জ্বালানির মূল্যবৃদ্ধির ধাক্কায় ৫০ শতাংশের বেশি পরিবার তাদের শিশুদের জন্য অপরিহার্য প্রয়োজনগুলো কাটছাঁট করতে বাধ্য হবে
জ্বালানির মূল্যবৃদ্ধির ধাক্কায় ৫০ শতাংশের বেশি পরিবার তাদের শিশুদের জন্য অপরিহার্য প্রয়োজনগুলো কাটছাঁট করতে বাধ্য হবে

জ্বালানি-দারিদ্র্য ব্রিটেনে হীনম্মন্য প্রজন্ম তৈরি করছে

প্রধানমন্ত্রী নির্বাচনের সময় যতই ঘনিয়ে আসছে, কনজারভেটিভ পার্টির প্রার্থীদের মধ্যে কার নৈতিক অবস্থান কতটা উঁচু, সেটা প্রমাণের চেষ্টা ততই তীব্র হচ্ছে। অবশ্য নৈতিকতা প্রমাণে একেকজনের অবস্থানে বেশ ভিন্নতা রয়েছে। কেউ বলছেন ঊর্ধ্বমুখী ঋণ ‘অনৈতিক’, কেউ বলছেন ‘উচ্চ হারে কর আরোপ’ অনৈতিক। কিন্তু আসন্ন শীতে ব্রিটেনের নাজুক জনগোষ্ঠী, অবসরভাতাভোগী ও নির্দোষ শিশুরা যে তীব্র দারিদ্র্যের মধ্যে পড়তে যাচ্ছে, তা নিয়ে নৈতিক কোনো অবস্থান দেখাতে ব্যর্থ হওয়ার ক্ষেত্রে কারও মধ্যেই কোনো পার্থক্য নেই।

বাস্তব পরিস্থিতি খুবই ভয়ানক, উপেক্ষা করার সুযোগ নেই। অক্টোবর মাসে প্রতিটি পরিবারে একটি অর্থনৈতিক সময়বোমা বিস্ফোরণ হতে যাচ্ছে। ছয় মাসের মধ্যে দ্বিতীয়বারের মতো জ্বালানির মূল্যবৃদ্ধি লাখ লাখ মানুষকে খাদের কিনারে পৌঁছে দিতে চলেছে। কিছুদিন আগে ইয়র্ক বিশ্ববিদ্যালয়ের জনাথন ব্রাডশো ও আন্তনিয়া ক্যাং এক সমীক্ষায় দেখিয়েছেন, এপ্রিলে জ্বালানির ৫৪ শতাংশ মূল্যবৃদ্ধির ফলে ব্রিটেনের ১ কোটি পরিবারের ২ কোটি ৭০ লাখ মানুষকে জ্বালানি-দারিদ্র্যের (জ্বালানির উচ্চ মূল্যের ফলে সৃষ্ট দারিদ্র্য) ফাঁদে পড়তে হয়েছে। অক্টোবর মাসে নতুন করে জ্বালানির মূল্যবৃদ্ধি হলে ১ কোটি ৩০ লাখ পরিবারের ৩ কোটি ৫০ মানুষ জ্বালানি-দারিদ্র্যে পড়বে। এটা নজিরবিহীন, কেননা সংখ্যাটি যুক্তরাজ্যের মোট জনসংখ্যার ৪৯ দশমিক ৬ শতাংশ।

অক্টোবরের মূল্যঝড়ের আগেই ‘ইউনিভার্সাল ক্রেডিট’ (নিম্ন আয়ের মানুষের জীবনমান উন্নয়নের ঋণ) পরিশোধের ব্যবস্থা হালনাগাদ করার সময় ফুরিয়ে আসছে। বরিস জনসন, ঋষি সুনাক ও লিজ ট্রাসকে এ সপ্তাহের মধ্যেই জরুরি বাজেটের ব্যাপারে সম্মত হতে হবে। তাঁরা যদি সেটা না করেন, তবে আইনসভার উচিত জোর করে সেটা করতে বাধ্য করা। আর সেটা যদি না করা হয়, তাহলে আগামী বছরের জানুয়ারি মাসে আরেক দফা জ্বালানির মূল্যবৃদ্ধি করতে হবে। সে সময় ব্রিটেনের ১ কোটি ৫০ লাখ পরিবারের ৩ কোটি ৯০ লাখ মানুষ; অর্থাৎ ৫৪ শতাংশ মানুষ জ্বালানি-দারিদ্র্যে পড়বে। পরিস্থিতি এমন হবে যে অবসরভোগীরা যে ভাতা পাবেন, তার তিন ভাগের এক ভাগই জ্বালানির বিল পরিশোধ করতে লেগে যাবে। মহামারির শুরুতে এক সমীক্ষায় দেখা গিয়েছিল, ব্রিটেনে ভালো মানের জীবনযাপন থেকে বঞ্চিত ৪০ শতাংশ শিশু। আসছে অক্টোবরে জ্বালানির মূল্যবৃদ্ধির ধাক্কায় ৫০ শতাংশের বেশি পরিবার তাদের শিশুদের জন্য অপরিহার্য প্রয়োজনগুলো কাটছাঁট করতে বাধ্য হবে।

