টাইম ম্যাগাজিন কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা নিয়ে একটি বিশেষ সংখ্যা প্রকাশ করেছে। ‘কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা: সম্ভাবনার নতুন যুগ’ শীর্ষক এ বিশেষ সংখ্যার সন্নিবেশিত লেখাগুলোর ওপর ভিত্তি করে প্রথম আলোর জন্য ধারাবাহিকভাবে লিখছেন ইশতিয়াক মান্নান। মূল লেখার সারাংশ, ভাষান্তর ও প্রাসঙ্গিক তথ্য-ব্যাখ্যা যুক্ত করেছেন তিনি। আগামী সপ্তাহের লেখা, ‘কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা: অন্তর্ভুক্তি ও পক্ষপাতের সমস্যা’
ইয়ান লেকুন, জেফ্রি হিন্টন ও ইউসুয়া বেনজিও—এই তিনজনই কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা বা এআই জগতের দিকপাল। এআইকে আজকের জায়গায় নিয়ে আসার ক্ষেত্রে তাঁদের ভূমিকা অপরিসীম, সামনে নিয়ে যাওয়ার ক্ষেত্রেও তাঁরা গুরুত্বপূর্ণ। তিনজনই ২০১৮ সালে কম্পিউটারবিজ্ঞানে নোবেল পুরস্কারের সমতুল্য টুরিং পুরস্কার পেয়েছেন। আশা ও আশঙ্কার বিষয় হচ্ছে, এআই মানবজাতিকে ধ্বংস বা তাকে প্রতিস্থাপন করবে কি না, এ-ই নিয়ে তাঁদের ভাবনা দুই বিপরীত মেরুতে অবস্থান করছে।
গত ৫০ বছরে এআই নিয়ে কাজ করছেন এমন গবেষক ও বিজ্ঞানীদের মধ্যে সবচেয়ে প্রভাবশালীদের একজন হচ্ছেন, টরন্টো বিশ্ববিদ্যালয়ের ইমেরিটাস অধ্যাপক জেফ্রি হিন্টন। অধ্যাপনা ছেড়ে তিনি গুগলে যোগ দেন ২০১৩ সালে। মানুষের মগজের আদলে এআইয়ের নিউরাল নেটওয়ার্ক তৈরিতে জেফ্রি হিন্টনের গবেষণা ও দক্ষতা এতটাই গুরুত্বপূর্ণ ও যুগান্তকারী যে আসলে গুগল তাঁকে ও তাঁর ছাত্রদের নিলামে কিনে নিয়েছিল ‘গুগল ব্রেন’-এর জন্য (সেই নিলামের ডাকে মাইক্রোসফট, বাইদু, ডিপমাইন্ডও অংশ নিয়েছিল)।
দীর্ঘদিন এআই নিয়ে গবেষণা করতে গিয়ে জেফ্রি হিন্টন সব সময় বিশ্বাস করে এসেছেন যে মানুষের মগজ এআই যন্ত্রের চেয়ে অনেক উন্নত এবং এআইকে যত বেশি মানুষের মগজের মতো করার চেষ্টা করা হবে, তত উন্নতি তার হবে। কিন্তু ২০২৩ সালে এসে সম্পূর্ণ ভিন্ন একটা উপলব্ধি হলো। আত্মোপলব্ধিও বলা যায়। সেটি হলো, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা তৈরির যে জায়গায় আমরা আজ এসে দাঁড়িয়েছি, খুব সম্ভবত তা এখনই মানুষের মগজের চেয়ে ভালো, শুধু এটাকে আরেকটু বেশি মাত্রায় সর্বত্র ছড়িয়ে দেওয়া বাকি।
পৃথিবীজুড়ে নির্মাতারা প্রাণপণে চেষ্টা করছেন, যত বড় করে সম্ভব, একটা এআই সিস্টেম তৈরি করতে। কাজটা যে হারে এগোচ্ছে, তাতে মনে হয়, আগামী পাঁচ বছরের কম সময়ে এআই সিস্টেম ১০০ ট্রিলিয়ন কানেকশন বা আন্তসংযোগ তৈরি করে ফেলতে পারবে। একজন মানুষের মগজের প্রায় ১০০ বিলিয়ন নিউরনের মধ্যে প্রায় ১০০ ট্রিলিয়ন আন্তসংযোগ আছে।
