গত এপ্রিল মাসের ঘটনা। সোনায় মোড়ানো জিলাপি বিক্রির বিজ্ঞপ্তি দিয়েছিল রাজধানীর একটি পাঁচ তারকা হোটেল। ২৪ ক্যারেটের খাওয়ার উপযোগী সোনায় মোড়ানো ২০ হাজার টাকা কেজি দরের সেই জিলাপি এত দ্রুত বিক্রি হয়ে যায় যে জিলাপি বানানোর জন্য যে পরিমাণ খাওয়ার যোগ্য সোনা হোটেলটি আমদানি করেছিল, তা সাত দিনের মধ্যে শেষ হয়ে যায়, ফলে তারা অর্ডার নেওয়া বন্ধ করে দিতে বাধ্য হয়।
এর আগে ২০২২ সালের জুলাই মাসে রাজধানীর আরেকটি পাঁচ তারকা হোটেলে লাখ টাকায় সোনায় মোড়ানো আইসক্রিম বিক্রির ক্ষেত্রেও একই ধরনের ঘটনা ঘটেছিল। সোনায় মোড়ানো লাখ টাকার আইসক্রিম বিক্রির বিজ্ঞাপন দেওয়ার ২৪ ঘণ্টার মধ্যে এত বেশি ফরমাশ আসে যে নতুন ফরমাশ নেওয়া বন্ধ করতে হয়।
অন্যদিকে ২০২৩ সালের মার্চ মাসে নিম্ন আয়ের মানুষের ওপর বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সানেমের এক জরিপ থেকে দেখা যায়, মূল্যস্ফীতির চাপে বেশির ভাগ মানুষ খাবার খাওয়া কমাতে বাধ্য হয়েছে। ৯৬ দশমিক ৪ শতাংশ পরিবার ছয় মাস আগের তুলনায় তাদের মাংস খাওয়া কমিয়েছে। মাছ খাওয়ার পরিমাণ কমিয়েছে ৮৮ দশমিক ২ শতাংশ পরিবার, তেল খাওয়ার পরিমাণ ৮১ দশমিক ৪ শতাংশ, ডিম খাওয়ার পরিমাণ ৭৭ দশমিক ১ শতাংশ এবং চাল খাওয়ার পরিমাণ কমিয়েছে ৩৭ দশমিক ১ শতাংশ পরিবার।
অর্থনৈতিক সংকটে যখন তুলনামূলক কম দামে চাল, ডাল, তেল, চিনি কেনার জন্য টিসিবি আর ওএমএসের লাইন দীর্ঘ হচ্ছে, যখন ব্রয়লার মুরগির উচ্চমূল্যের কারণে নিম্ন আয়ের মানুষ কর্তৃক মুরগির ফাটা ডিম আর গিলা-কলিজা কেনার খবর প্রকাশিত হয়েছে, তখনো দেশে বিলাসবহুল গাড়ি কিংবা ফ্ল্যাট বিক্রি বাড়ছে। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের জেরে রড, সিমেন্টসহ সব ধরনের নির্মাণসামগ্রীর দাম বাড়ায় রাজধানীতে কম দামের ফ্ল্যাটের চাহিদা কমলেও গুলশান, বনানী, বারিধারা, ধানমন্ডি ও উত্তরার মতো অভিজাত এলাকাগুলোয় কোটি টাকার বেশি দামের ফ্ল্যাটের বিক্রি কমেনি। ঢাকা-চট্টগ্রাম শহরের রাস্তায় এখন অহরহ চোখে পড়ে মার্সিডিজ, বিএমডব্লিউ, রেঞ্জরোভার ও অডির মতো ইউরোপীয় ব্র্যান্ডের দামি বিলাসবহুল গাড়ি।
প্রথম আলোর সংবাদ অনুসারে, দুই দশক আগে বছরে ইউরোপীয় ব্র্যান্ডের গাড়ি আমদানি হতো বড়জোর ৫০-৬০টি। এখন বছরে এ ধরনের গাড়ি আমদানি হচ্ছে গড়ে ৫০০টির বেশি। আবার অভিজাত গাড়ি হিসেবে পরিচিত স্পোর্টস ইউটিলিটি ভেহিক্যাল বা এসইউভির মতো দামি গাড়ির বাজারও বড় হচ্ছে। বিআরটিএর বরাত দিয়ে প্রথম আলোয় প্রকাশিত তথ্য অনুযায়ী, দেশে মার্চ ২০২৩ পর্যন্ত মোট ৮৪ হাজার ৭৬৫টি এসইউভি নিবন্ধন দেওয়া হয়েছে, যার ৬৭ শতাংশই নিবন্ধিত হয়েছে ২০১১ সালের পর। এসইউভি নিবন্ধন সবচেয়ে বেশি বেড়েছে গত সাত বছরে। ২০২২ সালের ডলার-সংকটের মধ্যেই দেশে এক বছরে সর্বোচ্চ ১০ হাজার ২৪০টি এসইউভি নিবন্ধিত হয়েছে।
