বিশ্বরাজনীতির নতুন মেরুকরণ আমাদের রাজনীতিতেও প্রতিফলিত হচ্ছে। আমাদের রাজনীতি, নির্বাচন ও গণতন্ত্র নিয়ে বিশ্বরাজনীতির প্রভাবশালী খেলোয়াড়েরা খোলাখুলিই কথা বলছেন এবং পরিষ্কার দুই ভাগে বিভক্ত হয়ে পড়েছেন। যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্ররা অনেক দিন ধরেই দেশে একটি সুষ্ঠু ও অবাধ নির্বাচনের কথা বলছে। বিপরীতে এবার সরব হয়েছে চীনের নেতৃত্বে যুক্তরাষ্ট্রের বিপক্ষের শক্তিগুলো। ফলে বিশ্বরাজনীতির ছায়া আমাদের এখানে পরিষ্কারভাবেই পরিলক্ষিত হচ্ছে।
বিশ্বরাজনীতির কূটনৈতিক যুদ্ধের নতুন ক্ষেত্রে পরিণত হয়েছে বাংলাদেশ। দুই পক্ষই বাগ্যুদ্ধে লিপ্ত হয়েছে প্রকাশ্যে। আর পর্দার আড়ালে বাংলাদেশকে নিজ পক্ষে রাখা বা টানার তৎপরতা উভয় পক্ষই চালিয়ে যাচ্ছে।
যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দপ্তরের আন্ডার সেক্রেটারি উজরা জেয়ার নেতৃত্বে উচ্চপর্যায়ের একটি প্রতিনিধিদল এ মুহূর্তে ঢাকায় অবস্থান করছে। এর আগেই ইউরোপীয় ইউনিয়নের একটি দল নির্বাচনের প্রস্তুতি পর্যবেক্ষণের জন্য ঢাকায় এসেছে। ইইউয়ের দলটি ধারাবাহিকভাবে ঢাকায় বৈঠক করেছে। এসব বৈঠকে মূলত নির্বাচন, মানবাধিকার পরিস্থিতি নিয়ে আলাপ-আলোচনা হয়েছে। ইইউ নির্বাচনের আগে ছয় মাস পার্বত্য অঞ্চলের পরিস্থিতিও গভীরভাবে পর্যবেক্ষণের কথা বলেছে।
বোঝাই যাচ্ছে, ইইউ বাংলাদেশের নির্বাচন ও মানবাধিকার পরিস্থিতি গভীরভাবে পর্যালোচনা করছে। অথচ সাম্প্রতিক সময়ে ইইউকে বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতি নিয়ে খুব বেশি সক্রিয় হতে দেখা যায়নি। এটা একটা তাৎপর্যপূর্ণ দিক বর্তমান কূটনৈতিক যুদ্ধের পরিপ্রেক্ষিতে।
যুক্তরাষ্ট্র অনেক আগে থেকেই আমাদের রাজনীতি নিয়ে খোলামেলাভাবে কথা বলছে। যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিনিধিরা ঘন ঘনই ঢাকা সফর করেছেন এবং করছেন। ডোনাল্ড লু দ্বিতীয়বারের মতো ঢাকা সফরে এসেছেন। এসব সফরে যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিনিধিরা বারবার সুষ্ঠু ও অবাধ নির্বাচন এবং মানবাধিকারের বিষয়ে ঢাকাকে সতর্ক করছে।
এই যুদ্ধে কারা জিতবে, তা বলা মুশকিল। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, দেশের ক্ষমতার শক্তি কি বহির্বিশ্ব নির্ধারণ করে দেবে? আমাদের জনসাধারণের মতামতের কি কোনো গুরুত্ব নেই? বিদেশি শক্তি যদি ক্ষমতার পালাবদলে চরিত্র ঠিক করে দেয়, তাহলে জনসাধারণ সার্বভৌম রইল কোথায়।
উজরা জেয়া ঢাকায় আসার আগে ভারতের হিন্দুস্থান টাইনাসকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে বলেছেন,বাংলাদেশে একটি পুরোপুরি অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন নিশ্চিত করার লক্ষ্য নিয়েই যুক্তরাষ্ট্র তার নতুন ভিসা নীতি ঘোষণা করেছে। তবে যুক্তরাষ্ট্রের চাওয়া মূলত আরও বেশি। সম্ভবত বাংলাদেশ সুষ্ঠু ও অবাধ নির্বাচন করলেই যুক্তরাষ্ট্রের চাওয়া পুরোপুরি পূরণ হবে না। গণতন্ত্র ও মানবাধিকার নিশ্চিত করার পাশাপাশি বাংলাদেশকে ভারত ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের যুক্তরাষ্ট্রের নিরাপত্তা পরিকল্পনার অংশ হতে হবে। মিয়ানমার প্রশ্নে যুক্তরাষ্ট্রের পরিকল্পনা বাস্তবায়নের সহযোগিতা করতে হবে। যুক্তরাষ্ট্রের চাওয়া অনেকটা এমনই। এই জায়গাতেই ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ আটকে গেছে।