মানুষের ওপর এআই নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নেওয়ার ব্যাপারটা কেমন হবে তাহলে? হিন্টন বলেন, ‘মানুষের তখন কেমন লাগবে বুঝতে হলে, একটা মুরগির বাচ্চাকে জিজ্ঞেস করুন তার এখন কেমন লাগে।’
আতঙ্কিত অধ্যাপক হিন্টন ২০২৩ সালে গুগলের ভাইস প্রেসিডেন্ট হিসেবে চাকরি ছেড়ে দেন। প্রায় সারাটা জীবন যে এআই তৈরি করতে তিনি ব্যয় করেছেন, তা নিয়ে তাঁর তীব্র অনুশোচনা জন্ম নিয়েছে এবং এআইয়ের আসন্ন বিপদ নিয়ে তিনি খোলাখুলি কথা বলতে চান, তাই চাকরি ছাড়ার সিদ্ধান্ত। তিনি মনে করছেন, এআই যে পর্যায়ে চলে যাচ্ছে, তা অচিরেই মানুষের চেয়ে বেশি স্মার্ট হয়ে যাবে এবং নিয়ন্ত্রণকারীর ভূমিকায় অবতীর্ণ হবে।
নিউরাল নেটওয়ার্কের মাধ্যমে অকল্পনীয় মাত্রায় তথ্য আত্মস্থ ও বিশ্লেষণ করতে হিন্টনের গবেষণাকর্ম এআইকে সাহায্য করেছে। এ কারণেই এআই এখন ছবি চিনতে পারে, ভাষা বুঝতে পারে এবং নিজে গাড়ি চালাতে পারে। তাঁর অবস্থাটা এখন দাঁড়িয়েছে অনেকটা ফ্রাঙ্কেনস্টাইনের ঘটনার মতো, যে এআই তৈরিতে তিনি কাজ করেছেন, এখন তারই অতিমানবীয় ক্ষমতায় তিনি ভীত।
মানুষের ওপর এআই নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নেওয়ার ব্যাপারটা কেমন হবে তাহলে? হিন্টন বলেন, ‘মানুষের তখন কেমন লাগবে বুঝতে হলে, একটা মুরগির বাচ্চাকে জিজ্ঞেস করুন তার এখন কেমন লাগে।’
হিন্টনকে গুগল এআই নিরাপত্তাসংক্রান্ত পলিসির কাজ করতে অনুরোধ করেছিল। কিন্তু, তিনি সেটাতে রাজি হননি। তিনি এখন যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, কানাডার মতো দেশের রাষ্ট্রনেতা ও রাজনীতিবিদদের সঙ্গে কথা বলছেন তাঁদের সচেতনতা বাড়ানোর জন্য।
মন্ট্রিয়লের ‘ইনস্টিটিউট অব লার্নিং অ্যালগরিদমসের বৈজ্ঞানিক পরিচালক ইউসুয়া বেনজিও, গত তিন দশকের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ এআই গবেষক, যিনি ভালো করেই জানেন যে এআই অন্য সবার চেয়ে ভালো কী কী করতে পারে। এ রকম মানুষ যখন বলেন যে চ্যাটজিপিটি ব্যবহার করা এবং তার পুরো ক্ষমতা বুঝে ওঠার পর তাঁর প্রথম প্রতিক্রিয়া ছিল বিস্ময় ও আতঙ্কে গা গুলিয়ে ওঠার মতো, তখন আমাদের চিন্তিত হওয়ার কারণ আছে। কত দ্রুততার সঙ্গে এআই মানুষকে ছাড়িয়ে যেতে পারে, এই অনুধাবন তাঁর যুক্তিবাদী ও আবেগপ্রবণ মন দুটোকেই এমনই নাড়া দিয়েছিল যে সেটা সামলাতে কয়েক মাস লেগে গিয়েছিল।
