বাঙালির বড় কপাল। ফি বছরে তারা দুইবার নববর্ষ পায়। পয়লা বৈশাখে ‘এসো হে বৈশাখ’ আর পয়লা জানুয়ারিতে ‘হ্যাপি নিউ ইয়ার’।
আদতে বাঙাল-ঘরের খ্রিষ্টীয় নববর্ষ উদ্যাপনে বাঙালিয়ানার মিশেল আছে। তাই এই উদ্যাপন এখনো ঠিক ‘সায়েবি’ হয়ে ওঠেনি।
নিউ ইয়ারে মাই ডিয়ার টাইপের বন্ধু-ইয়ার নিয়ে বিয়ারে বুঁদ হওয়া পশ্চিমের পুরোনো রেওয়াজ। সেই ব্রিটিশ আমলে আমাদের এই অঞ্চলে সাদা সাহেবরা একত্রিংশ রজনী ওরফে থার্টি ফাস্ট নাইটে নাচগানের পার্টিতে মিলিত হতেন। তাঁদের সঙ্গে বাঙালি ‘এলিট’ নরনারীও জুড়তেন।
ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্ত তাঁর ‘ইংরাজি নববর্ষ’ কবিতায় সেই রকমের একটি থার্টি ফার্স্ট নাইট পার্টির বর্ণনা দিয়েছেন: ‘নববর্ষ মহাহর্ষ ইংরাজটোলায়/ দেখে আসি ওরে মন, আয় আয় আয়/ সাহেবের ঘরে ঘরে কারিগুরি নানা।/ ধরিয়াছে টেবিলেতে অপরূপ খানা/ বেরিবেষ্ট সেরিটেষ্ট মেরিরেষ্ট যাতে/ আগে ভাগে দেন গিয়া শ্রীমতীর হাতে।’
সেই পার্টিতে বাঙালি পুরুষদের পাশাপাশি বাঙালি নারীদের অংশগ্রহণ নিয়ে তিনি ফুট কেটেছেন: ‘শাড়ী পরা এলোচুল আমাদের মেম/ বেলাক নেটিভ লেডি সেম্, সেম্, সেম্.../ হিপ হিপ হুররে ডাকে হোল ক্লাস/ ডিয়ার ম্যাডাম ইউ টেক দিস গ্লাস/ সুখের সখে খানা হলে সমাধান/ তারা রারা রারা সুমধুর গান।...শেরি চেরি বীর ব্রান্ডি ওই দেখ ভরা/ এক বিন্দু পেটে গেলে ধরা দেখি সরা।’
রবীন্দ্রনাথ ঋষি মানুষ। তিনি পয়লা বৈশাখের সুবহে সাদিকে লিখেছিলেন, ‘নিশি অবসানপ্রায়, ওই পুরাতন বর্ষ হয় গত!.../ ক্ষমা করো আজিকার মতো/ পুরাতন বরষের সাথে/ পুরাতন অপরাধ যত।’
খ্রিষ্টীয় নববর্ষকেও রবি ঠাকুর ঋষিসুলভ চোখে দেখেছেন। ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্তের মতো মৌজমাস্তির বর্ণনায় তিনি যাননি। ইংরেজিতে লেখা ‘দ্য নিউ ইয়ার’ কবিতায় নতুন বছরকে উতল হাওয়ার ঝাপটায় বৃন্তচ্যুত ফলের সঙ্গে তুলনা করে রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন, ‘লাইক ফ্রুট, শেকন ফ্রি বাই অ্যান ইমপেশেন্ট উইন্ড/ ফ্রম দ্য ভেল অব ইটস মাদার ফ্লাওয়ার,/ দাউ কামস্ট, নিউ ইয়ার।’
দিন বদলেছে। এই সময়ের নাগরিক পরিসরে, বিশেষ করে ঢাকাসহ বড় বড় শহরে খ্রিষ্টীয় নববর্ষের ব্যবহারিক সংজ্ঞা ভিন্ন। হাসপাতাল চত্বরে পর্যন্ত বাজি-পটকার ঠুসঠাস, মহল্লার মোড়ে মোড়ে ধুমধাড়াক্কা মিউজিক, বাইক নিয়ে ভোঁ ভোঁ শব্দে এক শ কিলোমিটার গতিতে দশ-বারোজনের উদ্দাম রেস, ছাদে ছাদে ‘ধুম্মা চালে ধুম্মা চালে ধুম’—এসবই এখানকার নিউ ইয়ারের পিয়ারের অনুষঙ্গ।
