১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে সামরিক বাহিনীর অনেক বাঙালি সদস্যের মতো ক্যাপ্টেন বজলুল গনি পাটোয়ারী পাকিস্তানে আটকে পড়েন । মেজর তাহের, মেজর জিয়াউদ্দিন ও মেজর মঞ্জুরের সঙ্গে তিনি সীমান্ত পেরিয়ে ভারতে প্রবেশ করেন এবং পরে মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেন। তাঁর এসব অভিজ্ঞতা নিয়ে প্রথমা প্রকাশন থেকে সম্প্রতি নাসির উদ্দিন আহাম্মেদের সম্পাদনায় শত্রুভূমি থেকে সম্মুখসমরে নামে একটি বই প্রকাশিত হয়েছে। বিজয়ের মাস উপলক্ষে সেই বই থেকে কিছু চুম্বক অংশ দুই পর্বে প্রথম আলোর পাঠকের জন্য প্রকাশ করা হচ্ছে। আজ প্রকাশিত হলো প্রথম পর্ব।
১৯৭১ সালের ২৫ জুলাই। এদিন ঝিলাম থেকে দেশের উদ্দেশে আমার রওনা দেওয়ার ঘটনা ছিল অনেকটাই নাটকীয়। ফায়ারিং রেঞ্জে ঝগড়া আর কর্নেল মাজহারুল কাইউমের মৃত্যুর পর আমি অনেক বাঙালি কর্মকর্তাকে দেশে চলে আসার ব্যাপারে উৎসাহ দিতাম এবং তাঁদের এতটাই খোলাখুলিভাবে বলতাম যে অনেকেই সেটি বিশ্বাস করতে চাইতেন না।
ঝিলাম ক্যান্টনমেন্ট ছেড়ে যেদিন আমি চলে আসি, তার আগের দিন ছিল শনিবার। প্রতি শনিবার সন্ধ্যায় বিশেষ করে বাঙালি কর্মকর্তা ও সৈনিকদের জন্য ঝিলাম গ্যারিসন সিনেমা হলে বাংলা ছবি দেখানো হতো। সেদিন ছবি দেখতে গিয়ে আমি সিনেমা হলের ভেতরে প্রকাশ্যেই বাঙালি কর্মকর্তাদের সামনে ঘোষণা করলাম যে আমি আগামীকাল দেশে চলে যাচ্ছি; কিন্তু তাঁদের কেউ আমার কথায় গুরুত্ব দিতে চাইলেন না। কেউ কেউ হেসেই উড়িয়ে দিলেন।
মোটকথা, কেউ আমার কথাটা বিশ্বাস করলেন না। এমনকি আমি নিজেও নিশ্চিত ছিলাম না যে আগামীকাল সত্যিই দেশের উদ্দেশে রওনা হয়ে যাব। মেজর তাহেরের সঙ্গে এক সপ্তাহ ধরে আমার কোনো যোগাযোগ ছিল না। আমাদের ফক্সওয়াগন গাড়ির অবস্থা সম্বন্ধেও পুরোপুরি জানতাম না। তবে আমার একটা আন্দাজ ছিল যে তাঁরা এলে যেকোনো রোববারেই আসবেন, যেহেতু রোববারে সাপ্তাহিক ছুটি থাকে, তাই সেদিনই তাঁদের আসার সম্ভাবনা সবচেয়ে বেশি।
সেদিন সিনেমা দেখে সরাসরি মেসে চলে এলাম। রাতে নিশ্চিন্ত ও নির্ভার মনে ঘুমালাম। পরের দিন সকালে ঘুম থেকে জেগে গোসল ও নাশতা সেরে নিলাম। নয়টার দিকে আমি অফিসার্স মেসে আমার রুমে এসে ঝিলাম শহরে একটু কেনাকাটা করতে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলাম এবং সেই মোতাবেক পোশাক পরছিলাম। এমন সময় বেশ উৎসুক হয়ে দু-তিনজন বাঙালি কর্মকর্তা রুমে এলেন।
হয়তো আগের রাতে সিনেমা হলে আমার ঘোষণার সূত্র ধরেই তাঁরা দেখতে এসেছিলেন আমি কী করছি। তাঁরা আমার রুমে এসে গল্পগুজব জুড়ে দিলেন। এ সময় আমি হঠাৎ জানালা দিয়ে দেখতে পেলাম, খানিকটা দূরে রাস্তা দিয়ে একটা ফক্সওয়াগন গাড়ি আমাদের অফিসার্স মেসের দিকেই আসছে। গাড়িটা দেখামাত্র আমার মন সায় দিয়ে ওঠে। এ নিশ্চয়ই আমাদের সেই গাড়ি। যদিও সেদিন গাড়ি আসার নিশ্চিত কোনো কথা ছিল না।