হিন্টনের ভাষায়, ‘এটা অদ্ভুত এক মনস্তাত্ত্বিক টানাপোড়েন। আপনি মানবসভ্যতা, সমাজ, বিজ্ঞানের ভালোর জন্য দিনরাত পরিশ্রম করে সারা জীবন কাজ করলেন, তারপর শেষে দেখলেন যে কাজের ফলাফলটা একটা প্রলয় ডেকে আনতে পারে, তখন আপনার কেমন অনুভূতি হতে পারে ভাবুন।’
অধ্যাপক বেনজিও ও হিন্টন দুজন আলাদা আলাদাভাবে ধারণা করছেন যে ৫ থেকে ২০ বছরের মধ্যে এআই সব কাজেই মানুষকে ছাড়িয়ে যাবে।
বেনজিওর আশঙ্কাকে কোনোভাবেই খাটো করে দেখা যাচ্ছে না কারণ, তিনিই ২০০৩ সালে ‘লার্জ ল্যাঙ্গুয়েজ মডেল’-এর ভিত্তি তৈরি করেছিলেন, যা দিয়ে এআই মানুষের ভাষা থেকে ছক বা প্যাটার্ন বুঝতে পারে। আপনি দুটো অক্ষর লিখলেই এখন কম্পিউটার বা ফোন যেভাবে কয়েকটা সম্ভাব্য শব্দ বা বাক্যাংশ সামনে নিয়ে আসে, সেটা তাঁর গবেষণারই অবদান।
তিনিই ২০১৪ সালে এআইকে এমনভাবে প্রশিক্ষিত করতে পেরেছিলেন যে এক অ্যাপ্লিকেশন আরেক অ্যাপ্লিকেশনের তৈরি করা কনটেন্টের গুণগত মান বিচার করতে পারবে। তিনিই ২০১৮ সালে নিউরাল নেটওয়ার্ককে, সবচেয়ে প্রাসঙ্গিক বিষয়গুলো খুঁজে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের মতো পরস্পরসম্পর্কিত তথ্য বিশ্লেষণ করা শেখাতে সাহায্য করেছিলেন।
অধ্যাপক বেনজিও এখন তাঁর বুদ্ধিবৃত্তিক ক্ষমতার পুরোটাই দিতে চান পরিস্থিতির মাত্রা ও জটিলতা বুঝে ব্যবস্থা নিতে। তিনি বলছেন যে ভবিষ্যতে এআই আমাদের ওপর নিয়ন্ত্রণ আরোপ করতে পারে, কিন্তু ভবিষ্যতের আগেই ঘটে যেতে পারে নানা অঘটন।
আশু বিপদের একটা হচ্ছে, বিভিন্ন জাতীয় নির্বাচনকে প্রভাবিত করা (যার উদাহরণ আমরা গেল মার্কিন নির্বাচনে লক্ষ করেছি)। ২০২৩ সালে তিনি মার্কিন সিনেটে এআইএয়ের সম্ভাব্য বিপদ নিয়ে সাক্ষ্যমূলক বক্তব্য দিয়েছেন। এআই-সংক্রান্ত নীতিমালা এবং কীভাবে এআইকে সুশাসনের আওতায় এনে সামলে রাখা যায়, সেটা নিয়েও লিখেছেন এই বিজ্ঞানী। এখন গবেষণার পুরো মনোযোগ নিবদ্ধ করেছেন এআই থেকে উদ্ভূত নিরাপত্তাঝুঁকির বিষয়ে।
ঝুঁকিটা যে শূন্যে নামিয়ে আনা যাবে না, এটা সবাই বোঝেন, কিন্তু অঘটন ঘটার সম্ভাবনা যদি ১০ ভাগও কমানো যায়, তাহলে সবাই মিলে তা-ই করতে লেগে পড়া উচিত; পরিস্থিতিটা মানবজাতির জন্য এমনই বাঁচা–মরার ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে বলে তিনি মনে করেন।
মেটার প্রধান এআই বিজ্ঞানী ও নিউইয়র্ক বিশ্ববিদ্যালয়ের কম্পিউটারবিজ্ঞানের অধ্যাপক ইয়ান লেকুন। কৃত্রিমভাবে ‘নিউরাল নেটওয়ার্ক’ তৈরি করা সম্ভব—এ কথা আশির দশকে জোরগলায় বলে তিনি অনেকের তামাশার পাত্র হয়েছিলেন। কিন্তু তাঁর কথামতোই আজ ‘জেনারেটিভ এআই’-এর মতো বিপ্লব ঘটে যাচ্ছে। নিজের মত আর অন্যের মতের সঙ্গে মিল না হলে তা ঢোল পিটিয়ে বলায় তাঁর নাম আছে; সে সুনাম বা দুর্নাম যা-ই বলেন না কেন।
