সিনেটর বার্নি স্যান্ডার্স সম্ভবত যুক্তরাষ্ট্রের সবচেয়ে পরিচিত বামপন্থী রাজনীতিক। নিজেকে তিনি ‘গণতান্ত্রিক সমাজতন্ত্রী’ হিসেবে পরিচয় দিতে ভালোবাসেন। কেউ কেউ, যেমন ডোনাল্ড ট্রাম্প তাঁকে খোলামেলাভাবেই ‘কমিউনিস্ট’ হিসেবে ভর্ৎসনা করতে পছন্দ করেন। ‘এ লোকটির নাম শুনলেই আমার কমিউনিজমের কথা মাথায় আসে,’ ট্রাম্প এ কথা বলেছিলেন কয়েক বছর আগে।
এই স্যান্ডার্স মন্তব্য করেছেন, চলতি ছাত্র বিক্ষোভ প্রেসিডেন্ট বাইডেনের জন্য ‘তাঁর ভিয়েতনাম’ হয়ে উঠতে পারে। ১৯৬৮ সালে ভিয়েতনামবিরোধী বিক্ষোভের মুখে অনেকটা বাধ্য হয়ে দ্বিতীয়বার প্রেসিডেন্ট পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা থেকে সরে দাঁড়িয়েছিলেন লিন্ডন জনসন।
সবাই মানে, অধিকাংশ অভ্যন্তরীণ প্রশ্নে জনসন বেশ উদারনৈতিক ছিলেন। কালো মানুষদের ভোটাধিকার আইন তাঁর সময়েই গৃহীত হয়েছিল। স্বাস্থ্যবিমা ও সামাজিক নিরাপত্তা আইন প্রণয়ন, তা–ও জনসনের সাফল্যের খাতায়। অথচ তাঁর জায়গায় সে বছর প্রেসিডেন্ট পদে নির্বাচিত হয়েছিলেন ঘোর দক্ষিণপন্থী রিপাবলিকান প্রার্থী রিচার্ড নিক্সন।
বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রজুড়ে গাজায় ইসরায়েলে অব্যাহত ফিলিস্তিনি জাতি হত্যার বিরুদ্ধে যে বিক্ষোভ চলছে, সে কথা ধরেই স্যান্ডার্সের এই মন্তব্য।
তিনি খোলামেলাভাবেই এই ছাত্রবিক্ষোভের একজন সমর্থক। তিনি নিজে শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র থাকাকালে ১৯৬৩ সালে নাগরিক অধিকারের পক্ষে বিক্ষোভকালে বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি ভবন দখলে অংশ নিয়েছিলেন। সে কারণে তাঁকে পুলিশের হাতে গ্রেপ্তার হতে হয়েছিল। ফলে এটা মোটেই বিস্ময়ের কোনো ব্যাপার নয় যে ইসরায়েলের হাতে গাজার হত্যাযজ্ঞের তিনি একজন প্রধান সমালোচক।
স্যান্ডার্সের এই অবস্থান যে ব্যতিক্রমী, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। অধিকাংশ মার্কিন রাজনীতিক ইসরায়েলের বিরুদ্ধে টুঁ শব্দটি তুলতেও রাজি নন। প্রেসিডেন্ট বাইডেন নিজে ইসরায়েলের একজন প্রধান সমর্থক হয়ে উঠেছেন।
এ দেশে রাজনীতিতে সফল হতে হলে ইসরায়েলের সমালোচনা বা বিরুদ্ধাচরণ করে টিকে থাকা কার্যত অসম্ভব। সেদিক দিয়ে বার্নি স্যান্ডার্স উল্টো হাওয়ার পন্থী।