গাড়িটা বেশ দূরে থাকতেই আমার রুমে আসা কর্মকর্তাদের উদ্দেশে আমি বললাম, ‘জেন্টলমেন, আই হ্যাভ গট সাম গেস্ট।’ কথাটা বলেই আমি এককাপড়ে রুম থেকে বেরিয়ে এলাম। এমনকি আমার মানিব্যাগ ও পরিচয়পত্রও সঙ্গে নিলাম না। পরে অবশ্য এই পরিচয়পত্রের অভাবে কিছু কিছু জায়গায় আমাকে বেশ অসুবিধায় পড়তে হয়েছিল। যা-ই হোক, আমি দ্রুত রাস্তার দিকে এগিয়ে গেলাম যেন গাড়িটা আমার রুমের কাছাকাছি আসতে না হয়। আমি তখন চাইনি যে আমার কক্ষে অপেক্ষমাণ কর্মকর্তারা এই গাড়ি আগমনের ব্যাপারটা টের পান। কারণ, গাড়ি দেখলেই তাঁদের মনে প্রশ্ন জাগবে এরা কারা? কিংবা তাঁদের মনে এমন কোনো সন্দেহ জেগে উঠত, যার ফলে আমাদের দেশে আসার পুরো উদ্যোগটাই ব্যর্থ হওয়ার আশঙ্কা ছিল।
গাড়ি কাছাকাছি আসতেই আমি দেখতে পেলাম, ড্রাইভারের পাশে সামনের সিটে বসে আছেন মেজর তাহের। গাড়ির চালক তখন পর্যন্ত আমার কাছে অপরিচিত। পরে পরিচয় পাই, ইনিই মেজর জিয়াউদ্দিন। গাড়িতে চেপে আমরা তিনজন প্রথমে যাই ঝিলাম ক্যান্টনমেন্টের গ্যারিসন ক্লাবে। সেখানে বসে তিনজন পেট পুরে মুরগির রোস্ট খাই। এরপর বেলা দেড়টার দিকে গ্যারিসন ক্লাব থেকে গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে পড়ি।
ঝিলাম থেকে শিয়ালকোট
ঝিলাম থেকে আমরা গ্র্যান্ড ট্রাঙ্ক (জিটি) রোড ধরে এগিয়ে চলি পাকিস্তানের গুজরাট জেলার তান্ডা সীমান্তের দিকে। এই রাস্তার পাশেই খারিয়ান। আমরা খারিয়ানে না থেমে সোজা এগিয়ে গেলাম গুজরাটের দিকে। খারিয়ান ও গুজরাটের মাঝামাঝি জায়গায় এসে দেখলাম, রাস্তার ওপর বিরাট লম্বা আর্মি কনভয় দাঁড়িয়ে আছে। এই কনভয় দেখে আমরা একটু অপ্রস্তুত হয়ে পড়লাম। হঠাৎ কেন এত সৈন্য সীমান্তের দিকে যাচ্ছে? সীমান্তের অবস্থা কি তাহলে অশান্ত? বিশাল মিলিটারি কনভয় দেখে কী করব বুঝতে পারছিলাম না। কনভয় খুব ধীরগতিতে চলে। তাই কনভয়ের পেছনে পেছনে যাওয়া সম্ভব নয়। রাস্তায় দাঁড়িয়ে থাকাও বিপজ্জনক। আবার কনভয় অতিক্রম করে সামনের দিকে এগিয়ে গেলে যে কেউ থামিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করতে পারে। সব দিকেই যখন বিপদ, তখন মেজর জিয়াউদ্দিন দাঁতে দাঁত চেপে গাড়ির গতি বাড়িয়ে দিলেন। ভয়ে ভয়ে কনভয় পার হলাম। আল্লাহর নাম নিয়ে দ্রুতগতিতে এগিয়ে চললাম সীমান্তের দিকে। কনভয় দেখে কিছুটা হতোদ্যম হয়ে পড়লেও আমরা ঠিকই আমাদের গন্তব্যের দিকে এগিয়ে যেতে লাগলাম, যদিও কিছুটা ভয়ে ভয়ে ছিলাম। আমরা তান্ডায় পৌঁছালাম বেলা আড়াইটার দিকে। তান্ডা থেকে সীমান্তের দূরত্ব বড়জোর চার কি পাঁচ মাইল। তান্ডায় এসে আমরা দু-একটা দোকানে খোঁজখবর নিই যে সীমান্তে কোনো গন্ডগোল হচ্ছে কি না। তবে কোনো গন্ডগোল না হলেও দিনের আলোয় আমাদের জন্য সীমান্ত অতিক্রম করাটা প্রায় দুঃসাধ্য ছিল।