কারণ, বর্তমান সরকারের অন্যতম উন্নয়ন সহযোগী চীন এই জায়গাতেই প্রবল আপত্তি করেছে। চীন কোনোভাবেই চায় না বাংলাদেশ যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে ভারত-প্রশান্ত মহাসাগরীয় নিরাপত্তা পরিকল্পনায় যোগ দিক। চীন ১৫ বছর ধরেই সময় নিয়ে বিভিন্ন প্রকল্পে বিনিয়োগ করে নিজস্ব অবস্থান তৈরি করেছে। চীনও তার প্রভাব বৃদ্ধিতে বাংলাদেশে সক্রিয়ভাবেই কাজ করছে। ফলে চীন শুরু থেকেই ঢাকায় যুক্তরাষ্ট্রের তৎপরতা নিয়ে কথা বলেছেন। চীনের রাষ্ট্রদূত ইয়াও ওয়েন বিভিন্ন সময়ে যুক্তরাষ্ট্রের গতিবিধি নিয়ে ঢাকায় কথা বলেছেন।
কিন্তু নির্বাচন ঘনিয়ে আসায় যুক্তরাষ্ট্রের কার্যকলাপ বেড়ে যাওয়ার সঙ্গে চীনের উদ্বেগ বেড়েছে। কোনো কারণে ক্ষমতার পালাবদল হলে বাংলাদেশে চীনের উচ্চ ঋণের বৃহৎ প্রকল্পের বিনিয়োগ ঝুঁকির মুখে পড়তে পারে। কারণ, সরাসরিই চীন এ দেশের জনসাধারণের বিপক্ষে অবস্থান নিয়েছে। জনগণের সরকার ক্ষমতায় এলে চীনের সঙ্গে সম্পর্ক খারাপ হবে না। তবে চীনের অবস্থান পুনর্মূল্যায়ন করা হবে, এটা নিশ্চিত। এই আশঙ্কা থেকেই চীন এবার তার বৈশ্বিক জোটকে সঙ্গে নিয়ে নেমেছে।
চীনের পাশাপাশি রাশিয়ার রাষ্ট্রদূত আলেকজান্ডার ভি মন্টিটস্কি দেশের নির্বাচন যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাব নিয়ে মন্তব্য করেছেন। রাশিয়া শুধু তার রাষ্ট্রদূতকে দিয়ে কথা বলিয়েই চুপ থাকেনি। সম্প্রতি রাশিয়ার পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় টুইট করেছে এবং এর মুখপাত্রও কথা বলেছেন। রাশিয়া অভিযোগ করেছে, যুক্তরাষ্ট্র আমাদের নির্বাচনব্যবস্থায় হস্তক্ষেপ করে নয়া উপনিবেশবাদ বাস্তবায়নের চেষ্টা করছে। বাংলাদেশকে ঘিরে যুক্তরাষ্ট্র ও রাশিয়ার প্রকাশ্য দ্বন্দ্বের শুরু গত বছরের শেষ দিকে। ওই সময় যুক্তরাষ্ট্রের দূত পিটার হাস গুম হওয়ার পরিবারের স্বজনদের সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছিলেন। সেখানে পিটার হাস হেনস্তার শিকার হন। এ বিষয়ে কড়া বিবৃতি দেয় যুক্তরাষ্ট্রের দূতাবাস। এর পাল্টাবিবৃতি দেয় রাশিয়ার দূতাবাস।
মূলত এর পর থেকেই কথার পিঠে কথা চলছে বাংলাদেশকে নিয়ে এই দুই দেশের মধ্যে। সর্বশেষ এই কথার লড়াইয়ে যোগ দিয়েছে আরেক কট্টরপন্থী দেশ ইরান। সম্প্রতি ইরানের রাষ্ট্রনিয়ন্ত্রিত টেলিভিশন প্রেস টিভির এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বাংলাদেশের রাজনীতিতে যুক্তরাষ্ট্র হস্তক্ষেপ করছে। ফলে বোঝাই যাচ্ছে, সুষ্ঠু নির্বাচন ও মানবাধিকারের কথা বলে বাংলাদেশে যুক্তরাষ্ট্রের নিজস্ব নীতি বাস্তবায়নকে বাধা দিতে চায় চীন ও রাশিয়া। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে ইরানও।