সম্প্রতি মার্কিন কংগ্রেসে ইহুদি রাষ্ট্র হিসেবে ইসরায়েলের সমালোচনাকে ‘অ্যান্টি-সেমেটিক’ বা ইহুদিবিদ্বেষ হিসেবে চিহ্নিত করে একটি প্রস্তাব গৃহীত হয়েছে। রিপাবলিকান ও ডেমোক্র্যাট উভয় দলের অধিকাংশ সদস্য এই প্রস্তাবের পক্ষে ভোট দিয়েছেন। একমাত্র স্যান্ডার্সই বলেছেন, ইসরায়েলের সমালোচনা করার অর্থ ইহুদিবিদ্বেষ নয়।
স্যান্ডার্স যে গাজায় অব্যাহত হত্যাকাণ্ডের বিরুদ্ধে ছাত্রবিক্ষোভকে ‘বাইডেনের ভিয়েতনাম’ বলেছেন, তার যথেষ্ট কারণ রয়েছে। যাঁরা এই বিক্ষোভে অংশ নিচ্ছেন এবং যাঁরা বিক্ষোভে অংশ না নিলেও ইসরায়েলের প্রতি চলতি মার্কিন নীতিতে বীতশ্রদ্ধ, তাঁদের একাংশও যদি আগামী নির্বাচনে বাইডেনের বিরুদ্ধে ভোট দেন অথবা প্রতিবাদ হিসেবে ভোটদানে বিরত থাকেন; তাহলে তাঁর পরাজয় ঠেকানো কঠিন হবে।
স্মরণ করা যেতে পারে, ২০২০ সালে জর্জিয়া, অ্যারিজোনা ও উইসকনসিনে সম্মিলিতভাবে মাত্র ৪৪ হাজার ভোটের ব্যবধানে তিনি ট্রাম্পের বিরুদ্ধে জয়ী হয়েছিলেন। এই তিন রাজ্যে শুধু যে ছাত্র-যুবক ভোটার রয়েছেন তা–ই নয়, ভারী সংখ্যায় আরব ও মুসলিম ভোটার রয়েছেন। তাঁরাও যদি একই পথ ধরেন, তাহলে বাইডেনের ভরাডুবি ঠেকানো মুশকিল।
একাধিক মুসলিম সংগঠন ইতিমধ্যে ‘বয়কট বাইডেন’ নামে প্রচার অভিযান চালাচ্ছে। তাদের প্রচারের ফলেই বাছাই পর্যায়ে তিনটি রাজ্যে গড়ে ১৫ শতাংশ ডেমোক্রেটিক ভোটার বাইডেনকে ভোট না দিয়ে ‘আন-কমিটেড’ বা সিদ্ধান্ত নিইনি হিসেবে ভোট দিয়েছেন।
অনুমান করি, যাঁরা বাইডেনের গাজা নীতির জন্য তাঁর ব্যাপারে সিদ্ধান্তহীনতায় রয়েছেন, তাঁরা ট্রাম্পকে ভোট দেবেন না। সম্ভবত তাঁদের অনেকেই হয়তো আদৌ ভোট দিতে যাবেন না। তাতেও ফলাফল একই হবে, অর্থাৎ অল্প ব্যবধানে হলেও বাইডেন পরাস্ত হবেন।
২০১৬ সালে হিলারি ক্লিনটন ঠিক এভাবেই ট্রাম্পের হাতে অবিশ্বাস্যভাবে ঠকে গিয়েছিলেন। ২০১২ সালে প্রেসিডেন্ট ওবামার তুলনায় কোনো কোনো রাজ্যে ১০ শতাংশের বেশি আফ্রিকান-আমেরিকান ও লাতিনো ভোটার তাঁকে ভোটদানে বিরত ছিলেন।
বিক্ষোভরত ছাত্রছাত্রীরা এমন সম্ভাবনার কথা পুরোপুরি অবহিত। বাংলাদেশে জন্ম, কিন্তু এ দেশে বড় হওয়া এক ছাত্রীর সঙ্গে আলাপ হলো। মেয়েটি হ্যামিলটন হলের অবরোধে অংশ নেয়, সে জন্য গ্রেপ্তারও হয়।