দেশে অর্থনৈতিক বৈষম্য বৃদ্ধির বিষয়টি বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) খানার আয় ও ব্যয় জরিপ ২০২২-এও উঠে এসেছে। বিবিএসের তথ্য অনুযায়ী, আয়বিষয়ক গিনি সহগ ২০১০ সালে ছিল দশমিক ৪৫৮, যা ধারাবাহিকভাবে বাড়তে বাড়তে ২০১৬ সালে দশমিক ৪৮২ এবং সর্বশেষ ২০২২ সালে দাঁড়িয়েছে দশমিক ৪৯৯। সাধারণত দশমিক ৫০০ হলেই একটি দেশকে উচ্চ আয়বৈষম্যের দেশ হিসেবে বিবেচনা করা হয়। এ হিসাবে বাংলাদেশ উচ্চ আয়বৈষম্যের দেশে পরিণত হয়েছে বলা যেতে পারে।
ক্রেডিট সুইস রিসার্চ ইনস্টিটিউটের বরাতে বণিক বার্তা জানাচ্ছে, দেশে ৫০ কোটি ডলার বা ৫ হাজার কোটি টাকার বেশি পরিমাণের সম্পদ আছে ২১ ব্যক্তির কাছে। করোনা মহামারির মধ্যেও ২০২১ সালে দেশে ১০ কোটি টাকার বেশি সম্পদ আছে, এমন ব্যক্তির সংখ্যা বেড়েছে প্রায় ৪৩ শতাংশ। ওই বছরের শেষে দেশে ১ মিলিয়ন ডলার (বর্তমান বিনিময় হার অনুযায়ী ১০ কোটি ৭০ লাখ টাকার সমপরিমাণ) বা এর বেশি মূল্যমানের সম্পদের মালিক ছিল ৩০ হাজার ৫৫৯ জন।
কোটি মানুষকে বঞ্চিত করে কয়েক হাজার মানুষের অর্থনৈতিক উন্নয়নের এই প্রবণতাটি বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিসংখ্যান থেকেও বোঝা যায়। অর্থনৈতিক সংকট ও ব্যাপক মূল্যস্ফীতির মধ্যে যখন দেশের বেশির ভাগ মানুষ দৈনন্দিন ব্যয় মেটাতে হিমশিম খাচ্ছে, অনেকেই খাওয়া কমিয়ে দিতে বাধ্য হয়েছে, তখনো দেশে কোটিপতি হিসাবধারীর সংখ্যা বেড়ে চলেছে। গত এক বছরে এ সংখ্যা বেড়েছে ৭ হাজার ৯৭০।
বাংলাদেশে এমন একটি অর্থনৈতিক ব্যবস্থা গড়ে উঠেছে, যেখানে জনগণের কাছ থেকে সংগৃহীত অর্থ কারখানার মালিক ও ব্যবসায়ীদের জন্য বিভিন্ন ধরনের অবকাঠামো ও প্রাতিষ্ঠানিক ব্যবস্থা গড়ে তোলার কাজে ঠিকই ব্যয় করা হয়, কিন্তু তার বিনিময়ে কারখানামালিক ও ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে যথাযথ কর (প্রত্যক্ষ কর) আহরণ করা হয় না।
২০২২ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত ১ কোটি টাকার বেশি আমানত রয়েছে—এমন ব্যাংক হিসাবের সংখ্যা ১ লাখ ৯ হাজার ৯৪৬। এসব হিসাবে জমা আছে ৬ লাখ ৭৭ হাজার ৬০৫ কোটি টাকা, যা ব্যাংকিং খাতের মোট আমানতের ৪২ দশমিক ৬৭ শতাংশ। ২০২০ ও ২০১৯ সালে কোটি হিসাবের সংখ্যা ছিল যথাক্রমে ৯৩ হাজার ৮৯০ এবং ৮৩ হাজার ৮৩৯। সেই হিসাবে তিন বছরে কোটি হিসাবধারী বেড়েছে ২৬ হাজার ১০৭টি।
সরকারের নীতিনির্ধারকেরা এই বৈষম্য বৃদ্ধিকে অর্থনৈতিক উন্নয়নের ‘স্বাভাবিক’ প্রক্রিয়া হিসেবে দেখাতে চান। কিন্তু বাংলাদেশে বৈষম্য বৃদ্ধির কারণ প্রাকৃতিক বা অবশ্যম্ভাবী নয়, বিশেষ ধরনের রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক কাঠামোর কারণেই তা ঘটছে। এই রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক কাঠামোর বৈশিষ্ট্য হলো বৈষম্যমূলক করব্যবস্থা, অতি নিম্ন মজুরি এবং নানা অনিয়ম ও দুর্নীতির সুযোগ।
