মতামত

রাসেলস ভাইপারের ভয়ের চেয়ে বড় ভয় কি জানেন

সাবেক ও বর্তমান মিলিয়ে পদস্থ কর্মকর্তাদের একের পর এক আর্থিক কেলেঙ্কারির খবর সামাজিক যোগাযোগ ও সংবাদ—দুই মাধ্যমে ভাইরালের মতো ছড়াচ্ছে। দেশে এখন একই সঙ্গে ঘটনার এত ঘনঘটা যে কোনটা মূল ঘটনা আর ছদ্ম ঘটনা, তা বোঝা দুষ্কর।

এই যেমন চন্দ্রবোড়া বা রাসেলস ভাইপার সাপ নিয়ে যে তুলকালাম হচ্ছে, সেটার কথাই ধরা যাক। ফেসবুক খুললেই দেখা যাচ্ছে, এক পক্ষ সমানে ভয় ছড়াচ্ছে। যেন ঘরে-বাইরে সবখানেই ওত পেতে আছে ভয়ংকর বিষধর সাপ, মানুষ দেখলেই তাড়া করে ছোবল দেবে। 

 প্রচারণাটা এমনভাবে ছড়িয়েছে যে মানুষ সাপের ভয় পাচ্ছে। এই ভয়ের পেছনে একটা ঐতিহাসিক কারণও থাকতে পারে। বহু শতাব্দী ধরে সাপ আর বাঘের সঙ্গে এই ভূমির মানুষদের, আরও স্পষ্ট করে বললে এই ভূমিতে বসতি স্থাপনকারীদের লড়াই চলেছে। মধ্যযুগের মনসামঙ্গল কাব্যে চাঁদ সওদাগরের সঙ্গে দেবী মনসার বৈরিতার যে ছবি আমরা দেখতে পাই, সেটা নিশ্চিতভাবেই সেটারও প্রতিচ্ছবি। সাপ নিয়ে জনমানসে তাই মিথ ও লোককথারও কমতি নেই। 

যাহোক, ভয় ও আতঙ্ক এমন পর্যায়ে পৌঁছে গেছে যে রাসেলস ভাইপার হোক আর অন্য কোনো সাপ হোক, দেদার পিটিয়ে মেরে ফেলা হচ্ছে। কিন্তু সাপ তো আমাদের বাস্তুসংস্থানের গুরুত্বপূর্ণ অংশ। প্রতিবছর ইঁদুরে যে পরিমাণ ফসল খেয়ে ফেলে, সাপ না থাকলে তার চেয়ে বহুগুণ ফসল খেয়ে ফেলত ইঁদুরে। সাপ ইঁদুর খেয়ে সেই ভারসাম্য রক্ষা করে। যেভাবে সাপ মারার উৎসব চলছে, তাতে খাদ্যসংকট তৈরি হওয়ার আশঙ্কা করছেন কেউ কেউ। 

এ প্রসঙ্গে চীনের অভিজ্ঞতা আমাদের সবারই স্মরণে রাখা দরকার। ষাটের দশকের শেষ ভাগে চীনে সাংস্কৃতিক বিপ্লব যখন চলছিল, তার একপর্যায়ে একবার কমিউনিস্ট পার্টির দিক থেকে সিদ্ধান্ত নেওয়া হলো, চড়ুই পাখি প্রচুর খাদ্যশস্য খেয়ে ফেলছে, সে কারণে চড়ুই পাখির সংখ্যা কমানো হোক। লোকজন অতি উৎসাহে চড়ুই পাখি মারা শুরু করল। কিন্তু দেখা গেল সে বছর ফসলের উৎপাদন আগের বছরের চেয়ে অনেক কমে গেছে। বলা চলে দুর্ভিক্ষের পরিস্থিতি সৃষ্টি হলো। তার কারণ হলো, কীটপতঙ্গের উপদ্রব এতটাই বেড়ে গিয়েছিল যে তাতে ফসলের ব্যাপক ক্ষতি হয়েছিল। বলা বাহুল্য যে চড়ুই পাখির প্রধান খাবার কীটপতঙ্গ।

কাজেই ভয় ও আতঙ্ক থেকে যে প্রতিক্রিয়া আসে, আখেরে সেটা ভালো ফল বয়ে নিয়ে আসে না।

দুই.