আসলে তান্ডা ছিল সীমান্তবর্তী ছোট একটা জনপদ। সেখানকার লোকজনের কাছে তখন পর্যন্ত বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের কথা খুব একটা পৌঁছায়নি বলে মনে হলো; কিন্তু সীমান্ত এলাকা বলে সেখানে সরকারের এজেন্টদের ছড়াছড়ি ছিল। সীমান্তের দিকে কোনো অপরিচিত লোককে যেতে দেখলেই তারা সন্দেহ করত। তা ছাড়া দিনের বেলায় অবৈধভাবে সীমান্ত অতিক্রম করতে গেলে গুলিতে আহত বা নিহত হওয়ারও আশঙ্কা ছিল। কাজেই রাতের অন্ধকারে লোকচক্ষু এড়িয়ে সীমান্ত অতিক্রম করা ছাড়া আমাদের কোনো গত্যন্তর ছিল না।
দিনের বেলায় তান্ডার মতো জায়গায় অত সময় ধরে অবস্থান করা আমাদের জন্য নিরাপদ ছিল না। অপরিচিত লোককে ঘোরাঘুরি করতে দেখলে স্বাভাবিকভাবেই লোকের মনে সন্দেহ জাগবে। এসব চিন্তা করেই মেজর তাহের ও মেজর জিয়াউদ্দিন আলোচনা করে ঠিক করলেন শিয়ালকোটে মেজর মঞ্জুরের বাসায় যাওয়া যাক।
মেজর মঞ্জুর তখন শিয়ালকোট ক্যান্টনমেন্টে আর্মি ইনডিপেনডেন্ট প্যারা ব্রিগেডের প্রধান স্টাফ অফিসার (ব্রিগেড মেজর) ছিলেন। মেজর মঞ্জুর সেনাবাহিনীর একজন অতি মেধাবী কর্মকর্তা ছিলেন। মঞ্জুরের এই পদ ছিল খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এই আর্মি ইনডিপেনডেন্ট প্যারা ব্রিগেড ছিল পাকিস্তান আর্মির রিজার্ভ ব্রিগেড। আর আর্মির রিজার্ভ ব্রিগেড হওয়ায় মেজর মঞ্জুর পাকিস্তান আর্মির প্ল্যানিং ও মুভমেন্ট সম্পর্কে অনেক তথ্যই জানতে পারতেন। কোনো বাঙালি কর্মকর্তার জন্য মেজর মঞ্জুরের তখনকার পদটি ছিল রীতিমতো দুর্লভ বিষয়। শিয়ালকোটে গিয়ে সেবারই মেজর মঞ্জুরের সঙ্গে আমার প্রথম পরিচয় হয়। মেজর মঞ্জুর পরবর্তী সময়ে মেজর জেনারেল হন এবং জিয়া হত্যাকাণ্ডের পর নিজেই হত্যাকাণ্ডের শিকার হন।
আমরা তান্ডায় আধা ঘণ্টার মতো অবস্থান করার পর শিয়ালকোটের উদ্দেশে রওনা হই। তান্ডা থেকে শিয়ালকোটের দূরত্ব খুব বেশি নয়, সম্ভবত ২৫-৩০ মাইল। আমরা ঠিক করলাম, শিয়ালকোটে গিয়ে সন্ধ্যা পর্যন্ত কাটিয়ে তারপর আবার তান্ডায় ফিরব। কেননা, এই রুট ছিল আমাদের একমাত্র জানা রুট। অন্য কোনো রুট সম্পর্কে আমাদের তেমন একটা ধারণা ছিল না। আমাদের দৃঢ়বিশ্বাস ছিল, সীমান্ত অতিক্রম করে কোনোরকমে ভারতের মাটিতে পা রাখতে পারলেই হলো। তারপর আমরা ঠিকই দেশে পৌঁছে যাব এবং মুক্তিযুদ্ধে শরিক হতে পারব।
ঘণ্টাখানেকের মধ্যেই আমরা পৌঁছে গেলাম শিয়ালকোটে। ক্যান্টনমেন্ট এলাকায় গিয়ে মেজর মঞ্জুরের কোয়ার্টার খুঁজে পেতে তেমন দেরি হলো না। মেজর মঞ্জুর বাসাতেই ছিলেন। আমাদের এভাবে দেখে প্রথমে তিনি তো ভীষণ অবাক। পরে অবশ্য চা-নাশতা দিয়ে আমাদের স্বাভাবিকভাবেই আপ্যায়ন করলেন।
...
