গাজায় ইসরায়েলের হামলায় নিহত এক ফিলিস্তিনিকে নিয়ে যাচ্ছেন স্বজনেরা
গাজায় ইসরায়েলের হামলায় নিহত এক ফিলিস্তিনিকে নিয়ে যাচ্ছেন স্বজনেরা

মতামত

গাজা নিয়ে আইনি লড়াইয়ের খবর যেভাবে চাপা দেওয়া হচ্ছে

বৈশ্বিক রণক্ষেত্র যখন দ্রুত প্রসারিত হয়ে পড়ছে, ঠিক এমনই এক সময়ে গাজায় ইসরায়েলের গণহত্যামূলক হামলার সমর্থক ও বিরোধীরা অন্য একটি রণাঙ্গণে মুখোমুখি হচ্ছে। সেটি হলো: আদালত কক্ষ।

গণহত্যাকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করতে পারা আন্তর্জাতিক আইন ও কনভেনশনগুলোর আসলেই মূল্য আছে এবং এসব আইন ও সনদের জরুরি বাস্তবায়ন দরকার বলে যেসব আইনজীবী, মানবাধিকার কর্মী, সংগঠন এবং রাষ্ট্র বিশ্বাস করে, তারা গত ছয় মাসে জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক আদালতে নজিরবিহীন সংখ্যক মামলা করেছে। তারা গণহত্যামূলক হামলার বিরুদ্ধে ভূরি ভূরি তথ্য উপাত্ত আদালতে পেশ করছে।

এই অভূতপূর্ব আইনি সংহতি ইসরায়েলের সরকারকে ইতিমধ্যেই চিন্তায় ফেলে দিয়েছে। তারা গণহত্যার অভিযোগ থেকে বাঁচতে তাদের পশ্চিমা মিত্রদের সাহায্য চাচ্ছে।

অন্যদিকে, গাজায় নিজেদের কর্মকাণ্ড নিয়ে ইসরায়েল যে আইনি চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছে তা মোকাবিলায় ইসরায়েলি সেনাবাহিনী ইতিমধ্যে একটি আন্তর্জাতিক আইন বিভাগই প্রতিষ্ঠা করে ফেলেছে। কিন্তু তারপরও পশ্চিমের মূলধারার সংবাদমাধ্যমগুলো এই ঘটনাগুলো গভীরভাবে তলিয়ে দেখা থেকে প্রায়শই বিরত থাকছে।

যেহেতু যুক্তরাষ্ট্র ও অন্যান্য অনেক পশ্চিমা সরকারকে ইসরায়েলের গণহত্যামূলক অপরাধের প্রধান ইন্ধনদাতা হিসাবে মনে করা হয়, সম্ভবত সে কারণেই তারা এসব খবর নিয়ে ঘাঁটাঘাঁটি করতে চায় না। অথবা হয়তো পশ্চিমের মিত্র দেশ ইসরায়েল এসব জঘন্য অপরাধ করছে বলেই তারা এই গণহত্যা নিয়ে বিস্তারিত পরিসরে প্রতিবেদন করতে চায় না।

যেহেতু যুক্তরাষ্ট্র ও অন্যান্য অনেক পশ্চিমা সরকারকে ইসরায়েলের গণহত্যামূলক অপরাধের প্রধান ইন্ধনদাতা হিসাবে মনে করা হয়, সম্ভবত সে কারণেই তারা এসব খবর নিয়ে ঘাঁটাঘাঁটি করতে চায় না। অথবা হয়তো পশ্চিমের মিত্র দেশ ইসরায়েল এসব জঘন্য অপরাধ করছে বলেই তারা এই গণহত্যা নিয়ে বিস্তারিত পরিসরে প্রতিবেদন করতে চায় না।

এর মধ্যেই ইসরায়েলি গণহত্যা বন্ধে চলমান আইনি লড়াইয়ের একটি গুরুত্বপূর্ণ অগ্রগতি হয়েছে। আর তা হলো, আন্তর্জাতিক বিচার আদালতে (আইসিজে) ইসরায়েলের বিরুদ্ধে দক্ষিণ আফ্রিকার মামলা।

গত জানুয়ারিতে দ্য হেগের আইসিজের আদালতে প্রাথমিক শুনানির সময় বেশির ভাগ পশ্চিমা সংবাদমাধ্যম এই মামলায় দক্ষিণ আফ্রিকার পেশ করা যুক্তি ও নথিপত্রের সম্পূর্ণ বর্ণনা দেয়নি। সম্ভবত এর কারণ, এসব যুক্তি ও নথিপত্র গাজায় চলমান ইসরায়েলি হামলা ও ফিলিস্তিনিদের ওপর পৌনে এক শতাব্দী ধরে ইসরায়েলের চালানো জাতিগত নির্মূল অভিযান সম্পর্কে অনেক অস্বস্তিকর সত্য প্রকাশ করেছে।

গত ২৬ জানুয়ারি শুনানির সময় আইসিজে দেখেছে, ইসরায়েল গাজায় এমনসব কাজ করেছে যা কনভেনশন অন দ্য প্রিভেনশন অ্যান্ড পানিশমেন্ট অব দ্য ক্রাইম অব জেনোসাইড-এর সুস্পষ্ট লঙ্ঘন। ইসরায়েল ও তার পশ্চিমা মিত্ররা এই কনভেনশনকে একদিকে উপেক্ষা করেছে; অন্যদিকে বেশির ভাগ পশ্চিমা সংবাদমাধ্যম এটিকে এড়িয়ে গেছে অথবা ইসরায়েলের আঘাত হানাকে এই যুক্তিতে ইতিবাচক হিসেবে দেখিয়েছে যে, আইসিজে ইসরায়েলি আক্রমণ বন্ধ করার নির্দেশ দেয়নি।