পুলিশের সাবেক ও বর্তমান কর্মকর্তাদের কয়েকজনের বিপুল সম্পদের খবর গণমাধ্যমে প্রকাশিত হওয়ার পর পুলিশ সার্ভিস অ্যাসোসিয়েশন থেকে শুরু করে সরকারের মন্ত্রীরা বিবৃতি দিয়ে এ ধরনের সংবাদ প্রকাশকে উদ্দেশ্যপ্রণোদিত বলে সাবধানতা অবলম্বনের কথা বলেছেন। প্রশ্ন হচ্ছে, দুর্নীতিবাজদের দায় কেন পুলিশের সংগঠন কিংবা মন্ত্রীরা নিজেদের কাঁধে তুলে নিচ্ছেন।

দেশে এই যে সর্বগ্রাসী দুর্নীতি, তার মূল দায় অবশ্যই রাজনীতিবিদদের। ক্ষমতার জন্য এখন জনগণ আর ম্যাটার করে না, ম্যাটার করে সামরিক-বেসামরিক আমলাতন্ত্র, পুলিশ ও ব্যবসায়ীদের অভিজাত অংশ। ক্ষমতাসীন রাজনীতির সঙ্গে তাদের লেনদেন ও পরস্পরকে রক্ষার বিনিময়ে যে শক্তিশালী নেক্সাস গড়ে উঠেছে, সেটাই কি এই সর্বব্যাপী দুর্নীতির উৎস নয়?

সম্প্রতি অধ্যাপক হারুন-অর-রশিদ প্রথম আলোর সঙ্গে এক সাক্ষাৎকারে বিদ্যমান এই ব্যবস্থার একটা ব্যাখ্যা দিয়েছেন। তাঁর মতে, ‘বাংলাদেশের সাংঘর্ষিক রাজনীতির কারণে ক্ষমতায় থাকা রাজনৈতিক দল চায় সব সময় ক্ষমতায় থাকতে। ক্ষমতায় থাকতে হলে ক্ষমতার ক্ষেত্রে যারা ম্যাটার, তাদের ওপর নির্ভর করতে হয়। এ কারণেই বৃহত্তর রাজনৈতিক দল হওয়া সত্ত্বেও আওয়ামী লীগকে এখন ব্যবসায়ী, প্রশাসন, আমলাতন্ত্র, পুলিশ ও সেনাবাহিনীর ওপর নির্ভর করতে হচ্ছে। তারা আবার সেই সুযোগও নিচ্ছে।’ (আওয়ামী লীগের সর্বশ্রেষ্ঠ অর্জন স্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা, ২৩ জুন ২০২৪)

ক্ষমতাসীন রাজনীতি এবং আমলাতন্ত্র ও ব্যবসায়ীদের পারস্পরিক নির্ভরশীলতা দেশে শেষ পর্যন্ত একটা দায়মুক্তির সংস্কৃতি তৈরি করেছে। এনবিআর কর্মকর্তা মতিউর রহমানের কথাই ধরা যাক। পচা শামুকে পা কাটার মতো ছাগল–কাণ্ডে ধরা পড়ার আগে মতিউর রহমান বহু বছর ধরে দুর্নীতি ও জালিয়াতির সাম্রাজ্য গড়ে তুলেছিলেন। তাঁকে নিয়ে সংবাদমাধ্যমে নানা সময়ে অনুসন্ধানী প্রতিবেদনও প্রকাশিত হয়েছে।

ফেসবুকে অনেকে শেয়ার করেছেন, ২০০৮ ও ২০০৯ সালে মতিউর যখন কাস্টমসের যুগ্ম কমিশনার ছিলেন, তখন তাঁর দুর্নীতি ও জালিয়াতির খবর প্রকাশিত হয়েছিল। কিন্তু বিচার তো হয়নি; বরং দুদকের সাবেক প্রধান বদিউর রহমানের ভাষ্য অনুযায়ী, মতিউরকে রক্ষায় ক্ষমতার কেন্দ্রে থাকা ব্যক্তিরা তদবির করেছিলেন। সেই পুরস্কারে গত ১৬ বছরে শত শত কোটি টাকার মালিক হয়েছেন তিনি। 

সম্প্রতি সামরিক-বেসামরিক আমলাদের কয়েকজনের বিপুল সম্পত্তির খবর পাওয়া গেছে, সব ক্ষেত্রেই অন্য একটা বিশেষ ধরন দেখা যাচ্ছে। তাঁরা সবাই বিপুল পরিমাণ কৃষিজমি দখল কিংবা জোর করে কেনা কিংবা সত্যিকারের কিনে সেখানে রিসোর্ট কিংবা খামার বা বিনোদনকেন্দ্র বানাচ্ছেন।

আলাদিনের দৈত্যের চেরাগ পাওয়াদের এই রিসোর্ট–বিলাস দেখে ফেসবুকে একজন সাংবাদিক লিখেছেন, ‘পথে যেতে যেতে মাঝে মাঝে ধু ধু মাঠের মধ্যে প্রাসাদোপম রিসোর্ট দেখা যায়। আগে ভাবতাম সেগুলো হয়তো প্রবাসীদের বাড়ি। এখন বুঝতে পারছি, সেগুলো আসলে কাদের বাড়ি।’

দেশের জনসাধারণের বড় একটা অংশ এখন রাসেলস ভাইপারের ভয়ে ভীত ও আতঙ্কিত। সেই ভয়ের অনেকটাই চাপিয়ে দেওয়া। অথচ বানানো এই ভয়ের আড়ালে চাপা পড়ে যাচ্ছে সত্যিকারের ভয়। 

মনোজ দে প্রথম আলোর সম্পাদকীয় সহকারী