জিয়াউদ্দিন আমাদের ড্রয়িংরুমে বসিয়ে রেখে মঞ্জুরের সঙ্গে অন্য একটা রুমে গিয়ে গোপন আলাপে মিলিত হলেন। কিছুক্ষণ পর জিয়াউদ্দিন এসে আমাদের জানালেন যে মেজর মঞ্জুর দেশে যাওয়ার জন্য খুবই আগ্রহী। এমনকি এ ব্যাপারে তিনি আলাদা একটা প্ল্যানও তৈরি করে রেখেছেন।
আমার ভেতরে তখন তোলপাড় করা চাঞ্চল্য।
রাতের অন্ধকারে রওনা দেওয়ার আয়োজন
মেজর মঞ্জুরের প্ল্যান আমরা খতিয়ে দেখলাম এবং বুঝতে পারলাম, আমাদের অরিজিনাল রুটের চেয়ে এই রুটেই পালানো বেশি সহজ হবে। এর প্রধান কারণ, আমরা গাড়িতে চড়েই বর্ডারের সর্বোচ্চ ছয়-সাত কিলোমিটারের মধ্যে চলে যেতে পারব। এ ছাড়া আমাদের সঙ্গে সীমান্ত এলাকার যে ম্যাপ ছিল, সেই ম্যাপ দেখে বোঝা গেল, মেজর মঞ্জুরের রুট দিয়ে যাওয়াটাই সুবিধাজনক। নিজেদের মধ্যে আলাপ-আলোচনা করে ঠিক করলাম, মেজর মঞ্জুরের প্রদর্শিত রুট দিয়েই আমরা যাব।
কিন্তু প্রশ্ন দেখা দিল মেজর মঞ্জুরের স্ত্রী ও সন্তানদের নিয়ে। তাঁদের কী হবে? মেজর মঞ্জুর জানান, তিনি একা পাকিস্তান ত্যাগ করবেন না আর তাঁর স্ত্রীও যেতে আগ্রহী। তিনি তাঁদের সঙ্গে নিয়েই যাবেন। তবু নানা প্রশ্ন দেখা দিল—রাস্তায় যদি কোনো অঘটন ঘটে, বিশেষ করে পাকিস্তানি সৈন্যদের মুখোমুখি হলে আমরা কি সারেন্ডার করব? আলোচনা করে ঠিক করলাম যে পাকিস্তানিদের মুখোমুখি হলে আমরা কখনোই সারেন্ডার করব না। কোনো উপায় না থাকলে নিজেরাই নিজেদের গুলিতে আত্মহত্যা করব। কিন্তু নতুন প্রশ্ন দেখা দিল, আমরা নাহয় আত্মহত্যা করব, কিন্তু মঞ্জুরের কী হবে? তিনি যদি আত্মহত্যা করেন, তাহলে তাঁর স্ত্রী ও ছেলেমেয়েদের কী হবে? অন্যদিকে কোনো সংঘর্ষে যদি তাঁর স্ত্রী আহত হয়ে আমাদের সঙ্গে যেতে না পারেন, তাহলে তাঁর উপায় কী হবে?