তাকে জিজ্ঞেস করলাম, ট্রাম্প ফের ক্ষমতায় আসুক, তুমি কি তা চাও? মেয়েটির জবাব, ‘বাইডেন বা ট্রাম্প, আমাদের জন্য দুজনই তো এক, তাঁদের মধ্যে তো প্রকৃত পার্থক্য নেই।’
আরেক ছাত্রী, বিক্ষোভে থাকার বিপদ সম্বন্ধে সাবধান করে দিলে আমাকে জানাল, ‘আমাদের হারানোর খুব বেশি কিছু নেই। আমাদের বিশ্বাস, আমরা সঠিক পথে আছি।’ ইংরেজিতে মেয়েটি বলল, ‘উই আর অন দ্য রাইট সাইড অব হিস্টরি।’
ডেনভার বিশ্ববিদ্যালয়ে আমার এক বাংলাদেশি অধ্যাপক বন্ধু জানালেন, চলতি প্রজন্মের অধিকাংশ ছাত্রছাত্রী রাজনৈতিক প্রক্রিয়া থেকে বিচ্ছিন্ন বোধ করে। চলতি বিক্ষোভের সেটাই আসল কারণ। তারা মনে করে, যে সামরিক-শিল্প কমপ্লেক্স চলতি রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক ব্যবস্থার পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ গ্রহণ করেছে, সেখানে তাদের কোনো স্থান নেই, তাদের কণ্ঠস্বরেরও কোনো মূল্য নেই।
ডেনভার বিশ্ববিদ্যালয়ে আমার এক বাংলাদেশি অধ্যাপক বন্ধু জানালেন, চলতি প্রজন্মের অধিকাংশ ছাত্রছাত্রী রাজনৈতিক প্রক্রিয়া থেকে বিচ্ছিন্ন বোধ করে। চলতি বিক্ষোভের সেটাই আসল কারণ। তারা মনে করে, যে সামরিক-শিল্প কমপ্লেক্স চলতি রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক ব্যবস্থার পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ গ্রহণ করেছে, সেখানে তাদের কোনো স্থান নেই, তাদের কণ্ঠস্বরেরও কোনো মূল্য নেই।
যে চিরস্থায়ী যুদ্ধাবস্থা নীতি হিসেবে মার্কিন প্রশাসন গ্রহণ করেছে, সে রিপাবলিকানই হোক অথবা ডেমোক্রেটিক, তাতে এই প্রজন্ম আশান্বিত হওয়ার মতো কিছুই দেখে না।
চলতি বিক্ষোভ আন্দোলনের নেতৃত্বে রয়েছে যেসব সংগঠন, তার একটি হলো ‘ডিসেন্ট’। তাদের কথায়, যুদ্ধবাজদের হাতে শুধু তাদের নয়, যুক্তরাষ্ট্রের প্রান্তবর্তী সব মানুষের ভবিষ্যৎ জিম্মি হয়ে রয়েছে। বাসস্থান, শিক্ষা বা স্বাস্থ্য রক্ষার জন্য প্রয়োজনীয় সম্পদ তাদের রয়েছে। কিন্তু সে সম্পদ কাজে লাগানোর বদলে ব্যয় হচ্ছে অন্তহীন যুদ্ধ, ব্যক্তিগত ক্ষমতা ও মুনাফার জন্য। ক্ষমতায় টিকে থাকার জন্য তাদের রয়েছে দুটি অস্ত্র; প্রচার ও ভীতির ব্যবহার।