অধ্যাপক ইয়ান এই অস্তিত্বের সংকটের আশঙ্কাকে একদমই অবাস্তব বলে উড়িয়ে দিচ্ছেন। তাঁর মতে, যাঁরা চারদিকে সর্বক্ষণ, ‘সৃষ্টি সহসাই ধ্বংস হয়ে যাবে’, এই আলামত দেখতে পান, তাঁরাই এই ‘গেল গেল’ রব তুলেছেন। তিনি মনে করেন, চ্যাটজিপিটির মতো ‘লার্জ ল্যাঙ্গুয়েজ মডেল’ যে উন্মাদনা তৈরি করেছে, তা সাময়িক এবং দ্রুতই এটা মিইয়ে যাবে।
অধ্যাপক ইয়ানের কথা হচ্ছে, মানুষ সামান্য ভুল করলেই মহা বুদ্ধিমান এআই সব দখল করে নেবে, বাস্তবের ঘটনাবলি এভাবে ঘটে না। তিনি একটা মজার উদাহরণ দিয়েছেন।
ধরা যাক, ১৯৬০ সালে একটা জেট প্লেন তৈরি করা হয়েছে আটলান্টিক পাড়ি দেওয়ার জন্য। বলা হলো, আমরা আগে কোনো পরীক্ষামূলক উড়ান দেব না, শুধু বানাব এবং শেষ হলে এক হাজার যাত্রীকে প্লেনে উঠিয়ে দেখব যে এটা নিরাপদে আটলান্টিক পাড়ি দিতে পারে কি না। ইয়ান বলছেন, বাস্তবে তো কোনো এয়ারলাইনস কোম্পানি এমন বোকামি কোনো দিন করবে না। শতসহস্র পরীক্ষা, পরিবর্তন ও উন্নয়নের পরই কেবল প্লেন উড়তে দেওয়া হবে।
এআইয়ের বিকাশ ঠিক এ রকম পরীক্ষা-নিরীক্ষার মধ্য দিয়েই যাবে। যাঁরা ভয়ংকর সব পরিণতির কথা ভাবছেন, তাঁরা বুঝতেই পারছেন না যে এই জটিল প্রকৌশল সমস্যার সমাধান আমরা এখনো করিনি, কারণ, আমরা এখনো পুরোপুরি বুঝে উঠতেই পারিনি যে অতি বুদ্ধিমান একটা এআই সিস্টেম আসলে শেষ পর্যন্ত কেমন দাঁড়াবে।
ইয়ান মনে করেন, এখনো এআই গবেষকেরা বুঝে উঠতেই পারছেন না, এই দানবীয় সিস্টেমকে কীভাবে নিরাপদ করে বানানো যায়। এআই ডিজাইনের সময় থেকেই সুনির্দিষ্ট কিছু বাধ্যবাধকতা তার মধ্যে অন্তর্ভুক্ত করতে হবে কাঠামোগতভাবেই, যাতে সে যা কিছু উৎপাদন করবে, সে যা-ই হোক না কেন, সেই বাধ্যবাধকতার সীমা অতিক্রম করতে পারবে না। তাঁর মতে, লোকে যত বলছে, কাজটা মোটেও ততটা কঠিন নয়।
ইয়ান মনে করেন যে জেফরির মতো মানুষেরা ‘লার্জ ল্যাঙ্গুয়েজ মডেল’-এর মানুষের মতো বুদ্ধিমান হয়ে ওঠার সম্ভাবনাকে অতি আশাবাদী দৃষ্টিতে দেখছেন। ইয়ানের কথা, মানুষের চেয়ে বুদ্ধিমান হওয়া আর সবকিছুর নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নেওয়ার মধ্যে একটা সরল কার্যকারণ সম্পর্ক টানা হচ্ছে। অথচ মানুষের মধ্যেই দেখা যায়, যাঁরা সবচেয়ে বুদ্ধিমান, তাঁরা কিন্তু ক্ষমতায় যাওয়া, দখল করা, নেতৃত্ব দেওয়া—এগুলোয় বেশি আগ্রহী নন, বরং উল্টোটাই বেশি সত্য।
ইশতিয়াক মান্নান আন্তর্জাতিক সংস্থায় কর্মরত বিশেষজ্ঞ