বিশ্বরাজনীতিতে যুক্তরাষ্ট্র এবং চীন-রাশিয়াকেন্দ্রিক যে মেরুকরণের কথা বলা হচ্ছে, তার স্পষ্ট প্রতিফলন বাংলাদেশের ক্ষেত্রে দেখা যাচ্ছে। এই দুই নতুন মেরুর কম-বেশি সব কটি দেশই বাংলাদেশের নির্বাচন নিয়ে কথা বলেছে। যুক্তরাষ্ট্র ও ইইউয়ের বাইরে যুক্তরাজ্য, জাপান অস্ট্রেলিয়া কথা বলেছে। আর বিপরীতে এখন উত্তর কোরিয়া ও বেলারুশ বাদ আছে। এই দুই দেশ আমাদের নির্বাচন ও রাজনীতি নিয়ে কথা বললে পুরো চক্র পূর্ণ হবে।
মজার বিষয় হচ্ছে, নির্বাচন নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থানের বিপরীতে যারা কথা বলছে, এসব দেশের কোনোটিতেই গণতন্ত্র নেই। চীন, রাশিয়া, ইরান—সবাই কার্যত একদলীয় কর্তৃত্ববাদী শাসন কায়েম করেছে। এসব দেশই নিজস্ব স্বার্থের কারণে অনেকটা আওয়ামী লীগের পক্ষে অবস্থান নিয়েছে। প্রশ্ন হচ্ছে, দেশগুলোও কি বাংলাদেশে একদলীয় শাসন ব্যবস্থা দেখতে চায়? অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে রাশিয়া, চীন ও ইরান বর্তমান সরকারকে রক্ষার জন্য মাঠে নেমেছে, কিন্তু জনসাধারণের বিপক্ষে যাওয়া এসব দেশের কোনোভাবেই ঠিক হবে না।
যুক্তরাষ্ট্র এখন নিজস্ব স্বার্থের কারণেই আমাদের নির্বাচন ও মানবাধিকার নিয়ে কথা বলছে। কারণ, যুক্তরাষ্ট্র এই অঞ্চলের ভূরাজনীতিতে তার হাতছাড়া হয়ে যাওয়া অবস্থান ফিরে পেতে চায়। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রও ২০১৪ ও ২০১৮ সালে চীন, ভারত, রাশিয়ার সঙ্গে বাংলাদেশ প্রশ্নে একই অবস্থানে ছিল। তবে ২০২৩ সালের এসে দেখা যাচ্ছে, যুক্তরাষ্ট্রকে ছাড়িয়ে চীন ও রাশিয়া বাংলাদেশে শক্ত অবস্থান তৈরি করেছে। ফলে কৌশল ও ভূরাজনীতির কারণে যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থান বদলেছে। যে কারণে বাংলাদেশ দুই পক্ষের ছায়া কূটনৈতিক যুদ্ধের ক্ষেত্রে পরিণত হয়েছে।
এই যুদ্ধে কারা জিতবে, তা বলা মুশকিল। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, দেশের ক্ষমতার শক্তি কি বহির্বিশ্ব নির্ধারণ করে দেবে? আমাদের জনসাধারণের মতামতের কি কোনো গুরুত্ব নেই? বিদেশি শক্তি যদি ক্ষমতার পালাবদলে চরিত্র ঠিক করে দেয়, তাহলে জনসাধারণ সার্বভৌম রইল কোথায়। আমাদের রাজনীতিতে স্বচ্ছ ও সততা না থাকার কারণে এমনটা হচ্ছে। কিন্তু জনসাধারণও ভূরাজনীতি ও বিশ্বরাজনীতির ছায়াযুদ্ধে নিজেদের ভূমিকা রাখতে পারে। রাজনৈতিক দলগুলোর যেকোনোভাবে ক্ষমতাকে ধরে রাখার প্রবণতা ও এই সংস্কৃতির বিরোধিতা করতে হবে। বাংলাদেশকে ঘিরে যে কূটনৈতিক যুদ্ধ শুরু হয়েছে, সেই যুদ্ধের জয়-পারজয় নির্ধারণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারবে জনসাধারণ। তবে এ জন্য তাদের সক্রিয় হতে হবে। যদি তারা চায়, তবে তা আসলেই সম্ভব।
ড. মারুফ মল্লিক লেখক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক