মতামত

অন্তর্বর্তী সরকারের সঙ্গে জনগণের ‘ব্যবধান’ কমানো যায় কীভাবে

এ বছরের ঐতিহাসিক শিক্ষার্থী নেতৃত্বাধীন আন্দোলনের সময় এই পুরো জাতি একত্র হওয়ার অন্যতম চালিকা শক্তি ছিল ‘জনগণের অংশগ্রহণ’।

একটি অন্তর্ভুক্তিমূলক শাসনব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার আশা নিয়ে স্বতঃস্ফূর্তভাবে ওই আন্দোলনে অংশগ্রহণ করেছিলেন তাঁরা।

নতুন অন্তর্বর্তী সরকার প্রতিষ্ঠিত হয় ওই সব সাধারণ মানুষের প্রত্যাশার ওপর ভিত্তি করে।

কিন্তু অন্তর্বর্তী সরকারের তিন মাস হওয়ার পর চারদিকে কেমন যেন হতাশা কিংবা অস্থিরতার আভাস পাওয়া যাচ্ছে। আন্দোলনের সময় সাধারণ জনগণের মধ্যে যে আবেগময় সংযোগ ও সংহতি তৈরি হয়েছিল, তা ক্রমেই ম্রিয়মাণ হয়ে যাচ্ছে।

সাধারণ জনগণ নিজেদের দেশের ভবিষ্যৎ নির্ধারণের প্রক্রিয়া থেকে ক্রমে বিচ্ছিন্ন মনে করছেন।

এর একটি গুরুত্বপূর্ণ কারণ হচ্ছে আন্দোলনের সময় সবার ‘অংশগ্রহণের’ যে সুযোগ তৈরি হয়েছিল কিংবা ‘অংশগ্রহণের’ যে গুরুত্ব ও চাহিদা ছিল, তা এখন কার্যত আর নেই।

অন্তর্বর্তী সরকারের ক্রমবর্ধমান জনবিচ্ছিন্নতা

অন্তর্বর্তী সরকারের প্রতিশ্রুতি সত্ত্বেও বাংলাদেশের অনেক সাধারণ মানুষ এখন নিজেকে উপেক্ষিত মনে করছেন। তাঁরা মনে করছেন, সিদ্ধান্ত গ্রহণের প্রক্রিয়া দিন দিন সরকারকেন্দ্রিক হয়ে যাচ্ছে এবং নাগরিকদের মতামত দেওয়ার পথগুলো আস্তে আস্তে সংকীর্ণ হয়ে যাচ্ছে।

খুব দ্রুত এ বিষয়ে পদক্ষেপ না নিলে অন্তর্বর্তী সরকার ও সাধারণ জনগণের মাঝে সৃষ্টি হওয়া এই দূরত্বের কারণে জনগণের মধ্যে উদাসীনতা ও হতাশা সৃষ্টি হতে পারে, যা সরকারের সংস্কারপ্রচেষ্টাকে ক্ষতিগ্রস্ত করতে পারে।

জনগণের ভেতরের হতাশা কিংবা অস্থিরতার বিষয়টি স্পষ্টভাবে উঠে এসেছে ‘উন্নয়নমুখী রাজনৈতিক জনসংযোগ’ (পলিটিক্যাল কমিউনিকেশন ফর ডেভেলপমেন্ট) বিষয়ক একটি চলমান অনলাইন জরিপে।

এখন পর্যন্ত (২৩ নভেম্বর ২০২৪) পাওয়া ফলাফল থেকে দেখা যায়, জরিপে অংশগ্রহণকারী প্রায় ৭৫ শতাংশ ৪ শতাংশ মনে করেন, সরকারের সিদ্ধান্ত গ্রহণের প্রক্রিয়ায় নাগরিকদের অংশগ্রহণের আরও বেশি সুযোগ থাকা উচিত।

শুধু ৬ দশমিক ৭ শতাংশ সরকারে তাঁদের অংশগ্রহণের সুযোগ নিয়ে সন্তুষ্টি প্রকাশ করেছেন।

জনগণকে সম্পৃক্ত করার কিছু উদাহরণ

দক্ষিণ আফ্রিকার বর্ণবাদবিরোধী আন্দোলনের বৈশিষ্ট্য ছিল সর্বস্তরের ‘জনগণের অংশগ্রহণ’। ওই আন্দোলন–পরবর্তী সময়ে সেখানকার সরকার ‘ট্রুথ অ্যান্ড রিকনসিলিয়েশন কমিশন’ গঠন করে ‘গণশুনানি’-র মতো উদ্যোগের মাধ্যমে নাগরিকদের অংশগ্রহণের সুযোগ করে দিয়েছিলেন।