আমাদের সবারই স্কুল পালানোর অভিজ্ঞতা আছে। আমরা হয়তো কোনো কোনো দিন সময়মতো স্কুলবাসে উঠিনি অথবা স্কুলের কোনো অনুষ্ঠানে যাইনি। সে ঘটনা আমাদের জন্য হয়তো উপভোগ্য ছিল। কিন্তু স্কুল কামাই করা যখন প্রতিদিনের বিষয় হয়ে ওঠে, তখন সেটা যে কারোর আত্মবিশ্বাস ধ্বংস করে ফেলার জন্য যথেষ্ট। কেননা এটি লজ্জা, একাকিত্ব ও অপমানবোধের জন্ম দেয়।

দারিদ্র্য এখন এতটাই তীব্র যে দাতব্য কর্মকাণ্ড পরিস্থিতি সামাল দিতে পারছে না। কিন্তু দারিদ্র্যের কারণে মনস্তাত্ত্বিকভাবে শিশুদের মধ্যে যে ভয়ের জন্ম হচ্ছে, তার প্রভাব অনেক গভীর। অনেক মায়ের সঙ্গে আমার দেখা হয়, সন্তানদের ন্যূনতম প্রয়োজনটা তাঁরা মেটাতে পারছেন না বলে লজ্জিত। একজন মা তাঁর সন্তানকে স্কুলে পাঠানো বন্ধ করে দিয়েছেন। কেননা, তাঁর দ্রুত বেড়ে ওঠা কিশোর সন্তানের জন্য নতুন স্কুলড্রেস ও জুতা কিনতে পারছেন না তিনি। আরেক মা খুব কুণ্ঠিত যে তিনি তাঁর সন্তানের বন্ধুদের বাসায় নিমন্ত্রণ করতে পারছেন না। কেননা, একটা একটা করে জিনিস বিক্রি করতে করতে তঁার ঘর শূন্য হয়ে গেছে। অনেক শিশু এখন বাড়তি জামাকাপড় আর পকেট খরচ না থাকার কারণে বন্ধুদের সঙ্গে বাইরে যেতে পারছে না, খেলার পোশাক ও সরঞ্জাম না কিনতে পারায় তারা স্কুলের খেলাধুলায় অংশ নিতে পারছে না।

আমাদের সবারই স্কুল পালানোর অভিজ্ঞতা আছে। আমরা হয়তো কোনো কোনো দিন সময়মতো স্কুলবাসে উঠিনি অথবা স্কুলের কোনো অনুষ্ঠানে যাইনি। সে ঘটনা আমাদের জন্য হয়তো উপভোগ্য ছিল। কিন্তু স্কুল কামাই করা যখন প্রতিদিনের বিষয় হয়ে ওঠে, তখন সেটা যে কারোর আত্মবিশ্বাস ধ্বংস করে ফেলার জন্য যথেষ্ট। কেননা এটি লজ্জা, একাকিত্ব ও অপমানবোধের জন্ম দেয়। সবকিছু থেকে পালাতে বাধ্য হওয়ার এ অভিজ্ঞতা শিশুদের মনে যে ক্ষত তৈরি করছে, তার প্রভাব সারা জীবনভর বইতে হবে। হ্যাঁ, ব্রিটেন এখন শিশু-কিশোরদের এ রকমই একটা হীনম্মন্য প্রজন্ম সৃষ্টি করছে যে শিশুরা বন্ধুদের সঙ্গে মিশতে শঙ্কিত বোধ করছে। চার্লস ডিকেন্সের উপন্যাসের শিশুদের মতো একটা গ্লানিকর শৈশব তাদের শুরু হয়েছে।

আমাদের আলোচ্য বিষয় খুব জটিল নয়। আমরা বলছি, দারিদ্র্য হটাতে একটি নতুন কৌশল প্রণয়ন করতে হবে। আমি যখন প্রধানমন্ত্রী ছিলাম, আমাদের সরকার এক প্রজন্মের মধ্যে শিশুদারিদ্র্য বিলোপ করার একটি লক্ষ্য নির্ধারণ করেছিল। এ শীতে আমি বাতিল করা সেই কর্মসূচি ফিরিয়ে আনতে নিজেকে উৎসর্গ করব। ক্ষমতার কেন্দ্রে যাঁরা থাকেন, মানুষের প্রতি তাঁদের নিষ্ঠুরতা শুধু অযোগ্যতা ও অসংবেদনশীলতা নয়, সেটা অনৈতিকও।

দ্য গার্ডিয়ান থেকে নেওয়া, ইংরেজি থেকে অনূদিত

গর্ডন ব্রাউন যুক্তরাজ্যের সাবেক প্রধানমন্ত্রী