কারখানা মালিক ও ব্যবসায়ীদের কলকারখানায় উৎপাদন ও ব্যবসা-বাণিজ্য পরিচালনার জন্য বিভিন্ন ধরনের অবকাঠামো ও প্রাতিষ্ঠানিক সুবিধার প্রয়োজন, যার মধ্যে রয়েছে রাস্তাঘাট, পরিবহন, বিদ্যুৎ ও জ্বালানি, কাঁচামাল, দক্ষ মানবসম্পদ, চিকিৎসা, আইনশৃঙ্খলা রক্ষা ইত্যাদি। জনগণের করের অর্থ ব্যয় করেই এই অবকাঠামো ও প্রাতিষ্ঠানিক সুবিধাগুলোর জোগান নিশ্চিত করা হয়।
ব্যবসায়ীদের দায়িত্ব হলো শ্রমিকদের বাঁচার মতো মজুরি প্রদান এবং অর্জিত আয় থেকে সরকারকে কর দেওয়া, যেন সেই করের অর্থ বিভিন্ন ধরনের অবকাঠামো ও প্রাতিষ্ঠানিক ব্যবস্থাপনার কাজে ব্যয় করা যায়, শিক্ষা, চিকিৎসা কৃষি ইত্যাদিতে বিনিয়োগের মাধ্যমে জনগণের অর্থ জনগণের কাজে লাগানো যায়। এ কাজগুলো ঠিকমতো করা না হলে জাতীয় আয়ে ধনীদের তুলনায় সর্বজনের ভাগ কমে, সম্পদ সর্বজনের কাছ থেকে ধনীদের কাছে স্থানান্তরিত হয় অর্থাৎ বৈষম্য বৃদ্ধি পায়। বাংলাদেশে ঠিক এ ঘটনাই ঘটছে।
বাংলাদেশে এমন একটি অর্থনৈতিক ব্যবস্থা গড়ে উঠেছে, যেখানে জনগণের কাছ থেকে সংগৃহীত অর্থ কারখানার মালিক ও ব্যবসায়ীদের জন্য বিভিন্ন ধরনের অবকাঠামো ও প্রাতিষ্ঠানিক ব্যবস্থা গড়ে তোলার কাজে ঠিকই ব্যয় করা হয়, কিন্তু তার বিনিময়ে কারখানামালিক ও ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে যথাযথ কর (প্রত্যক্ষ কর) আহরণ করা হয় না। মালিক ও ব্যবসায়ীরা শ্রমিকদের অতি নিম্ন মজুরি দিয়ে এবং কর্মস্থলের নিরাপত্তার পেছনে যথেষ্ট ব্যয় না করেই ব্যবসা-বাণিজ্য চালিয়ে যেতে পারেন। সেই সঙ্গে রয়েছে ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে কিংবা আমদানি-রপ্তানির নামে লুটপাট ও বিদেশে অর্থ পাচারের বিপুল সুযোগ। এই কারণেই দেশের অর্থনীতির আকার যত বড় হচ্ছে, বৈষম্য তত বাড়ছে।
সরকার যে ধনীদের কাছ থেকে পর্যাপ্ত কর আহরণ করে না, তার প্রমাণ হলো, সরকারের কর-রাজস্ব আয়ের ৬৫ থেকে ৬৭ শতাংশ পরোক্ষ কর থেকে আসে, বাকি অংশ আসে প্রত্যক্ষ বা আয়কর থেকে। প্রত্যক্ষ কর সংগ্রহ করা হয় ধনী ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে, যার মধ্যে রয়েছে মুনাফার ওপর কর, নির্দিষ্ট সীমার অতিরিক্ত আয়ের ওপর কর, সম্পত্তির ওপর কর ইত্যাদি। আর পরোক্ষ কর হলো বিভিন্ন ধরনের শুল্ক ও ভ্যাট, যা কোনো পণ্য ও সেবা কেনার সময় সর্বস্তরের মানুষের কাছ থেকে আদায় করা হয়।
বাংলাদেশ সরকারের রাজস্ব আয়ের বেশির ভাগটাই পরোক্ষ কর থেকে আসার কারণ হলো সরকার ধনীদের কাছ থেকে তাদের আয় ও মুনাফার ওপর কর আদায়ে জোর না দিয়ে জোর দিচ্ছে দরিদ্র-নিম্নবিত্ত-মধ্যবিত্ত সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের কাছ থেকে ভ্যাট ও শুল্কের মতো পরোক্ষ কর আদায়ে।