এই অংশগ্রহণ তাঁদের জাতি হিসেবে বর্ণবাদের কারণে সৃষ্ট ক্ষত কাটিয়ে উঠতে সাহায্য করেছিল।

এ প্রক্রিয়ার মাধ্যমে তাঁরা বর্ণবাদভিত্তিক নিপীড়ন থেকে অন্তর্ভুক্তিমূলক গণতন্ত্রের পথে এগিয়ে যেতে পেরেছিলেন।

২০০৮ সালের কেনিয়ার নির্বাচন–পরবর্তী সহিংসতার পর তৈরি হওয়া ‘উশাহিদি’ (সাক্ষ্য) একটি ক্রাউডসোর্সিং টুল, যা সাধারণ জনগণের কাছ থেকে সহিংসতার তথ্য সংগ্রহ ও রিপোর্ট তৈরি করার কাজে ব্যবহার করা হয়।

এই প্ল্যাটফর্ম সরকারে স্বচ্ছতা ও নাগরিক অংশগ্রহণ বৃদ্ধি করেছে। বাংলাদেশও অনুরূপ প্রযুক্তি ব্যবহার করে সরাসরি জনগণের মতামত সংগ্রহ করার পাশাপাশি সরকারি প্রকল্পের স্বচ্ছতা ও অগ্রগতি পর্যবেক্ষণে তাদের যুক্ত করতে পারে।

‘ওপেন গভর্নমেন্ট পার্টনারশিপ’ একটি আন্তর্জাতিক উদ্যোগ, যার মাধ্যমে স্বচ্ছ ও অংশগ্রহণমূলক শাসনব্যবস্থা নিশ্চিত করা হয়।

এর সদস্যদেশগুলো জনগণের পরামর্শের ভিত্তিতে সরকারি কর্মপরিকল্পনা তৈরি করতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ।

এ উদ্যোগের সঙ্গে বাংলাদেশকে সম্পৃক্ত করে জনগণের অংশগ্রহণকে প্রতিষ্ঠানিক রূপ দেওয়া যেতে পারে।

বাংলাদেশে জনগণকে পুনরায় যুক্ত করার কৌশল

বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার জনগণের সম্পৃক্ততা নিশ্চিত করতে কিছু কৌশল বিবেচনা করতে পারে। যেমন:

জনগণের অংশগ্রহণ প্রাতিষ্ঠানিক করা: ক) আইনি কাঠামো—এমন আইন প্রণয়ন করা বা বিদ্যমান আইনে সংস্কার করা, যার মাধ্যমে নীতি প্রণয়নে জনপরামর্শ বাধ্যতামূলক হবে।

এর মাধ্যমে নাগরিকদের অংশগ্রহণ শুধু রাজনৈতিক ইচ্ছার ওপর নির্ভর করবে না। খ) স্থানীয় সরকারব্যবস্থার ক্ষমতায়ন: স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানগুলোকে বাস্তবসম্মতভাবে ক্ষমতায়ন করা।

এর মাধ্যমে জনগণ তাঁদের উন্নয়নের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট বিষয়ে মতামত দিতে পারেন এবং সিদ্ধান্ত নিতে পারার পাশাপাশি জবাবদিহিও নিশ্চিত করতে পারেন।

প্রযুক্তির ব্যবহার: ক) ই-গভর্ন্যান্স প্ল্যাটফর্ম—সহজে এবং সবার ব্যবহারের উপযোগী অনলাইন পোর্টাল তৈরি করা। এখানে নাগরিকেরা নীতিমালা সম্পর্কে তাঁদের মতামত দিতে পারবেন, যেকোনো সমস্যা সম্পর্কে কর্তৃপক্ষকে জানাতে পারবেন এবং নির্বিঘ্নে সব সরকারি সেবা পাবেন।

খ) মুঠোফোনের ব্যবহার—দেশে বর্তমানে ১৯ কোটি সচল মুঠোফোন রয়েছে। যেকোন জরুরি জনগুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষেত্রে মুঠোফোন ব্যবহারকারীদের মতামত সংগ্রহ করার জন্য এসএমএস-ভিত্তিক জরিপ পরিচালনা করা যেতে পারে।

অন্তর্ভুক্তিমূলক নীতি প্রণয়ন:

ক) অংশীজন সংলাপ—সখ্যালঘু, নারী, প্রান্তিক সম্প্রদায়সহ বিভিন্ন গোষ্ঠীর সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ রাখা এবং তাদের সঙ্গে পরামর্শ করার মাধ্যমে বিভিন্ন নীতিমালা প্রণয়নের ক্ষেত্রে সবার অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা।

