মতামত

ই-কমার্স খাতের বিকাশে যে কারণে সহায়ক নীতিমালা দরকার

কানাডাভিত্তিক সংবাদ প্রতিষ্ঠান ভিজ্যুয়াল ক্যাপিটালিস্ট আইএমএফের (আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল) তথ্যের আলোকে করা এক জরিপে মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) আকারে বাংলাদেশ বিশ্বের ৪১তম বৃহৎ অর্থনীতির দেশের স্বীকৃতি পেয়েছে। সম্প্রতি পরিচালিত এ জরিপে বাংলাদেশের জিডিপির আকার ৩৯৭ বিলিয়ন বা ৩৯ হাজার ৭০০ কোটি ডলার। দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশ এখন দ্বিতীয় অবস্থানে। অর্থনীতির এ সমৃদ্ধি অর্জনে বাংলাদেশের যেসব খাত ইতিবাচক ভূমিকা রেখেছে, তার মধ্যে ই-কমার্স অন্যতম।

বাংলাদেশ ব্যাংক ও ই-ক্যাবের তথ্য পর্যালোচনায় দেখা গেছে, গত ৩ বছরে গড়ে ৩০ শতাংশের বেশি প্রবৃদ্ধি ধরে রেখেছে ই-কমার্স খাত। স্থানীয় বাজারের বর্তমান আকার প্রায় ৯ হাজার কোটি টাকা, যা ২০২৫ সাল নাগাদ ২৪ হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়ে যাবে বলে আশা করছেন এ খাত–সংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ীরা। জানা গেছে, বর্তমানে দেশে আড়াই হাজার ই-কমার্স সাইট আছে। ই-কমার্স আয়ের দিক থেকে বিশ্বে বাংলাদেশের অবস্থান বর্তমানে ৪৬তম। বিভিন্ন ই-কমার্স সাইট থেকে চলতি বছরের মার্চ মাসে ক্রেডিট কার্ডে কেনাকাটা হয়েছে প্রায় ৯০৮ কোটি টাকার পণ্য। এ পরিসংখ্যানগুলোই বলে দিচ্ছে, বাংলাদেশের ই-কমার্স খাত অপ্রতিরোধ্য অগ্রযাত্রায় সামনে এগিয়ে যাচ্ছে এবং দেশের অর্থনীতিকে সুদৃঢ় করতে এ খাতটি কতটা জোরালো ভূমিকা রাখছে।

বাংলাদেশে ই-কমার্স খাতের যাত্রা ১০-১১ বছরের হলেও ই-কমার্স খাত গতি পেতে শুরু করে ২০১৩ সাল থেকে। তবে এই খাতের সবচেয়ে বেশি প্রসার ও প্রচার ঘটে ২০২০ সালে। সময়ের হিসাবে ও পারিপার্শ্বিক দিক বিবেচনায় এ খাতটিকে বিকাশমান খাতই বলা যায়। গত বছর খুব অল্প সময়ে দ্রুত জনপ্রিয় হওয়া কয়েকটি ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে শত শত কোটি টাকা আত্মসাৎসহ গ্রাহক ও মার্চেন্টদের সঙ্গে প্রতারণার অভিযোগ ওঠে। বিভিন্ন ধরনের অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা সম্ভাবনাময় এ খাতের প্রবৃদ্ধিতে আস্থার সংকট তৈরি করে। এ পরিস্থিতিতে দেশের ই-কমার্স খাতে আস্থার জায়গা ধরে রাখতে ডিজিটাল কমার্স পরিচালনায় নীতিমালা ও নির্দেশিকা জারি করে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। তবে নীতিমালা ভঙ্গ করলে অভিযুক্ত ব্যক্তির বিরুদ্ধে শুধু প্রশাসনিক ব্যবস্থা গ্রহণ করা যায়। যেমন কোম্পানির নিবন্ধন বাতিল করা। কিন্তু নীতিমালা ভঙ্গ করলে দায়ী ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক কোনো ব্যবস্থা রাখার বিধান এ নীতিমালায় রাখা হয়নি। এমন অবস্থায় ই-কমার্সে স্বচ্ছতা নিশ্চিত করতে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা নীতিমালার আলোকে শিগগিরই আইন প্রণয়ন করার কথা জানিয়েছেন, যা ই-কমার্স খাত বিকাশে সহায়ক ভূমিকা রাখবে।