বেসরকারি সংস্থা সিপিডির দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, কর ফাঁকি ও অস্বচ্ছ ব্যবস্থার কারণে সরকার বছরে ৫৫ হাজার ৮০০ কোটি টাকা থেকে ২ লাখ ৯২ হাজার ৫০০ কেটি টাকা রাজস্ব হারাচ্ছে। টাকার এই অঙ্ক সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচিতে বরাদ্দ অর্থের ৮ গুণ; আর স্বাস্থ্য খাতের বরাদ্দের দুই গুণ। এভাবে প্রত্যক্ষ করের তুলনায় পরোক্ষ কর বেশি হওয়ার অর্থ হলো দরিদ্রদের কাছ থেকে অর্থ নিয়ে ব্যয় করা হচ্ছে ধনীদের সম্পদ ও আয় বৃদ্ধির কাজে, ফলে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির সঙ্গে জাতীয় আয়ে জনগণের ভাগ কমছে অর্থাৎ বৈষম্য বাড়ছে।
দেশের অর্থনীতির প্রবৃদ্ধির ধরনটিই এমন যে বেশির ভাগ কর্মসংস্থান হচ্ছে অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতে, যা বৈষম্য বৃদ্ধির একটি বড় কারণ। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর শ্রমশক্তি জরিপ ২০১৬-১৭ অনুযায়ী, দেশের শ্রমজীবী মানুষদের ৮৫ দশমিক ১ শতাংশই কাজ করছেন অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতে, যেখানে শ্রমিকের ন্যূনতম মজুরি, কর্মপরিবেশসহ কোনো ধরনের শ্রম অধিকারেরই কোনো নিশ্চয়তা থাকে না। এমনকি প্রাতিষ্ঠানিক খাতেও কারখানামালিকেরা শ্রমিকদের যে মজুরি প্রদান করেন, তা মানসম্পন্ন জীবনযাপনের জন্য যথেষ্ট নয়।
সিপিডির গবেষণা অনুযায়ী, ২০২২ সালের ডিসেম্বর নাগাদ, ঢাকার কেন্দ্রস্থলে বসবাসরত চারজনের একটি পরিবারের মাসিক খাবার খরচ ২৩ হাজার ৬৭৬ টাকা। আর যদি কোনো পরিবার পুরো মাসে একবারও মাছ, গরুর মাংস, খাসির মাংস ও মুরগি না খায়, তাহলেও খরচ ৯ হাজার ৫৫৭ টাকা।
সিপিডি এই ন্যূনতম খাবার খরচের সঙ্গে ২১টি শিল্প ও সেবা খাতের শ্রমিকদের ন্যূনতম মজুরির তুলনা করে দেখিয়েছে এমনকি মাছ, গরুর মাংস, খাসির মাংস ও মুরগি বাদ দিয়ে ন্যূনতম খাবার খরচও মেটানো সম্ভব নয় ১৫টি খাতের শ্রমিকদের ন্যূনতম মজুরি দিয়ে।
দেশে ক্রমবর্ধমান অর্থনৈতিক বৈষম্য কোনো স্বাভাবিক ঘটনা নয়। যে কর ফাঁকি, করছাড়, নিম্ন মজুরি, অনিয়ম, দুর্নীতির কারণে বৈষম্য বৃদ্ধি পাচ্ছে, তার সঙ্গে বিদ্যমান রাজনৈতিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থার ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রয়েছে। যে রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক ব্যবস্থায় সম্পদের সুষম বণ্টনের বদলে উল্টো সর্বজনের সম্পদ মুষ্টিমেয় ধনী ব্যক্তি ও গোষ্ঠীর কাছে হস্তান্তর করাকে ‘স্বাভাবিক’ মনে করা হয়, সেই ব্যবস্থাকে প্রত্যাখ্যান না করে এই তীব্র বৈষম্যের অবসান ঘটানো যাবে না।