সংগঠনটি বলছে, ‘যারা ক্ষমতায় বসে, তাদের দাবি আমাদের নিরাপদ রাখার জন্য যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়া দরকার। তারা বলে, এ দেশের কৃষ্ণকায়রা বিপজ্জনক, তাদের সামলাতে প্রয়োজন সামরিক মানের অস্ত্রসামগ্রী। বিক্ষোভকারীরা শান্তি ভঙ্গ করছে, সে জন্য তাদের আঘাত করতে হবে এবং জেলে ঢোকাতে হবে। সন্ত্রাসীরা আমাদের গণতন্ত্র ও নিরাপত্তা বিঘ্নিত করছে, অতএব মুসলিম সম্প্রদায়কে নজরদারিতে আনতে হবে। বহিরাগতরা মাদক পাচারকারী ও চোর, অতএব সীমান্ত প্রহরা বাড়াতে হবে। অন্য কথায় যারা সামরিকীকরণের ফলে নিষ্পেষিত, তারাই নাকি আমাদের নিরাপত্তার জন্য হুমকি। তাদের এই প্রচারের লক্ষ্য আমাদের একে অপরের ব্যাপারে ভীত করে তোলা। কী মজার ব্যাপার, সবচেয়ে বেশি ভয় তাদের নিয়ে যারা সবচেয়ে দুর্বল।’
আমি নিজে দীর্ঘদিন যুক্তরাষ্ট্রের বাসিন্দা, কিন্তু বিষয়টি কখনো এভাবে বিচার করে দেখিনি। আমার প্রজন্মের সদস্যরা, যারা নিজেদের প্রগতিশীল মনে করি, তারা এখনো তথ্যের জন্য সর্বতোভাবে নির্ভর করি মূলধারার তথ্যমাধ্যমের ওপর, যে তথ্যমাধ্যম আদ্যোপান্ত স্ট্যাটাস কো বা চলতি ব্যবস্থা টিকিয়ে রাখতে চৌপ্রহর নিয়োজিত।
নতুন প্রজন্মের অবস্থাটি ভিন্ন। তারা তথ্য অথবা তত্ত্বের জন্য নির্ভর করে বিকল্প তথ্যমাধ্যমের ওপর। ফেসবুক বা ইনস্টাগ্রাম ছাপিয়ে অন্যতম প্রধান তথ্যসূত্র হয়ে উঠেছে টিকটক।
যুক্তরাষ্ট্রে ১৫ থেকে ১৭ বছর বয়সীদের ৭০ শতাংশের অধিক টিকটক থেকেই তাদের দৈনিক তথ্য পেয়ে থাকে।
‘আর ঠিক সে জন্যই এই টিকটককে নিষিদ্ধ করতে চায় বাইডেন প্রশাসন,’ আমাকে কথাটা জোর দিয়ে বলল এমোরি বিশ্ববিদ্যালয়ের এক ছাত্র।
শেষ করার আগে বার্নি স্যান্ডার্সের কথায় ফিরে যাই। সিএনএনকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছেন, ‘ছাত্র-যুবকেরা যে বিক্ষোভে ফেটে পড়েছে, তার অবশ্যই কারণ রয়েছে। তাদের দাবি, ইসরায়েলের দক্ষিণপন্থী নেতানিয়াহু সরকারকে অস্ত্র সরবরাহ বন্ধ করতে হবে। ইসরায়েলের এই সরকার ফিলিস্তিনি জনগণকে ধ্বংস করতে এক ভয়াবহ যুদ্ধে লিপ্ত। আমি আশা করব, শুধু নৈতিক কারণে নয়, পলিসিগত কারণেও বাইডেন প্রশাসন নেতানিয়াহুকে যা খুশি করার জন্য, ব্ল্যাঙ্ক চেক দেওয়া বন্ধ করবে।’
বাইডেন বলেছেন, ইসরায়েলের প্রতি তাঁর প্রদত্ত অঙ্গীকার লৌহবেড়ির মতো শক্ত ও স্থায়ী। তাঁর পক্ষে কি সম্ভব হবে একজন বামপন্থী রাজনীতিকের এই পরামর্শ মেনে নতুন পথে চলা?
৬ মে ২০২৪, নিউইয়র্ক
● হাসান ফেরদৌস প্রাবন্ধিক ও কলাম লেখক