খ) নতুন প্রজন্মের (জেন–জি) অংশগ্রহণ—সম্প্রতি যাঁরা আন্দোলনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন, তাঁদের অংশগ্রহণের জন্য দলমত–নির্বিশেষে সবার কাছে গ্রহণযোগ্য প্ল্যাটফর্ম তৈরি করা, যাতে তাঁরা জাতীয় ও স্থানীয় পর্যায়ের আলোচনায় অংশগ্রহণ করতে পারেন।

জনগণের অংশগ্রহণের সুযোগ সৃষ্টি

সাম্প্রতিক আন্দোলনে সফলতার মূল চালিকা শক্তি ছিল জনগণের স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণ।

সবার মধ্যে প্রত্যাশা ছিল নিজের এবং নিজের সন্তানের, তথা দেশের জন্য ভালো কিছু করা। সেই আবেগের জায়গাকে পুনরুজ্জীবিত করার মাধ্যমে জনগণকে পুনরায় সরকারি নীতিনির্ধারণে যুক্ত করা শুধু প্রক্রিয়া ও নীতিমালার মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখলে হবে না; সরকারকে প্রমাণ করতে হবে যে তারা নাগরিকদের মতামতকে মূল্য দেয় এবং সে অনুযায়ী কাজ করে।

বিভিন্ন প্রতীকী পদক্ষেপ, যেমন আন্দোলনে নেতৃত্বদানকারী সারা দেশের তৃণমূল পর্যায়ের সমন্বয়কদের পাশাপাশি প্রতিষ্ঠানিক ও অপ্রাতিষ্ঠানিকভাবে অংশগ্রহণকারীদের সম্পৃক্ততার সুযোগ তৈরি করে দেওয়া এবং এসব অংশগ্রহণকারীকে অবদানের জন্য স্বীকৃতি প্রদান এ প্রক্রিয়াকে আরও শক্তিশালী করতে পারে।

আমাদের এখনই সতর্ক হওয়া দরকার। ‘আরব বসন্ত’ চলাকালে যে বিপ্লবী উদ্দীপনা সবাইকে একত্র করে চূড়ান্ত সফলতা এনে দিয়েছিল, বিপ্লব–পরবর্তী সময়ে অন্তর্ভুক্তিমূলক বা জনগণের অংশগ্রহণভিত্তিক শাসনের অভাবে সেখানে সামগ্রিক অস্থিতিশীলতার সূচনা হয় এবং তাদের পশ্চাদপসরণ ঘটে।

উদাহরণস্বরূপ, মিসরে বিপ্লব–পরবর্তী অন্তর্ভুক্তিমূলক শাসনের অভাবে রাজনৈতিক অস্থিরতা তৈরি হয় এবং স্বৈরতন্ত্রের প্রত্যাবর্তন ঘটে।

নাগরিকদের স্থায়ী অংশীদারত্ব

বাংলাদেশ এই মুহূর্তে একটি গুরুত্বপূর্ণ জায়গায় দাঁড়িয়ে আছে। অন্তর্বর্তী সরকারের সুযোগের পাশাপাশি দায়িত্বও আছে দেশের শাসনব্যবস্থাকে ‘অংশগ্রহণকেন্দ্রিক’ অবস্থায় নিয়ে যাওয়ার।

বিশ্বের সেরা উদাহরণগুলো থেকে শিক্ষা নিয়ে সেগুলোকে এ দেশের স্থানীয় প্রেক্ষাপটে খাপ খাইয়ে বাংলাদেশ নিশ্চিত করতে পারে যে তার গণতন্ত্র স্থিতিশীল, অন্তর্ভুক্তিমূলক ও জনগণের আকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন ঘটাতে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ।

এ দেশের জনগণ যে সমৃদ্ধ বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখেছে, তা বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে সবার ‘অংশগ্রহনের’ সুযোগ তৈরি করার কোনো বিকল্প নেই, যেমনটি হয়েছে সাম্প্রতিক আন্দোলনের ক্ষেত্রে।

সেই সময়ের ‘ঐক্য ও সংকল্পকে’ সরকারের সঙ্গে নাগরিকদের স্থায়ী অংশীদারত্বে রূপান্তর করার সময় এখনই।

  • শাকিল ফয়জুল্লাহ জনসংযোগ গবেষক, ইউনিভার্সিটি অব জর্জিয়া, যুক্তরাষ্ট্র
    sakilfz@gmail.com