বর্তমানে দেশে বিদেশি বিনিয়োগে ই-কমার্স খাতের অবদান ২ শতাংশ হলেও এ ক্ষেত্রে ভবিষ্যৎ বেশ সম্ভাবনায়। তবে এখনই যদি এই খাতকে ভ্যাট ও ট্যাক্স দিয়ে নিয়ন্ত্রণ করা হয়, তাহলে বিদেশি বিনিয়োগ আসার ক্ষেত্রে বাধা তৈরি হবে, পরিণতিতে ই-কমার্স খাতের প্রতিষ্ঠানগুলোর ব্যবসা চালিয়ে যাওয়া কষ্টসাধ্য হয়ে পড়বে। আর যদি বিদেশি বিনিয়োগ আশানুরূপ হয়, তাহলে আমরা আগামী দুই থেকে তিন বছরের মধ্যে বৈশ্বিক মানদণ্ডে পৌঁছাতে পারব।

বাংলাদেশের ই-কমার্স খাতের প্রবৃদ্ধি চলমান রাখতে ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানগুলো সর্বাত্মক প্রচেষ্টা গ্রহণ করে চলেছে। সবারই লক্ষ্য এ খাতের সম্ভাবনার পূর্ণ বিকাশের মাধ্যমে দেশের বিকাশমান অর্থনীতিকে শক্তিশালী করা। দারাজ বাংলাদেশ যেমন দেশের গ্রাহকদের জন্য উদ্ভাবনী নানা সেবা নিয়ে আসছে। প্রতিষ্ঠানটির বছরপ্রতি পণ্য বিক্রির প্রবৃদ্ধির হার হচ্ছে ৮৩ শতাংশ। ২০১৮ সালে দক্ষিণ এশিয়ায় আলিবাবার সম্প্রসারণের অংশ হিসেবে আলিবাবা গ্রুপের সম্পূর্ণ মালিকানাধীন সহযোগী প্রতিষ্ঠান হিসেবে দারাজ বাংলাদেশকে অধিগ্রহণ করে, যার মাধ্যমে দেশে প্রত্যক্ষ বিদেশি বিনিয়োগের পথ সুগম হয়। এখন পর্যন্ত বিদেশি বিনিয়োগ হিসেবে বাংলাদেশে ১ হাজার ১০০ কোটি টাকা এসেছে, যা দেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির ক্ষেত্রে ইতিবাচক ভূমিকা রাখছে এবং দেশে ই-কমার্স ইকোসিস্টেম তৈরিতেও কাজ করছে। তবে এ প্রবৃদ্ধিকে ত্বরান্বিত করতে এ খাতের জন্য ভ্যাট এবং কর নীতির ক্ষেত্রে বেশ কিছু পরিবর্তন নিয়ে আসতে হবে বলে এ খাতসংশ্লিষ্ট অনেক অংশীজন মনে করেন।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দেশে ই-জব–সংশ্লিষ্ট খাতের ওপর বেশ জোর দিতে বলেছেন এবং বিদেশি বিনিয়োগবান্ধব পরিবেশ তৈরির ওপর আলোকপাত করেছেন। কিন্তু লক্ষণীয় ব্যাপার হচ্ছে, ভ্যাট ও ট্যাক্স পলিসি নির্ধারণে বিদেশি বিনিয়োগবান্ধব পরিবেশ তৈরির ব্যাপারে যথাযথ গুরুত্ব প্রদান করা হয় না। বর্তমানে দেশে বিদেশি বিনিয়োগে ই-কমার্স খাতের অবদান ২ শতাংশ হলেও এ ক্ষেত্রে ভবিষ্যৎ বেশ সম্ভাবনায়। তবে এখনই যদি এই খাতকে ভ্যাট ও ট্যাক্স দিয়ে নিয়ন্ত্রণ করা হয়, তাহলে বিদেশি বিনিয়োগ আসার ক্ষেত্রে বাধা তৈরি হবে, পরিণতিতে ই-কমার্স খাতের প্রতিষ্ঠানগুলোর ব্যবসা চালিয়ে যাওয়া কষ্টসাধ্য হয়ে পড়বে। আর যদি বিদেশি বিনিয়োগ আশানুরূপ হয়, তাহলে আমরা আগামী দুই থেকে তিন বছরের মধ্যে বৈশ্বিক মানদণ্ডে পৌঁছাতে পারব।