আইএলওর প্রতিবেদন অনুসারে, এশিয়া ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশই একমাত্র দেশ, যেখানে ন্যূনতম মজুরি আন্তর্জাতিক দারিদ্র্যসীমার নিচে। শুধু তা-ই নয়, ২০১০ থেকে ২০১৯ সাল পর্যায়ে মূল্যস্ফীতির সঙ্গে তাল মিলিয়ে মজুরি বৃদ্ধি না পাওয়ায় বাংলাদেশের শ্রমিকদের প্রকৃত ন্যূনতম মজুরি এ অঞ্চলের দেশগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বেশি হারে কমেছে। এ রকম অস্বাভাবিক নিম্ন মজুরিতে শ্রমিকদের কাজ করিয়ে নিতে পারলে ব্যবসায়ীদের সম্পদের অস্বাভাবিক স্ফীতি হওয়াই স্বাভাবিক।
দেশে চলমান জবাবদিহিবিহীন একচেটিয়া শাসনব্যবস্থায় যত বেশি উন্নয়ন প্রকল্প নেওয়া হয়েছে, তত বেশি দুর্নীতি হয়েছে, তত বেশি উন্নয়ন প্রকল্পের ব্যয় বৃদ্ধি পেয়েছে। এককেন্দ্রিক ক্ষমতার রাজনৈতিক প্রাতিষ্ঠানিক পৃষ্ঠপোষকতায় সরকারি-বেসরকারি ব্যাংক থেকে ঋণের নামে হাজার হাজার কোটি টাকা লোপাট ও বিদেশে পাচারের ঘটনা ঘটেছে। আমদানির সময় পণ্যের মূল্য বেশি এবং রপ্তানির সময় মূল্য কম দেখানোর ঘটনা ঘটেছে নিয়মিত।
এভাবে উন্নয়ন প্রকল্পের দুর্নীতি, ব্যাংক থেকে লোপাট করা ঋণের অর্থ ও আমদানি-রপ্তানিতে মূল্যের তারতম্যের মাধ্যমে বিদেশে বিপুল বৈদেশিক মুদ্রা পাচার হয়েছে।
গবেষণা প্রতিষ্ঠান গ্লোবাল ফিন্যান্সিয়াল ইনটিগ্রিটির (জিএফআই) ২০২১ সালের প্রতিবেদন অনুসারে, স্রেফ বিদেশ থেকে পণ্য আমদানির মূল্য বেশি দেখানো এবং রপ্তানিতে মূল্য কম দেখানোর মাধ্যমে বাংলাদেশ থেকে প্রতিবছর গড়ে ৮২৭ কোটি ডলার বা ৮২ হাজার ৭০০ কোটি টাকা (১ ডলার সমান ১০০ টাকা ধরে) পাচার হয়। এভাবে দেশের কোটি মানুষের ভবিষ্যৎ ধ্বংস করে ক্রমাগত ফুলেফেঁপে উঠেছে ক্ষুদ্র একটি গোষ্ঠী।
কাজেই দেশে ক্রমবর্ধমান অর্থনৈতিক বৈষম্য কোনো স্বাভাবিক ঘটনা নয়। যে কর ফাঁকি, করছাড়, নিম্ন মজুরি, অনিয়ম, দুর্নীতির কারণে বৈষম্য বৃদ্ধি পাচ্ছে, তার সঙ্গে বিদ্যমান রাজনৈতিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থার ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রয়েছে। যে রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক ব্যবস্থায় সম্পদের সুষম বণ্টনের বদলে উল্টো সর্বজনের সম্পদ মুষ্টিমেয় ধনী ব্যক্তি ও গোষ্ঠীর কাছে হস্তান্তর করাকে ‘স্বাভাবিক’ মনে করা হয়, সেই ব্যবস্থাকে প্রত্যাখ্যান না করে এই তীব্র বৈষম্যের অবসান ঘটানো যাবে না।
কল্লোল মোস্তফা বিদ্যুৎ, জ্বালানি, পরিবেশ ও উন্নয়ন অর্থনীতিবিষয়ক লেখক। প্রকাশিত গ্রন্থ: ‘বাংলাদেশে উন্নয়নের রাজনৈতিক অর্থনীতি’, ‘ডিজিটাল কর্তৃত্ববাদ, নজরদারি পুঁজিবাদ ও মানুষের স্বাধীন ইচ্ছার ভবিষ্যৎ’। ই-মেইল: kallol_mustafa@yahoo.com