক্ষকেই তাদের বক্তব্যের বিষয়ে বিশ্বাস করা যায় না বা করা উচিতও নয়। এর কারণ যুদ্ধ চলাকালে উভয় পক্ষই সামরিক যুদ্ধের পাশাপাশি মনস্তাত্ত্বিক যুদ্ধে নিয়োজিত থাকে।

যুদ্ধ যখন চলে তখন উভয় পক্ষই তাদের নিজস্ব বাছাই করা সত্য এবং মিথ প্রচার করে। যুদ্ধে রক্তক্ষয় বা সম্পদের দিক থেকে বড় ত্যাগের ন্যায্যতা দেওয়ার জন্য প্রত্যেকেই তাদের অগ্রগতিকে সামনে আনতে সর্বোচ্চ চেষ্টা চালিয়ে যায়।

রাশিয়ার আশা, প্রতিরোধের ক্ষেত্রে শিগগিরই ইউক্রনীয়দের মনোবল ভাঙতে শুরু করবে এবং এই যুদ্ধে ইউক্রেনের প্রতি সমর্থন জুগিয়ে যাওয়ার বিষয়ে ইউরোপীয়দের উৎসাহ কমে আসবে। অন্যদিকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ইউক্রেনীয় এবং ইউরোপীয়দের উৎসাহ বাড়াতে চায়। যদিও মার্কিন কর্মকর্তারা অপ্রকাশ্যে সন্দেহ প্রকাশ করেন, ইউক্রেন তার সমস্ত দখলকৃত ভূখণ্ড পুনরুদ্ধার করতে পারবে কিনা তা নিয়ে।

যদিও রুশ মিডিয়ার সরকারি ভাষ্যকে তোতাপাখির মতো প্রচার করে যাওয়া ছাড়া কোনো বিকল্প নেই। তাদের নিজেদের পছন্দ অপছন্দের কোনো ব্যাপার এখানে নেই। তবে পশ্চিমা মিডিয়ার পছন্দ করার স্বাধীনতা আছে যদিও তারা প্রায়শই ন্যাটো এবং পেন্টাগনের বিজ্ঞপ্তি এবং রিপোর্টে বিশ্বাস করা পছন্দ করে থাকে। উদাহরণস্বরূপ পেন্টাগনের নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক (কেন অনিচ্ছুক?) একজন জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তার ঘোষণা এমন: ‘রাশিয়া ইউক্রেনের যুদ্ধে তার প্রায় ৮৫ শতাংশ সামরিক শক্তি ব্যবহার করছে’; ‘তাদের সীমানার অন্যান্য এলাকা এবং সারা বিশ্ব থেকে সামরিক শক্তি সরিয়ে ইউক্রেনে জড়ো করছে’; ‘রাশিয়া এখনও বুঝতে পারেনি কীভাবে কার্যকরভাবে সম্মিলিত অস্ত্র ব্যবহার করা যায়’; রাশিয়া ‘প্রতিদিন শত শত প্রাণ কেড়ে নিচ্ছে’। রাশিয়ার নিহত সেনাদের মধ্যে ‘হাজার হাজার’ লেফটেন্যান্ট এবং ক্যাপ্টেন, ‘শত শত’ কর্নেল এবং ‘অনেক’ জেনারেল আছে।