সামনের বছর কেমন যাবে, আমরা জানি না। ভোটপরবর্তী জোটনিরপেক্ষ বাংলাদেশ কত দূর এগোবে; মরিচের কেজি আগের বছরের মতো এক হাজার টাকায় উঠবে কি না; ট্রেনের টিকিট কালোবাজারির মতো স্কুল-কলেজের পরীক্ষার প্রশ্নপত্র কালোবাজারে বিক্রি হবে কি না; আগের বছরের মতো টাকা পাচার হবে কি না—আমরা জানি না। এসব শঙ্কা আছে। ভালো কিছুর সম্ভাবনাও আছে।
এখানে ফি বছর পটকা-বাজি ফুটানোয় পুলিশের যত মানা আসে, তত বেশি বাজি-বোমাবাজির শব্দে নতুন বছরকে ‘বুকে আয় ভাই’ বলে স্বাগত জানায়। এখানে খ্রিষ্টীয় বর্ষের একত্রিংশ রজনীর বাস্তবিক ব্যবহারিক সংজ্ঞা হলো: ‘যে দিবাগত মধ্য রজনীতে বোমাসদৃশ কালীপটকার ব্রহ্মাণ্ডবিদারী নিনাদ ও অযুত আতশবাজির উল্লাসমুখর আলোকোজ্জ্বল আয়োজনে সদ্যাগত খ্রিষ্টীয় বর্ষকে “হ্যাপি নিউ ইয়ার” ওঙ্কারধ্বনি সহযোগে স্বাগত জানানো হয়, উহাকে থার্টি ফার্স্ট নাইট বলা হইয়া থাকে।’
এসব দেখে এখানকার খ্রিষ্টীয় নববর্ষ উদ্যাপনকে না ‘সাহেবি উৎসব’ বলার জো আছে, না তাকে বাঙালির উৎসব বলা যায়। কিছুটা বিলিতিয়ানা আর কিছুটা বাঙালিয়ানার মিশেলে আমাদের একটি নিজস্ব ঘরানার দো-আঁশলা কায়দায় আমরা নতুন বছরকে বরণ করি।
প্রত্যন্ত গ্রামগঞ্জের তরুণ বয়সীদের অনেকে ‘থার্টি ফার্স্ট নাইট’ কথাটার আক্ষরিক বাংলা মানে না জানলেও জিনিসটা যে কী, তা ভালোই বোঝে।
রাত ১২টা ১ মিনিট হলেই পরস্পরের মধ্যে ‘হ্যাপি নিউ ইয়ার’ বলাবলি শুরু হয়। ফেসবুকের পাতা কিংবা টুইটার হ্যান্ডেলে ‘হ্যাপি নিউ ইয়ার’খচিত ডিজিটাল স্টিকার সেঁটে দেওয়া হয়। টাইপ করে ভুলভাল বানানে লেখার ঝক্কি এড়াতে মেসেঞ্জার, হোয়াটসঅ্যাপে ‘হ্যাপি নিউ ইয়ার’ সংলাপধারী ভার্চ্যুয়াল কার্ড চালাচালি হয়।
তার মানে, এত হইহুল্লোড় ও পটকাবাজির বাইরেও নতুন বছর হাসিখুশিতে কাটানোর একটা প্রত্যাশা ‘হ্যাপি নিউ ইয়ার’-এর মধ্যে গাঢ়ভাবেই মেশানো থাকে। একটা সর্বজনীন শুভ-ইচ্ছার দ্যোতনা তাতে মেশানো থাকে।
সামনের বছর কেমন যাবে, আমরা জানি না। ভোটপরবর্তী জোটনিরপেক্ষ বাংলাদেশ কত দূর এগোবে; মরিচের কেজি আগের বছরের মতো এক হাজার টাকায় উঠবে কি না; ট্রেনের টিকিট কালোবাজারির মতো স্কুল-কলেজের পরীক্ষার প্রশ্নপত্র কালোবাজারে বিক্রি হবে কি না; আগের বছরের মতো টাকা পাচার হবে কি না—আমরা জানি না। এসব শঙ্কা আছে। ভালো কিছুর সম্ভাবনাও আছে।
নতুন বছরে আমরা সেই শঙ্কা আর সম্ভাবনার দোলাচলে। এর মধ্যেই বলছি, ‘পরানের দোস্ত ইয়ার, হ্যাপি নিউ ইয়ার’।
সারফুদ্দিন আহমেদ: প্রথম আলোর সহকারী সম্পাদক