যদিও বাদবাকি বিশ্বের জন্য আইসিজের এই রুলিং ছিল একটি গুরুত্বপূর্ণ বিজয়। এই নির্দেশ গাজায় ইসরায়েলি হামলায় মদদ দেওয়া থেকে বিভিন্ন সরকার ও করপোরেশনগুলোকে বিরত রাখার সংগ্রামে নতুন গতি এনেছে। সারা দুনিয়ায় যারা গাজায় ইসরায়েলের বর্বর হামলার বিরুদ্ধে নিজ নিজ দিক থেকে আইনি চ্যালেঞ্জ শুরু করেছে, আইসিজের এই নির্দেশ তাদের অনেককে উৎসাহিত করেছে।

গেল ফেব্রুয়ারিতে নিকারাগুয়া সরকার ইসরায়েলে অস্ত্র, গোলাবারুদ, প্রযুক্তি ও সামরিক সরঞ্জাম সরবরাহ অবিলম্বে বন্ধ করতে যুক্তরাজ্য, জার্মানি, নেদারল্যান্ডস ও কানাডার সরকারের প্রতি আহ্বান জানায়।

নিকারাগুয়া এসব দেশের সরকারকে লিখিত নোটিশ দিয়ে জানিয়ে দিয়েছে, নিকারাগুয়া ‘মৌলিক আন্তর্জাতিক মূল্যবোধ ও প্রথাগত আন্তর্জাতিক আইনের প্রতি বিশ্ববাসীর সম্মান প্রদর্শনকে অক্ষুণ্ন রাখতে’ আইসিজের আশ্রয় নেওয়াসহ সব ধরনের উপযুক্ত আইনি ব্যবস্থা নেবে।

গাজায় ‘গণহত্যায় সহায়তা করার’ অভিযোগ এনে চলতি এপ্রিলের শুরুতে নিকারাগুয়া জার্মানিকে আইসিজেতে নিয়েছে। জার্মান সরকারকে ইসরায়েলে অস্ত্র সরবরাহ বন্ধ করতে নির্দেশ দেওয়ার জন্য নিকারাগুয়া আনুষ্ঠানিকভাবে আদালতকে অনুরোধ করেছে। এর বাইরে আরও কয়েকটি পক্ষও আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতের (আইসিসি) দ্বারস্থ হয়েছে। নৃশংসতার অভিযোগে অভিযুক্ত ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের বিচার করার এখতিয়ার আইসিসির আছে।

গত মার্চের শুরুতে অস্ট্রেলিয়ার কয়েকজন আইনজীবী গাজার গণহত্যায় সম্ভাব্য জড়িত থাকার অভিযোগ এনে দেশটির প্রধানমন্ত্রী অ্যান্টনি আলবানিজের বিরুদ্ধে আইসিসির কাছে নালিশ জানিয়েছেন।

এর কয়েক সপ্তাহ পর ১৫টি আরব ও আন্তর্জাতিক মানবাধিকার গ্রুপ ইসরায়েলের যুদ্ধাপরাধের অভিযোগ খতিয়ে দেখতে আইসিসির কাছে আবেদন জানায়। এসব ঘটনার প্রায় সবগুলোর ক্ষেত্রেই দেখা গেছে, শুধুমাত্র স্থানীয় সংবাদমাধ্যমে ঘটনাগুলোর অগ্রগতির খবরাখবর ছাপা হয়েছে।

গাজায় ফিলিস্তিনিদের বিরুদ্ধে ইসরায়েলি গণহত্যা ঠেকাতে ব্যর্থ হওয়া এবং অনেক ক্ষেত্রে তাতে জড়িত থাকার অভিযোগ এনে গত নভেম্বরে যুক্তরাষ্ট্রের মানবাধিকার সংগঠন সেন্টার ফর কনস্টিটিউশনাল রাইটস (সিসিআর) একটি ফিলিস্তিনি আমেরিকান পরিবারের পক্ষে ক্যালিফোর্নিয়ার একটি আদালতে প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন, পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্টনি ব্লিঙ্কেন ও প্রতিরক্ষামন্ত্রী লয়েড অস্টিনের বিরুদ্ধে মামলা করেছে। তারা গাজায় গণহত্যা চালাতে থাকা ইসরায়েলকে সহায়তা দেওয়া বন্ধ করতে বাইডেন সরকারকে আদেশ দিতে আদালতকে অনুরোধ করেছে।

এসব খবর আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমে গুরুত্ব পাচ্ছে না। এটি তাদের দুমুখো নীতিকে সামনে আনছে যা দুঃখজনক।  

  • রমি জি খৌরি আরব সেন্টার ওয়াশিংটনের একজন অনাবাসী সিনিয়র ফেলো

    আল জাজিরা থেকে নেওয়া। ইংরেজি থেকে সংক্ষিপ্ত আকারে অনুবাদ: সারফুদ্দিন আহমেদ