অন্যদিকে অনলাইন মার্কেটপ্লেসের জন্য আলাদা সংজ্ঞা থাকা বেশ জরুরি বলে আমি মনে করি। বর্তমান ভ্যাট আইনে অনলাইন পণ্য বিক্রির সংজ্ঞায় শুধু রিটেইল ক্রয়–বিক্রয়কে সংজ্ঞায়িত করা হয়েছে যেখানে মার্কেটপ্লেসের সংজ্ঞাও সংযোজন করা প্রয়োজন, যা আইনি ও ভ্যাট প্রেক্ষাপটে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ডিজিটাল কমার্স পরিচালনা নির্দেশিকা ২০২১–এ মার্কেটপ্লেসের সংজ্ঞা হিসেবে বলা হয়েছে, অনলাইন মার্কেটপ্লেস এমন মডেল, যা ক্রেতা এবং বিক্রেতাকে অনলাইন প্ল্যাটফর্ম ও লজিস্টিক সহায়তা প্রদান করার মাধ্যমে একটি সেতুবন্ধ তৈরি করে। এর ফলে ক্রেতা সরাসরি বিক্রেতার এনলিস্ট করা পণ্য থেকে বেছে নিজের পছন্দের পণ্য বা সেবা কিনতে পারেন এবং প্ল্যাটফর্ম প্রোভাইডার এই পণ্য ক্রেতার কাছে পৌঁছে দেন এবং বিক্রেতার পক্ষে পণ্যমূল্য সংগ্রহ করেন। অতএব, যথার্থ শ্রেণীকরণ ছাড়া অনলাইন মার্কেটপ্লেস ক্রমাগতভাবে কার্যকর অসুবিধা ও বাধার সম্মুখীন হবে কারণ, তাদের কার্যক্রম রিটেইলার হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে।

২০২২-২৩ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটে ই-কমার্স খাতটিকে গুরুত্বের মধ্যে আনা হয়নি। তবে ২০২২-২৩ অর্থবছরের জন্য প্রকাশিত ফাইন্যান্স বিলে দেখা গেছে, স্টার্টআপ কোম্পানিগুলো বিজনেস সাসটেইনেবিলিটি ইস্যু যেমন লস ক্যারি ফরওয়ার্ড (৯ বছর) এবং ন্যূনতম ট্যাক্স (০.১%) এর ক্ষেত্রে অনুকূল প্রণোদনা পেয়েছে। উদ্যোক্তা বিকাশের স্বার্থে নীতিনির্ধারকদের এই দৃষ্টিভঙ্গি প্রশংসার দাবিদার। স্টার্টআপের জন্য ব্যাপক বিদেশি বিনিয়োগের প্রয়োজন। তা ছাড়া ডিজিটাল ইকোসিস্টেমে স্টার্টআপ একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ। তাই শুধু বৃহত্তর খাতের একটি অংশকে উৎসাহিত করার বিষয়টি কাঙ্ক্ষিত প্রবৃদ্ধি আনতে পারে না; তাই সামগ্রিকভাবে ই-কমার্স শিল্পকেও বিভিন্ন প্রণোদনার মাধ্যমে উৎসাহিত করা উচিত। এ খাতের প্রতিষ্ঠানগুলো দীর্ঘদিন ধরে এই সেক্টরে প্রচুর বিনিয়োগ করে আসছে এবং এখনো লোকসানে রয়েছে; তাই এই খাতকে আগামী দিনে বিশেষ বিবেচনায় রাখতে কর্তৃপক্ষের কাছে অনুরোধ থাকবে। এতে তারা কর্মসংস্থান তৈরি ও সরকারের কোষাগারে বড় অঙ্কের রাজস্ব দিতে পারবে।
বাংলাদেশকে একটি জ্ঞানভিত্তিক অর্থনীতি এবং উদ্ভাবনী জাতি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে স্মার্ট বাংলাদেশ ২০৪১–এর লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছে বাংলাদেশ সরকার। এ ক্ষেত্রে ই-কমার্স খাতের প্রতিষ্ঠানগুলোর অপরিসীম ভূমিকা রয়েছে। ২০২১ সালের মধ্যে ডিজিটাল বাংলাদেশের স্বপ্ন বাস্তবায়নে ই-কমার্স খাতের প্রতিষ্ঠানগুলোরও অনেক অবদান ছিল। তাই দেশকে সামনে এগিয়ে নিতে হলে এ খাতের বিকাশে সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে। এ ক্ষেত্রে অনলাইন মার্কেটপ্লেসের প্রবৃদ্ধিতে সহায়ক নীতিমালা প্রণয়ন করা জরুরি বলে আমি মনে করি।

  • সৌরভ ইসলাম প্রতিষ্ঠাতা ও প্রধান নির্বাহী, ফারমার্স মার্কেট এশিয়া