এখন এই দাবি সত্য কিনা সে বিষয়ে আমার কাছে কোনো নিশ্চিত ধারণা নেই। এটি কর্মকর্তারা নাকি সাংবাদিকেরা ছড়াচ্ছে সে বিষয়েও আমরা জানতে পারছি না। কিন্তু এটি জনমত গঠনে ব্যাপক ভূমিকা রাখছে। এটি জনসাধারণ, অভিজাত শ্রেণি এবং বিশেষজ্ঞদের মতকে গঠন করছে; বিশেষ করে যারা বিশ্বাস করেন, ইউক্রেন তার বৃহত্তর শক্তিশালী প্রতিবেশীর বিরুদ্ধে সরাসরি বিজয় না পেলেও অন্তত একরকম বিপর্যস্ততা দূর করতে সক্ষম হবে, তাদের কাছে এসব ভাষ্য গুরুত্ব বহন করে । কিন্তু পশ্চিমা এবং বিশেষ করে অ্যাংলো-আমেরিকান মিডিয়া ভুলে গেছে আফগানিস্তান, ইরাক বা ভিয়েতনামের যুদ্ধের সময় পশ্চিমা সরকারি কর্মকর্তারা প্রতারণা করেছিল।
২০০৯ সালে ওয়াশিংটন পোস্ট পত্রিকা বলেছিল, মার্কিন কর্মকর্তারা আফগানিস্তানে যুদ্ধ সম্পর্কে ১৮ বছর ধরে সত্য বলতে ব্যর্থ হয়েছেন। পত্রিকাটির প্রতিবেদনে বলা হয়েছিল, এসব যুদ্ধ যে যুক্তরাষ্ট্রের জন্য অজেয় হয়ে উঠেছিল তা তারা গোপন করেছিল। অন্য কথায়, তারা মিথ্যা বলেছে। কিন্তু মিডিয়া আউটলেট, থিঙ্ক-ট্যাঙ্ক এবং প্রভাবশালী পণ্ডিতেরা এই ‘কর্মকর্তাদের’ ওপর নির্ভর করতে থাকে। এমনকি এটি প্রকাশিত হওয়ার পরেও যে তারা নতুন যুদ্ধ সম্পর্কেও মিথ্যা বলেছে। মিথ্যা, ভান এবং বানোয়াট প্রমাণের ভিত্তিতে ইরাকে লড়াই করা হয়েছিল—এটি শেষ পর্যন্ত প্রমাণিত হলেও এই মিথ্যাকে পশ্চিমা গণমাধ্যম যুদ্ধের অজুহাত হিসেবে প্রতিষ্ঠা করেছিল।
শীতল যুদ্ধের সময় অফিসিয়াল প্রতারণার মাত্রা আরও খারাপ ছিল। উদাহরণস্বরূপ, প্রায় অর্ধশতাব্দী আগে প্রকাশিত ‘পেন্টাগন পেপারস’ প্রকাশ করেছে—মার্কিন সরকার ভিয়েতনাম যুদ্ধে ৫৫ হাজার আমেরিকান এবং ১০ লাখের বেশি ভিয়েতনামি নাগরিকের প্রাণহানির মতো ভয়ানক ক্ষয়ক্ষতির একটি বিশাল চিত্র আড়াল করার জন্য দোষী ছিল।

এমনকি আজও যুক্তরাষ্ট্রের স্পেশাল অপারেশন কমান্ড গোপনে আফ্রিকাজুড়ে বিশেষ বাহিনী মোতায়েন করে ‘ছায়া যুদ্ধ’ চালাচ্ছে। সেই তারাই স্পষ্টভাবে ‘মুক্ত এবং স্বচ্ছ গণমাধ্যমের’ প্রচার করে। এটি শুনে হাসব নাকি কাঁদব বুঝতে পারছি না।
সুতরাং এটা কোনো আশ্চর্যের কিছু নয় যে সরকার (সে স্বৈরাচারী বা গণতন্ত্র—যে সরকারই হোক), কৌশলগত কারণে যুদ্ধ সম্পর্কে মিথ্যা বলে। প্রকৃতপক্ষে, এর একটি অভিনব নাম রয়েছে—স্ট্র্যাটেজেম, যার অর্থ নিজের পক্ষকে আশ্বস্ত করার এবং শত্রুকে অস্থির করার জন্য ইচ্ছাকৃতভাবে অসত্য বার্তা পাঠানো।
অবাক করার মতো বিষয় হলো অতীতে ‘পেন্টাগন পেপারস’ এবং ‘আফগান পেপারসে’ সরকারি প্রতারণা ফাঁস হওয়ার পরও বিশ্বের মুক্ত গণমাধ্যম পশ্চিমা কর্মকর্তাদের কথার প্রতিধ্বনি করার বিষয়ে অনড়। তারা যেন পশ্চিমাদের অফিশিয়াল লাইনকে প্রসারিত করতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ।

সম্মানিত আমেরিকান এবং ব্রিটিশ সাংবাদিকেরা রাশিয়ার পুতিনকে বর্ণনা করার জন্য ফ্যাসিবাদী, মন্দ এবং বিপজ্জনক শব্দের সমার্থক শব্দগুলোকে ব্যবহার করছেন। তাদের এই দ্বিমুখী নীতির কারণে প্রকৃত চিত্র থেকে বিশ্ব বঞ্চিত হচ্ছে।

আল জাজিরা থেকে নেওয়া। ইংরেজি থেকে অনুবাদ: সরফুদ্দিন আহমেদ

  • মারওয়ান বিশারা বৈশ্বিক রাজনীতি বিষয়ক লেখক।