একপর্যায়ে আমাদের এসব প্রশ্নের উত্তর মিসেস মঞ্জুর দিয়ে বললেন, পথে যদি মেজর মঞ্জুরের কিছু হয়, তাহলে তিনি স্বামী ও ছেলেমেয়ে নিয়ে ওখানেই থেকে যাবেন এবং প্রয়োজনে আমরা চলে যাব। আর পথে মিসেস মঞ্জুর কোথাও আহত হলে তাঁকে যেন মেরে ফেলা হয়, কোনো অবস্থাতেই পাকিস্তানি সৈন্যদের হাতে তাঁকে যেন জীবিত তুলে দেওয়া না হয়। এমন পরিস্থিতিতে মেজর মঞ্জুর যেন বাচ্চাদের নিয়ে চলে যান।
মেজর মঞ্জুরের স্ত্রী ও ছেলেমেয়ের ব্যাপারে একটা বোঝাপড়া হলেও তাঁর ব্যাটম্যানকে নিয়ে আরেক সমস্যা দেখা দিল। ব্যাটম্যান ছিলেন সাপ্লাই কোরের একজন বাঙালি সিপাহি। তাঁর বাড়ি ফরিদপুরে। তাঁকে রেখে গেলে বিপদের আশঙ্কা ছিল। কারণ, তিনি আমাদের যাওয়ার কথা ফাঁস করে দিতে পারেন। আবার তাঁকে আমাদের পরিকল্পনার কথা জানানোটাও ঝুঁকিপূর্ণ ছিল এ কারণে যে তিনি যদি সঙ্গে আসতে রাজি না হনÑ ব্যাপারটা নিয়ে আমরা বেশ চিন্তাভাবনা করলাম। এদিকে সময়ও গড়িয়ে যাচ্ছিল। অবশেষে আমরা ব্যাটম্যানকে মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেওয়ার ব্যাপারটা জানানোর সিদ্ধান্ত গ্রহণ করি। মেজর মঞ্জুর তাঁকে এ কথা বলতেই তিনি রাজি হয়ে যান।
এরপর শুরু হয় আমাদের রওনা দেওয়ার আয়োজনের পালা। আমরা তিনজন আগে থেকেই তৈরি ছিলাম। এবার মঞ্জুর, তাঁর স্ত্রী ও ছেলেমেয়েরা তৈরি হতে থাকে। মঞ্জুরের এক মেয়ে ও এক ছেলে। মেয়ে মিতার বয়স তখন পাঁচ বছর এবং ছেলে সাফকাতের বয়স দুই বছর। ওদের বয়স কম হওয়ায় রাস্তায় ওরা ঝামেলা বা কান্নাকাটি করতে পারে, তাই তাদের সিডাক্সিন দেওয়া হলো, যাতে তারা ঘুমিয়ে থাকে। আমরা রওনা হওয়ার আগে ব্যক্তিগত অস্ত্রে নিজেদের সজ্জিত করি। আমাদের ফক্সওয়াগন গাড়িটা ছিল বেশি পুরোনো। তাতেই আটজনকে চড়তে হবে।
আমাদের দেখে কেউ যাতে চিনে না ফেলে কিংবা কারও মনে কোনো রকম সন্দেহ না জাগে, সে জন্য সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়, গাড়ি ড্রাইভ করবেন মঞ্জুর এবং কালো বোরকা পরে পাশের সিটে থাকবেন তাঁর স্ত্রী। উল্লেখ্য, মিসেস মঞ্জুরের গায়ের রং ও গঠন এমন ছিল যে কালো বোরকার ফাঁকফোকর দিয়ে মুখের সামান্য অংশও দেখা গেলে তাঁকে পাঞ্জাবি মহিলা বলে ভুল করার সম্ভাবনা ছিল। এ ছাড়া বাচ্চারা তাঁর কোলে থাকায় একটা সুবিধা ছিল এই যে আমরা যে পালিয়ে যাচ্ছি, সেটি কারও পক্ষে সহজে ধারণা করা সম্ভব ছিল না। এত ছোট বাচ্চা নিয়ে পাকিস্তান থেকে পালিয়ে আসার ঘটনা সম্ভবত সেটিই প্রথম, তা-ও পায়ে হেঁটে।...
কর্নেল (অব.) বজলুল গনি পাটোয়ারী সাবেক সামরিক কর্মকর্তা। মুক্তিযুদ্ধে বীরত্বপূর্ণ ভূমিকার জন৵ বীর প্রতীক খেতাব পেয়েছেন।